ভ্রমণ

গ্রিক্সিট?

রাসেল পারভেজ : স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট পার করছে গ্রিস। গ্রিসের একার কারণে এই সংকট তৈরি হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউরোপের অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা ইউরোর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রিসের বোঝাপড়ার অভাব থেকে সংকটের জন্ম হয়েছে, যার আভাস ছয় মাস আগে থেকেই স্পষ্ট পাওয়া গেছে।

 

এই মুহূর্তে কী অবস্থায় আছে- সে কথা বলার পাশাপাশি গ্রিক্সিট কী ও কেন হতে পারে, তাও আলোচনা করার প্রয়াস থাকছে।

 

৩০ জুন ছিল গ্রিসের বেইল-আউটের শেষ দিন। বেইল-আউট হলো- অর্থনৈতিক ধস থেকে উত্তরণের জন্য কোনো দেশকে দেওয়া অর্থিক সহায়তা। বেইল-আউট ব্যবস্থায় পুরোনো হিসাব থাকলে নতুন অর্থসহায়তা নেওয়ার আগে সেই পুরোনো ঋণ পরিশোধ করার শর্ত থাকে, আবার তা না করেও নতুন ঋণ গ্রহণ করা যায়, যদি দাতারা চায়।

 

গ্রিসের বেলায় বেইল-আউটের নির্ধারিত দিন শেষ হওয়ায় অর্থসংকটে অন্য ঋণদাতার ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি দেশটি। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) ১.৬ বিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করার কথা ছিল গ্রিসের। কিন্তু অর্থের জোগান না থাকায়, তা করা সম্ভব হয়নি। এখন আইএমএফ থেকে নতুন ঋণ নিতে হলে গ্রিসকে অবশ্যই আগের ঋণ শোধ করতে হবে।

 

ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইউসিবি) গ্রিসে ইউরো সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বেইল-আউটের মেয়াদ না বাড়ায় এবং ঋণ গ্রহণে গ্রিস শর্ত না মানায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে করে ব্যাংকিং লেনদেন থমকে গেছে। সপ্তাহজুড়ে গ্রিসের ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যদিও সীমিত কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা এসেছে বুধবার। এটিএম ম্যাশিনগুলোর সামনে গ্রিকরা, বিদেশি পর্যটকরা ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় গ্রাহকদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে গ্রিক সরকার।

 

৫ জুলাই গ্রিসে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। বিদেশি দাতাদের দেওয়া শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে এই গণভোট। ‘হ্যাঁ, না’ ভোট দিয়ে রায় জানাবে গ্রিকরা। ধারণা করা হচ্ছে, এই গণভোটে বিজয়ী হবে ‘না-ভোট’। এর অর্থ- শর্ত মেনে ঋণ নেবে না প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাসের সরকার। যদি তাই হয়, তবে ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে গ্রিস। এই বেরিয়ে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে গ্রিক্সিট। গ্রিস ও এক্সিট মিলে শব্দটি তৈরি হয়েছে।

 

গ্রিক্সিট। শব্দটি একদিনে তৈরি হয়নি। গত পাঁচ বছর ধরে এর পটভূমি রচিত হয়েছে। ২০১১ সালে বামপন্থিদের উত্থানের পূর্বাভাস সূচনা করেছিল গ্রিক্সিটের। এরপর তা প্রসারিত হয়েছে।

 

ইউরোপে মার্ক্সবাদী সরকার সত্যিকার অর্থে নেই। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের সরকার বামঘরানার হলেও পুরোপুরি মার্ক্সবাদী নয়। পুঁজিবাদী সরকারের সঙ্গে ফরাসি সরকারের তেমন কোনো দ্বন্দ্বও নেই। কিন্তু গ্রিসের বর্তমান সরকার মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ম্যানডেট নিয়ে সরকারে এসেছে। ফলে ইউরোপের নব্য উদারবাদী সরকারগুলোর সঙ্গে অ্যালেক্সিস সিপরাসের সমাজতান্ত্রিক সরকারের নীতিগত ও আদর্শিক দূরত্ব অনেক। বিষয়টিকে মেনে নেননি এবং এখনো নিচ্ছেন না ইউরোপীয় নেতারা। পুঁজিবাদী ইউরোপে গোঁড়া সমাজতন্ত্রের উত্থান কোনো মতে সহ্য করবেন না তারা, এটিই স্বাভাবিক।

 

এখানেই শেষ নয়। ছাত্রজীবনে বামপন্থি নেতা ছিলেন সিপরাস। তার প্রচেষ্টায় বামসংগঠনগুলোর এক কাতারে আসার সুযোগ তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালে গ্রিসের সব বাম রাজনৈতিক দল একীভূত হয়ে তৈরি হয় সিরিজা পার্টি। এই পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন সিপরাস।

 

২০১৫ সালে জানুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সিরিজা পার্টি। ৩০০ আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন নিউ ডেমোক্রেসি পার্টিকে পেছনে ফেলে ১৪৯ আসনে জয় পায় এই দল। ছোট আরেকটি দলের সহযোগিতা নিয়ে সরকার গঠন করেন সিপরাস।

 

নির্বাচনী ইশতেহারে কয়েকটি বিষয়ে ওয়াদা করেন সিপরাস। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি না কমানো অন্যতম। কিন্তু বিদেশি দাতারা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি কমানোকে গুরুত্ব দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যেমন বয়স্ক ও বেকার ভাতা, উন্নয়ন ভর্তুকি কমাতে পরামর্শ দিয়েছে ইউসিবি। কিন্তু গ্রিক সরকার তা মানছে না। এই যে দোটানা অবস্থা, তার ভিত আগেই তৈরি হয়েছিল। সিরিজা সরকার বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে কল্যাণরাষ্ট্র তৈরির দিকে এগোতে চায়। ধনীদের ওপর কর বাড়াতে আগ্রহী তারা। বিষয়গুলো সংকট আরো কেন্দ্রীভূত করেছে।

 

এদিকে গ্রিসের সংকট মোকাবিলায় যে দেশটি বেশি কথা বলছে, সেটি হলো ফ্রান্স। বামঘরানার হওয়ায় ফ্রান্স থেকে কিছুটা সহানুভূতি পাচ্ছে গ্রিস। কিন্তু ইউরোপের রাজা বনে যাওয়া জার্মানি ইউরোনীতি থেকে একচুলও নড়তে রাজি নয়। ফলে অচলাবস্থা কাটছে না।

 

ইইউ ও গ্রিস যদি নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে গ্রিক্সিট ছাড়া গ্রিসের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। যদি গ্রিক্সিট হয়েই যায়, তবে উন্নত বিশ্বে পুঁজিবাদ হুমকির মুখে পড়বে। ইউরোজোন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা আরো জোরালো হবে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা-ই দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুলাই ২০১৫/রাসেল পারভেজ