ভ্রমণ

পলাশীর যুদ্ধ : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

দীপংকর গৌতম : সেন ও পাল বংশের শাসনামলকে  ‘বাংলার শেষ শাসনামল’ বলে উল্লেখ করা হলেও  এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। যদিও বাঙালি শেষ শাসক হিসেবে বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮), লক্ষ্মণ সেন (১১৭৮-১২০৬), বিশ্বরূপ সেন (১২০৬-১২২০) ও কেশব সেন (১২২০-১২৫০) এর নাম  পাওয়া যায়। তারপরও পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন সূর্য অস্ত গিয়েছে বলে শোনা যায়। অথচ এ সময়ের আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসকদের পর এ অঞ্চলে বাঙালিদের শাসন ছিলো এমন কোনো নজির পাওয়া যায় না। এ কথা ঠিক, পলাশীর আম্রকাননে সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ইংরেজ শাসন আসে। সিরাজউদ্দৌলা কি বাঙালি ছিলেন? তিনি ছিলেন মোগল।

 

মোগল আলীবর্দী খাঁর দৌহিত্র বলেই তিনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব হয়েছিলেন। এটি মাতৃ সমতুল্য ঘসেটি বেগমেরও  গা-জ্বালার কারণ ছিল। মোগলরা এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে। সমসাময়িকরা বাবরের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে ‘তিমুরি সাম্রাজ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘আইন-ই-আকবরি’তে হিন্দুস্তান নামটির উল্লেখ রয়েছে। পাশ্চাত্যে মোগল শব্দটি সম্রাট ও বৃহৎ অর্থে সাম্রাজ্য বুঝাতে ব্যবহৃত হতো। মঙ্গোল শব্দের আরবি ও ফারসি অপভ্রংশ থেকে মোগল শব্দটি এসেছে। সুতরাং মোগল শাসন যে বাংলা অঞ্চলের জন্য সুবাতাস বইয়ে দিয়েছিল মোটেও তা নয়। এ দেশ তখনও পরাধীন ছিল। তখন সুশাসনের জন্য বারো ভুঁইয়ার আবির্ভাব হয়।

 

বারো ভুঁইয়ার মধ্যে সোনার গাঁয়ের ঈশা খাঁ, চাঁদপুরের চাঁদ রায়, শরীয়তপুরের কেদার রায় ও যশোরের প্রতাপাদিত্য মোগল শাসনকে কখনোই মেনে নেননি। কেদার রায় ও প্রতাপাদিত্যকে মোগলদের সঙ্গে বহুদিন যুদ্ধ করতে হয়েছে। পরে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রতাপাদিত্যকে দীর্ঘ যুদ্ধের পরে গ্রেফতার করে বাঘের খাচায় বন্দী করে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যাই হোক, কথা হলো, বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায় মধ্যযুগে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করার মাধ্যমে। কাজটি করেছিলেন  ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। কিন্তু এই সহজ কথাটা যত সহজে বলা যায় তত সহজ নয়।  এক দুপুরে ঘোড়া বিক্রেতার বেশে বখতিয়ার খিলজি ১৭ জন সৈন্য নিয়ে ঝাড়খণ্ডের ভেতর দিয়ে এসে নদীয়া আক্রমণ করেন। এ সংবাদ শুনে বয়স্ক লক্ষ্মণ সেন পেছনের দরজা দিয়ে নদী পথে পলায়ন করে। এই অবসরে বখতিয়ারের বিশাল সৈন্য বাহিনী নদীয়াতে এসে উপস্থিত হয়। যার ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা চলে আসে মুসলমানদের হাতে। শুরু হয় বাংলায় মুসলিম শাসন। সুলতানগণ তখনও স্বাধীন ছিলেন। কেউ কেউ অবশ্য দিল্লির সুলতানদের আনুগত্য স্বীকার করেছেন। এ সময় বণিকরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুসলিম বসতি গড়ে তোলে।

 

দ্বিতীয় ধারায় বাংলায় আগমন করেন মুসলিম সুফিগণ।

 

বাবর মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কি-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক। বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর ভারতে ভাগ্য নির্মাণে নিয়োজিত হন। তিনি নিজেকে কাবুলের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ের পর বাবরের সেনাবাহিনী উত্তর ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয়। তবে শাসন পাকাপোক্ত করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাদেরই উত্তরসুরীরা ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে হেরে যায়।পতন ঘটে নবাব সিরাজউদ্দৌলার।

 

১৭৫৬ সালে উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে বিবাদ-লড়াইয়ে আলিবর্দী খাঁ’র দৌহিত্র তরুণ সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। জগৎ শেঠ এবং তার ভ্রাতা মহতব রাই ও স্বরূপ চাঁদ, রাজা জানকীরাম, রায়দুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মানিক চাঁদ, নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, উমি চাঁদ, রাজা রাজবল্লভ প্রমুখ ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে পরাজিত করে ইংরেজ বাহিনী। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় মাত্র তিন হাজার সৈন্যের ক্লাইভের বাহিনীর কাছে বিনা যুদ্ধে নবাবের ১৮ হাজার অশ্বারোহী ও ৫০ হাজার পদাতিক বিশাল বাহিনীর পরাজয় ঘটে।

 

পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ বেনিয়ারা তাঁবেদার লেখকদের দিয়ে ইতিহাস রচনায় অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে। নিজেদের গুণকীর্ত্তন এবং সিরাজউদ্দৌলার প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ নানা অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। সে সকল ইতিহাসে লম্পট, মাতাল, চরিত্রহীন, নিষ্ঠুর, অপদার্থ, অর্বাচীন ইত্যাকার নেতিবাচক অভিধায় সিরাজউদ্দৌলাকে অভিহিত করা হয়েছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ঠেকাতে ইংরেজ বেনিয়ারা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়ে রক্ষা করেছিল বঙ্গভূমি- এমনও লেখা হয়েছিল। সিরাজও যে দক্ষ শাসক ছিলেন এমন কথাও বলা যাবে না। কারণ তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য যেসব ঘটনা ঘটেছে তা দমনে তিনি অতোটা তৎপর ছিলেন বলে মনে হয় না। সিরাজ চরিত্রগতভাবে কি ছিলেন সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো সংগ্রাম, দেশপ্রেম মানুষকে অমর করে। তিনি এ কারণে অমর হয়ে আছেন, থাকবেন।

 

পলাশীর যুদ্ধের অর্ধ শতাব্দী পর বাংলা ভাষায় সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে কল্পিত নেতিবাচক সমালোচনামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ‘রাজাবলী’গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘বিশিষ্ট লোকেদের ভার্যা, বধূ ও কন্যা প্রভৃতিকে জোর করিয়া আনাইয়া ও কৌতুক দেখিবার নিমিত্ত গর্ভিণী স্ত্রীদের উদর বিদারণ করানো ও লোকেতে ভরা নৌকা দোলানোতে দিনে দিনে অধর্ম্ম বৃদ্ধি হইতে লাগিল।’এমন মিথ্যাচারে সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র হননের কল্পিত কাহিনি সমাজে সিরাজউদ্দৌলা বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি এবং সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ নষ্ট করার প্রাথমিক অপচেষ্টা বলে ধরা হয়। পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বিভাজন সৃষ্টিতে চতুর ইংরেজ ‘ভাগ কর-শোষণ কর’ নীতির নিষ্ঠুর আশ্রয় নেয়। তারই পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তি, রক্তাক্ত দেশভাগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের রক্তাক্ত দাঙ্গায়।

 

চাটুকার-তাঁবেদার ইতিহাস রচয়িতারা নির্জলা মিথ্যাচারে ইতিহাস বিকৃত করেছিল ইংরেজদের আদেশ-নির্দেশে এবং ইচ্ছাপূরণে। বাংলার জনরোষ থেকে দখলদার ইংরেজদের ইমেজ রক্ষায় এবং প্রহসনের পলাশীর যুদ্ধের ঘৃণিত দায় থেকে ইংরেজদের অব্যাহতি লাভের অভিপ্রায়ে মিথ্যাচারের ইতিহাস রচনায় ইংরেজরা প্রত্যক্ষ মদদ জুগিয়েছিল। প্রাসাদ চক্রান্তের ঘটনা না ঘটলে ইংরেজদের পক্ষে সমর ও রাজশক্তিরূপে আবির্ভূত হবার প্রয়োজন হতো না- এই নির্জলা মিথ্যাচার বিশ্বাস করার বিন্দুমাত্র যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশ্বজুড়ে ইংরেজদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাই প্রমাণ করে ভারতবর্ষে বাণিজ্যের উসিলায় দেশ দখলই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। কার্ল মার্ক্স ১৮৫৩ সালে বলেছেন, ‘ইউরোপের দুই জোটের উপনিবেশ ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিণত হয়েছে সমর ও রাজশক্তিরূপে।’

 

বণিক বেশে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। এরপর ফরাসিদের অনুসরণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে ফরাসি সামরিক অফিসারদের অধীনে ভারতীয়দের যুক্ত করে গড়ে তুলেছিল সৈন্যবাহিনী। কিন্তু ফরাসিরা ইংরেজদের কাছে অনেকগুলো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে এবং অর্থনৈতিক কারণে রণে ভঙ্গ দিয়ে ভারতবর্ষ দখলের আশা ত্যাগ করে। শক্ত প্রতিপক্ষহীন সুযোগের মওকায় নানা যুদ্ধ-বিগ্রহে, শঠতায়-প্রতারণায় ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। একে একে গোটা ভারতবর্ষ ইংরেজদের অধীন হয়ে যায়।

 

নবীন চন্দ্র সেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে অযথা কলঙ্ক লেপনের জন্য ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাকে ভর্ৎসনা করেছেন। পলাশীর যুদ্ধজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক অভিলাষ এবং আধিপত্য বিস্তারে ক্রমেই ভারতবর্ষকে করতলগত করেছিল। খ্যাতিমান ঐতিহাসিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে পলাশীর যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা দ্বিধাহীন চিত্তে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রক্ষা করতে গিয়েই প্রাণ দিয়েছেন। ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে তাকে প্রথম ভারতীয় বীররূপে গণ্য করতে হবে।’ কথাগুলো মোটেও মিথ্যে নয়, নির্ভেজাল সত্য। সেটা পৌনে দুইশ বছরের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে প্রমাণিত হয়েছে।

 

বিজয়ীমাত্রই ক্ষমতার আনুকূল্যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে নিজেদের বীররূপে প্রকাশ করে। অন্যদিকে দেশপ্রেমিক বীর নায়ককে খলনায়কে পরিণত করে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে পেরেছিল ইংরেজ শাসকেরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পলাশীর যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ১৩৯ বছর পরে ইংরেজ শাসনামলেই প্রকাশ পেয়েছে। সিরাজউদ্দৌলাকে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা তার সংগ্রামকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। ইংরেজ বেনিয়ার বিরুদ্ধে এই সংগ্রামের ইতিহাস চেতনায় অগ্নিমশাল জ্বালবে যুগে যুগে।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৫/তাপস রায়