হাবিবুর রহমান স্বপন : পতিত রাষ্ট্রপতি এবং স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিত এরশাদ সম্প্রতি জাতীয় সংসদের নারী সদস্যদের সম্পর্কে মন্তব্য করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। তিনি সংসদে বলেছেন, এ দেশে এখন ঘুষ ছাড়া সিপাহী এবং পিয়নের চাকরিও হয় না। নারী সংসদ সদস্যদের তিনি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করে বলেছেন, সংসদের নারী সদস্যরা ‘শো-পিস’। এরশাদ সরকারের সময় সংসদে ৩০ জন মহিলা সদস্যকে নিয়ে আশির দশকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ত্রিশ সেট অলঙ্কার’ শিরোনামে একটি সংখ্যা করেছিল। বাজারে তার বেশ কাটতি তখন লক্ষ্য করেছিলাম। তার সুনির্দিষ্ট কারণও ছিল। এরশাদের নারী বান্ধবীদের প্রসঙ্গ ছিল উক্ত প্রবন্ধে। তখন নির্বাচিত নারী সদস্যের সংখ্যা ছিল কম। বেশিরভাগই ছিলেন মনোনীত।আমাদের বর্তমান দশম জাতীয় সংসদের নেতা নারী। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলের নেতাও নারী, স্পিকারও নারী। বিরোধী দলের নেত্রী রওশন এরশাদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম স্ত্রী। বর্তমান নবম সংসদের নির্বাচিত এবং মনোনীত প্রায় অর্ধশত সংসদ সদস্য নারী। এর পরেও হঠাৎ করে এরশাদ নারী সদস্যদের ‘শো-পিস’ বলে মন্তব্য করলেন কেন? এর কারণ তিনিই ভালো বলতে পারবেন। মনে পড়ে এরশাদ সরকারের সময় নারী সংসদ সদস্যদের ‘ত্রিশ সেট অলঙ্কার’ বলে মন্তব্য করায় তখন সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পাঠক, আপনারাই এখন বিষয়টি নিজ মেধা দিয়ে বিচার করুন।আমি সাংবাদিকতা পেশায় রয়েছি দীর্ঘদিন। ফলে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পেশার প্রয়োজনেই কথা বলতে হয়। তাদের অনেক মন্তব্য শুনতে হয়। এভাবে অনেক কথাই কানে আসে। এরশাদ সম্পর্কে একজন স্কুল শিক্ষকের মন্তব্য সেদিন শুনলাম। তিনি বললেন, ‘এরশাদ এখন মৃতপ্রায় ঘোড়া’। একজন দর্জির মন্তব্য ‘ছাগলে কি না খায়, পাগলে কি না কয়’। হায়রে কপাল, শেষ পর্যন্ত ছাগল আর পাগলের সঙ্গে তুলনা!একেবারে পাগল বলা বোধ করি ঠিক হবে না। কারণ কিছু কথা তো যথার্থই বলেছেন এরশাদ। যেমন তিনি বলেছেন, এখন সিপাহী এবং পিয়নের চাকরিও ঘুষ ছাড়া হয় না। কথাটি বহুলাংশে যে ঠিক তার প্রমাণ তো সংসদ সদস্যগণ সংসদেই আলোচনা করেছেন। এ ছাড়াও প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে যে প্রচার প্রচারণা আমরা দেখছি তাতে এর সত্যতা মেলে। সম্প্রতি সংসদে ঠাকুরগাও-এর সংসদ সদস্য দাবিরুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশের কনস্টেবল পদে লোক নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এবং বেশ ক’জন সংসদ সদস্য। আরও বলা হয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে যাদের চাকরি দেয়া হয়েছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের অনুসারী ছাত্র সংগঠনের সদস্য। বিষয়টি তদন্তের দাবি উঠেছে।ক’দিন আগে নওগাঁ থেকে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমাকে ফোন করে বললেন, আপনি তো অনেক বিষয় নিয়ে লেখেন, দয়া করে গরিবদের পক্ষে শক্ত করে আবার কলম ধরেন।’ তিনি যা বললেন তার সারাংশ হলো, স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি চাকরি সর্বত্র নিয়োগে ঘুষ গুণতে হয়। এভাবে টাকাওয়ালারা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। তাতে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যরা চাকরি পাচ্ছে না। