ভ্রমণ

এই দ্বিধা-বিভক্ত চেতনা লইয়া আমরা কী করিব

তাপস রায় : মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে একটি বই লিখব ভাবছি। বহুদিন থেকেই প্রস্তুতি চলছে। এ কারণে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সে সময়ের স্মৃতি বিজড়িত গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান বর্তমানে আমার আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ বিভিন্ন জনের সঙ্গে আগ বাড়িয়েই এ প্রসঙ্গে কথা বলি। কারণ জানি এদের অনেককেই হয়তো খুব বেশি দিন আর পাব না। তাই যতটুকু তাদের মুখ থেকে জেনে নেয়া যায় সে চেষ্টা করি। বিশেষ করে তখন মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্টস অ্যান্ড টেকনিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি সংগঠনের যারা বেঁচে আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে অভিভূত হচ্ছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন নাসিম চৌধুরী। তার লেখা কবিতা ‘কমান্ডার’ শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করত সেই তমসাচ্ছন্ন সময়ে। একদিন ফোনে এ কথা মনে করিয়ে দিতেই অপরপ্রান্ত থেকে নাসিম চৌধুরীর স্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলাম, এখনও আবৃত্তি করেন?হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ। এখন স্ত্রীই আমার আবৃত্তির একমাত্র শ্রোতা!স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আশফাকুর রহমান খান কত কথাই না স্মৃতি হাতড়ে বললেন। আমাদের রাইজিংবিডি অফিসে এসেছিলেন। আমি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তাঁর মুখ থেকেই জেনেছি ‘চরমপত্র’ নামটি তিনি দিয়েছিলেন। মুস্তাফা মনোয়ার স্যারও একদিন বাসায় যেতে বললেন। বাসায় গেলে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার প্রসঙ্গ তুলতেই স্যার স্মৃতিকাতর হলেন।  অনেকের নাম স্মরণ করতে পারলেন না। এ জন্য তাঁর সে কি অপরাধবোধ। আহারে! বয়স কত কিছুই না ভুলিয়ে দেয়। চাষী নজরুল ইসলাম আর নেই। তাঁর মুখ থেকে একদিন শুনলাম বাংলাদেশ ফিল্ম আর্টস অ্যান্ড টেকনিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কথা। তিনি সে সময় চলচ্চিত্রাঙ্গণের মানুষের অবদানের কথা বললেন। অবধারিতভাবেই এলো জহির রায়হানের কথা। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে নরক হয়ে উঠল সোনার বাংলা। পেছনে শত্রুর রাইফেলের গর্জন, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনেও মানুষ ছুটল আশ্রয়ের সন্ধানে। এক শকুনের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে গিয়ে বহু শরণার্থী পথেই শকুনের খাবার হয়ে গেল। অথচ ইয়াহিয়া খান বেমালুম অস্বীকার করতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের এই হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু সম্ভব হলো না। জহির রায়হানের উদ্যোগে গড়ে উঠল বাংলাদেশ ফিল্ম আর্টস অ্যান্ড টেকনিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। তৈরি হলো ‘স্টপ জেনোসাইড’। তহবিল সংগ্রহ থেকে শুরু করে জনমত গঠন, মিছিল, মিটিংয়ের ফাঁকে ক্যামেরা নিয়ে অবিশ্রান্ত ছুটে চলা- অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি নিয়ে একজন মানুষ একা কত কাজই না করেছেন! যত ভাবি তত শামুকের মত ভিতরে ভিতরে গুটিয়ে যাই। এই যে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভাবনা তাদের সমন্বয় কীভাবে হলো? তারা সে সময় প্রত্যেকেই স্বনামে পরিচিত। কেউ লেখক, কেউ মঞ্চনাটক-চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত, কেউ সংগীতশিল্পী, কেউ চিত্রকর, সাংবাদিক- যত মত তত পথ হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। একাত্তরে তা হয়নি। কেন হয়নি ভাবি আর অবাক হই। উত্তর মেলে না। আবার হঠাৎ করেই পেয়ে যাই উত্তর। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা প্রত্যেকেই যার যার জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগঠনের উচুঁ পদে ছিলেন। অথচ কী আশ্চর্য, কেউই সেই পদের নামটি পর্যন্ত মুখে নিতে চান না! সকলেরই একটাই কথা- আমরা সবাই কর্মী ছিলাম। আহারে! এ দেশে আজ কত মানুষ অথচ কর্মীর কতই না অভাব!আমাদের মুক্তিসংগ্রামের লড়াই শুধু দেশের মাটিতেই হয়নি। অবরুদ্ধ দেশে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় কেউ টিকে থাকার লড়াই করেছেন, কেউ আবার পাক সেনাদের বর্বরতার কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে, জনমত গঠনে কিংবা তহবিল সংগ্রহে ছুটেছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। এ ক্ষেত্রে যে সংগঠনটি অর্থবহ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল সেটি বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের তৎকালীন কার্য নির্বাহী সদস্য মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের কাছ থেকে শুনেছি সে সময়ের বুদ্ধিজীবীদের কথা। একাত্তরে বিদেশের মাটিতে এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয়ে বহু কাজ অর্থবহভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। প্রিয় জন্মভূমি সে সময় প্রত্যেককে এক সুতায় গেঁথেছিল সময়ের প্রয়োজনে। নটে গাছটিও মুড়িয়েছে, আজ সেই প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। চারপাশে এখন শুধু্ই বিভেদ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ আজ দলে-উপদলে বিভক্ত। কোথাও কোনো ঐক্য নেই। ভিন্ন মত যেন সহ্যের অতীত। আপন মত প্রতিষ্ঠায় অসহিষ্ণু বুদ্ধিজীবীর আধিক্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয় নীল, নয়তো সাদা। কারওয়ান বাজারের শ্রমিকদের মতো সেখানেও আজ সমান কোন্দল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও আজ দ্বিধাবিভক্ত!অথচ স্বাধীনতার ডাক উপেক্ষা করেনি এ দেশের মানুষ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সবাই। সেই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন শিল্পসাহিত্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরাও। তারা অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে যাননি। তাদের হাতে ছিল অন্য অস্ত্র। তারা করেছেন ভিন্ন আরেক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কলমকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করেছেন লেখক। বন্দুকের বদলে ক্যামেরা দিয়ে শুট করেছেন চলচ্চিত্রকার। তুলিকে বেয়োনেট বানিয়েছেন চিত্রকর। কখনও আবার কণ্ঠ শেলের মতো ছুঁড়ে দিয়েছেন কথক। আজ শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনে সেই চেতনা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ প্রতিপক্ষ আজও আছে। তারা সংগঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সুদৃঢ় চেতনায় এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত হবেন কবে?রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মে ২০১৫/তাপস রায়