ভ্রমণ

নিরাপদ হোক মাতৃত্বের প্রতিটি মুহূর্ত

আজমাল হোসেন মামুন : ২৮ মে বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। প্রতিবছর দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। দিবসটি বিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালিত হলেও আমাদের দেশে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজনও চোখে পড়ে। দেশের সব জেলা হাসপাতাল, মাতৃ ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে এ উপলক্ষ্যে বিশেষ মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ পালন করা হয়।

 

‘নিরাপদ সন্তান  প্রসব মায়ের অধিকার’ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই। অথবা ‘হাসপাতালে প্রসব করান, মা ও শিশুর জীবন বাঁচান’এমন একটা শ্লোগানও এ সমাজে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন। এবার দিবসটিতে এই শ্লোগান শোনা যাবে। সুস্থ মা জন্ম দেন সুস্থ সন্তান। আর এই সুস্থ সন্তানটির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। যে কোনো দেশের উন্নয়নের একটি বিশেষ দিক হলো মাতৃস্বাস্থ্য। মাতৃস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব এবং এর কার্যকারিতা অনুধাবন করে ১৯৯৭ সাল থেকে ২৮ মে দিবসটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে।

 

২০০১ সালে প্রতি লাখে মাতৃ মৃত্যুহার ছিল ৩২২ জন। এই হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অঙ্গিকারবদ্ধ সরকার। মা, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নকল্পে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ২০১০ সালে ওই হার কমিয়ে ১৯৪-এ আনা হয়। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার ১৪৩-এ কমিয়ে আনা হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সাফল্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এমডিজি পুরস্কার দেয়া হয়।

 

মাতৃ মৃত্যুহার কমে এলেও বাস্তবে এখনও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। এর কারণ সচেতনতার অভাব। এখনও বাংলাদেশে অনেক মা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। দক্ষ দাইয়ের হাতে প্রসবের হার বর্তমানে বেড়ে ৩২ শতাংশ হলেও এখনও ৬৮ শতাংশ মায়ের প্রসব করানো হয় অদক্ষ দাই দ্বারা। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের কারণে অনেক নারীই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে না। একটি কিশোরীর মাঝে নারীত্ব ফুটে উঠলেও মাতৃত্ব, সন্তান লালন-পালন ও গর্ভাবস্থায় যত্ন সম্পর্কে সচেতন হতে সময়ের প্রয়োজন হয়। সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে হলে শারীরিক, মানসিক সবদিক দিয়ে মাকেও সুস্থ থাকতে হবে। একজন মায়ের মাঝে মাতৃত্বের পরিপূর্ণতা আসতে হবে। অল্প বয়সে বিয়ে আবার অল্প বয়সে মা হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে সন্তান স্বাভাবিক থাকে না। তখন মায়ের ওপর দোষ চাপানো হয় যে, মা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। তখন পরিবার সেই মায়ের স্বামীকে আবার বিয়ে করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু পরিবারের সচেতনতা আর উপযুক্ত মা-ই জন্ম দিতে পারে একটি সুস্থ সন্তান।

 

দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও  উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে জরুরি প্রসূতি সেবা কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সব কার্যক্রম থাকলেও সঠিক সময়ে সেবা পায় না জনগণ। এর কারণ হচ্ছে পারিবারিক কুসংস্কার। অনেকে বাড়ির বউকে সন্তান প্রসব করানোর জন্য বাইরে নিতে চান না। জানাজানি হয়ে যাবে এমন অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সমাজে। সেজন্য বাড়িতে প্রসবসেবা নিশ্চিত করতে সরকার ইতোমধ্যে অনেক মাঠকর্মীকে সিএসবিএ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে ৩০০ মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও এগিয়ে চলছে। তার মধ্যে ১৮০ জন নার্স স্বল্পমেয়াদি এই কোর্স সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়া হতদরিদ্র মায়েদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও  প্রসব-পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে ৫৩টি উপজেলায় মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম চালু করা হয়েছে।

 

