ভ্রমণ

জনতার কাঠগড়ায় মোদির ‘পোস্টমর্টেম’

এস এম কামরুজ্জামান : ২৬ মে ২০১৪। দিনটি ছিল ভারতের ইতিহাসের ঐতিহাসিক একটি মুহূর্ত। চা-বিক্রেতা থেকে দেশের ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হওয়ার রূপকথার গল্প এদিন বাস্তবে রূপ নেয়। পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে নতুন ভারত গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। যদিও নির্বাচনী প্রচারণায় নিজের ক্যারিশম্যাটিক দেখিয়ে এর আগেই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছিলেন ওই চা-বিক্রেতা, যার নাম আমরা নরেন্দ্র দামোদার মোদি বলেই জানি।

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তার গায়ে লেগে থাকা সাম্প্রদায়িকতার কালি বিশ্বদরবারে বেশ জোরোশোরে প্রচার পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে তিনি ‘ভারতে বানাও’ (মেক ইন ইন্ডিয়া) স্লোগান দিয়ে সেগুলো সুশোভিত গন্ধে পরিণত করেন। অক্লান্ত পরিশ্রম ও নির্বাচনে প্রচারণায় নিত্যনতুন সব কৌশলের কারণে তিনি শুধু ভূমিধস সফলতাই পাননি, সুনামির মতো উড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশটির সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও এর একটানা ১০ বছরের শানমালের সব কৃতীকে, সঙ্গে দেশটির শক্তিশালী ও জনপ্রিয় আঞ্চলিক দলগুলোকেও।

 

ছোটবেলায় যার চা বেচে দিন কেটেছে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানি দিয়ে যার ললাটে হাজারো মুসলিমের রক্তের দাগ লেগে আছে- সেই গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী মোদি ভারতের মতো উদীয়মান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হবেন- এ কথা সে সময় শুনলে হয়তো মানুষ নাক সিটকাতেন!

 

কিন্তু সেই ধারণা তিনি ভুল প্রমাণিত করেছিলেন লোকসভা নির্বাচনে। সেখানে মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তার দল বিজেপি একাই ২৮২টি আসন পায়, যা সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়েও ১০টি আসন বেশি। তার রাজনৈতিক জোট এনডিএ পেয়েছিল ৩৩৬টি আসন, যা ইতিহাসে রেকর্ড।(সূত্র : উইকিপিডিয়া) 

 

সেই সময় থেকে মোদি সরকারের সময়কাল এক বছর গত হয়েছে। প্রথম বছরটা কেমন কাটল, কতটা সাফল্য কতটা ব্যর্থতা, সব মহলেই শুরু হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।

 

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস অবশ্যও মোদি সরকারের সাফল্যের মূল্য দিতে বিন্দুমাত্র রাজি নয়। তারা মোদির উন্নয়নের চিত্রে আশান্বিত হতে পারেনি। রাজনীতিকেরা তাদের মতোই সবকিছুতেই রাজনীতি করবেন এটাই স্বাভাবিক। জনতার মাপকাঠি গত এক বছরে মোদি পাস নম্বর পেয়েছেন। সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল অনুযায়ী দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ মনে করছেন- নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রথম বছরটা বেশ ভালোই চালিয়েছে। (সূত্র : ২৫ মে ২০১৫, টাইমস অব ইন্ডিয়া)

 

চিরশত্রু পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ ও মরিশাসের সরকারপ্রধানদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আনার মাধ্যমে মোদি যে একজন জাঁদরেল রাজনীতিবিদ, তার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের কূটনীতিতে নতুন কিছু ঘটাতে যাচ্ছেন বলেও বার্তা দিয়েছিলেন মোদি।

 

প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক আগের চেয়ে আরো ভালো করতে আগ্রহী- মোদি এই এক বছরে শাসনামলে সেটাই দেখা গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল সংসদে পাস এরই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এ ছাড়া ভুটান, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অবাধে যান চলাচল চুক্তির ব্যাপারে তিনি কাজ শুরু করেছেন। এটা হলে উক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি দূর হবে।