২০১০ সালের ১৮ মে ইউএনএফপিএ এবং দ্য ডেইলি স্টারের যৌথ উদ্যোগে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জন ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইউএনএফপিএ অ্যাসিস্ট্যান্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. হাসিনা বেগম বলেছিলেন, প্রতিদিন ২০ জন প্রসূতি নারীর  মৃত্যু আমাদের জন্য উদ্বেগজনক, যেখানে গত নয় বছরে সিজারিয়ান অপারেশন বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে। সরকারি হিসাবে ৩৫ শতাংশ সিজারের কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে ৭১ শতাংশের কথা বলা হয়। এভাবে চলতে থাকলে ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা দৌড়ের শেষ মাইল শেষ করছি। তিনি আরও বলেছিলেন, পরিবার পরিকল্পনার  প্রসার, দক্ষ প্রসবকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

 

পপুলেশন কাউন্সিলের এক জরিপ মতে, প্রতি বছর ৩০ লাখ শিশু জন্মায়। তার মধ্যে জেলায় ৬০ হাজার, উপজেলায় ৪ হাজার ও ইউনিয়নে ৬০০ জন। মাতৃ মৃত্যুহার কমাতে হলে নারী শিক্ষার হার আরও বাড়াতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধ হলেই বছরে ১০ লাখ জন্ম কমবে। সিডও সনদের ১২ নং ধারায় বলা হয়েছে, পরিবার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শরিক রাষ্ট্রসমূহ, স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই ধারায় অনুচ্ছেদ -১ এর বিধান ছাড়াও শরিক রাষ্ট্রসমূহ  প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে সার্ভিস প্রদান করবে, সেই সাথে গর্ভাবস্থায় ও শিশুকে মায়ের দুগ্ধদানকালে পর্যাপ্ত পুষ্টির ব্যবস্থা করে গর্ভকাল, সন্তান জন্মদানের ঠিক আগে এবং সন্তান জন্মদানের পরে নারীদের উপযুক্ত সেবা প্রদান করবে। বাংলাদেশ সিডও সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও এখনো এই সেবাসমূহ নিশ্চিত করতে পারেনি।

 

বিশ্বে মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকাশিত  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৪৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, দেশটি উন্নতি করছে। সরকারি এক তথ্যে জানা গেছে, দেশে মাতৃমূত্যুর বর্তমান হার ৩.৪ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। গত কয়েক বছরে দেশে মাতৃমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ২০০১ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল যেখানে ৩২২ জন, ২০১০ সালের পর এ হার নেমে এসেছে ১৯৪ জনে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের মাত্র ৯ ভাগ গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসবের সময় চিকিৎসক ও পেশাদার ধাত্রীর সহায়তা নিতেন। ১০ বছরের মধ্যে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। চিকিৎসাবিদদের মতে, ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ গর্ভবতী নারীই সন্তান প্রসবের সময় আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করবেন।

 

পারিবারিক অসচেতনতা, ভুল চিকিৎসা, দারিদ্র্য, সর্বোপরি নারীর প্রতি পরিবারের পুরুষদের অবহেলার কারণে নারীরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারণে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় অনেক সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশংকা থাকে। বাল্যবিবাহ, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়াও অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অসংখ্য মা যন্ত্রণাদায়ক ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশে ৬০ হাজার থেকে ১লাখ। প্রতি ৩ হাজার বিবাহিত মহিলার মধ্যে ৫ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছে। (২৩ মে ২০১৫, দৈনিক ইত্তেফাক)।

 

এ কারণে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই নারীর প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। নিরাপদ মাতৃত্বের ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে মাতৃ স্বাস্থ্যের প্রতি যেমন খেয়াল রাখতে হবে, তেমনি সন্তান প্রসবের সময় সচেতন হতে হবে। সকলকে ভাবতে হবে, নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে। তাহলেই মাতৃত্বের প্রতিটি মুহূর্ত নিরাপদ হবে।

 

লেখক : ব্লগার এবং সাংবাদিক।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মে ২০১৫/তাপস রায়