 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো- শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানে গিয়ে বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় ও পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তিনি। এ অঞ্চলকে একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে আনার চেষ্টা করছেন, যাতে সফলও তিনি। পররাষ্ট্র নীতিতে শুধু এশিয়াতেই সফলতা দেখাননি মোদি, পশ্চিমা ও বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশগুলোর সঙ্গেও কূীটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছেন তিনি।  

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং, জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবেসহ অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গেই তিনি ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে তুলেছেন, বৈঠক করেছেন। ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী করতে ওই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দারুণ ফলদায়ক। এই এক বছরে মোদি মোট ১৮টি দেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশ হতে চলেছে উনিশতম দেশ।

 

বিদেশনীতির মতোই অর্থনীতিতেও বেশ সফলতা দেখিয়েছেন তিনি। ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের আর্থিক বছরগুলোতে ভারতের অর্থনীতিতে সার্বিক যে মন্দাভাব ছিল, এক বছরে তা অনেকটাই কেটে গেছে। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলো ঘোষণা করেছে, ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার চীনকেও ছাপিয়ে যাবে।

 

রাজনৈতিক, আমলাতন্ত্রসহ সরকারি স্তরে ঘুষের যে রমরমা ছিল, তা প্রায় শেষ করে দিয়েছেন। এই এক বছরে সরকারি স্তরে দুর্নীতির একটা অভিযোগও কেউ আনতে পারেনি। কয়লার ব্লক বণ্টন করা হয়েছে স্বচ্ছভাবে। সে জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

 

মুদ্রাস্ফীতি কমেছে, উৎপাদনশিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, কর্মসংস্থান ধীরে হলেও বাড়ছে, বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় বাজারের ওপর আস্থা রাখছেন। বিদেশে পাচার হওয়া কালোটাকা দেশে ফিরিয়ে প্রত্যেকের ব্যাংকে ১৫-১৬ লাখ করে জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেশের সাধারণ মানুষকে বেশ আশ্বস্ত করেছেন তিনি।

 

এ ছাড়া বিভিন্ন মন্দিরে পড়ে থাকা কোটি কোটি টাকা স্বর্ণ বাজারমূল্যে বিক্রি করে সেই অর্থ ব্যাংকে জমা রেখে এর লাভ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার পরিকল্পনা দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো অন্যতম মাধ্যম হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদেশ থেকে হাজারো কোটি টাকা যে স্বর্ণ আমদানি করা হতো এটা করলেও সেটা আর করা লাগবে না। ফলে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিদেশে যাবে না।

 

স্বচ্ছ ভারত অভিযান, গঙ্গা সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতনতাকে একটা আন্দোলনের রূপ দিতে চেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ দেশটির সব মোদিবিরোধী মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি রাজনৈতিক কৌশলে যেভাবে আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়েছেন, যা রাজনৈতিক দক্ষতার বিরাট সাফল্য তার।  

 

তবে তার এ সময়টাই তিনি ব্যর্থ কিংবা বিতর্কিত  হননি এমনটা নন। ‘ঘর ওয়াপসি’র (অন্য ধর্মের লোককে হিন্দু বানানো) মতো বিতর্কিত কাজে এই এক বছরে তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেননি। সাম্প্রদায়িক অশান্তি বিষয়ে মুখ বুজে থাকলেও সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা তিনি বরদাশত করবেন না।

 

ব্যবসায়ী ও ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। অপরদিকে ঋণগ্রস্ত হয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। এ বিষয়ে বিরোধী দলসহ অনেকে মোদির ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। তবে সবশেষ বলা যায়, এক বছরে মোটামুটিভাবে মোদি সফল। বাকি বছরগুলোতে তিনি কী জাদু দেখান, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

লেখক : সাংবাদিক ও মিডিয়া গবেষক।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ মে ২০১৫/কামরুজ্জামান/এএন