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা ঘুষ নিয়ে চাকরি দিচ্ছে। আর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা ম্যানেজিং কমিটিতে আছেন তাদের বেশিরভাগই দলীয় লোক। তাদের নিজেদের যোগ্যতা হচ্ছে দলবাজী। অভিভাবকদের ভোটে যারা নির্বাচিত হন তাদেরও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকার নিয়োগ বোর্ড অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ করুক সেটাই চায় জনগণ। অযোগ্য শিক্ষকরা যে শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে বহু শিক্ষিত বেকার বাধ্য হচ্ছে দালালের মাধ্যমে বিদেশ চলে যেতে। কেউ সফল হচ্ছে, কেউবা বাবা-মা’র সম্পদ বিক্রি করে ফতুর হচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ ঘাড়ে নিয়ে কেউবা দুষ্ট চক্রের প্রলোভনে পড়ে জঙ্গী দলে নাম লেখাচ্ছে। অপরাধীদের দলে যোগ দিয়ে অনেক মেধাবী যুবকের ভবিষ্যত নষ্ট হচ্ছে। কেউ আবার মাদকাসক্ত হয়ে অকালে জীবন হারাচ্ছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা এমনকি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদে চাকরি নিতে হলে ‘ডোনেশন’ দিতে হয়। এই ডোনেশন দেবার সামর্থ যার আছে সে হয়তো তৃতীয় বিভাগে বিএসসি অথবা এমএ পাস করেছেন। অথচ যিনি এসএসসি, এইচএসসিসহ অন্যান্য পরীক্ষায় উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে অথবা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি ডোনেশন না দিতে পারায় চাকরি পাচ্ছেন না। পাবনার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে মতোবিরোধ হয় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির। ম্যনেজিং কমিটি যোগ্যতম ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে চায়। কিন্তু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি স্বজনপ্রীতি করে অযোগ্য লোককে নিয়োগ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। উভয়ের দ্বন্দ্বের কারণে দেড় বছরেও প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য আছে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির কারণে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার খবর সংবাদপত্রে পড়ি। এসব নিয়োগ হয়ে থাকে স্থানীয়ভাবে। অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সিভিল সার্জন, পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের জেলায় দায়িত্বরত উপ-পরিচালক এবং জেলা প্রশাসন। এসব নিয়োগেও ঘুষ লেনদেনের খবর মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। নিয়োগকে কেন্দ্র করে সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও, ভাংচুর এমনকি মারপিটের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি জেলায়। জেলা প্রশাসনের অধীনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এবং তহশিলদার নিয়োগ হয়েছে প্রায় সবক’টি জেলায়। সেখানেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন জেলায় পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ হয়ে থাকে। টাকা ছাড়া যে চাকরি মেলে না এটি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। প্রতিটি কনস্টেবল পদের জন্য ঘুষ গুণতে হয় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। এর আগে সাব ইন্সপেক্টর পদের জন্য ঘুষ দেয়া-নেয়া নিয়ে অনেক খবর সংবাদপত্রেই পড়েছি। ঘুষ দাতা এবং গ্রহীতা দু’জনই সমান অপরাধী। হাদিসে বর্ণনা আছে ‘ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত’। এর পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশে ঘুষ লেন-দেন হচ্ছে! সমাজে অশান্তির কারণ এই ঘুষ। ঘুষের টাকা সমাজকে কলুষিত করছে। ঘুষ সমাজের স্থিতি বিনষ্ট করছে। ঘুষ সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করছে। অন্যের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে ঘুষ। অশান্তির বীজ রোপিত হচ্ছে ঘুষের কারণে। সুতরাং এরশাদ সত্য উচ্চারণ করেছেন। তবে এটাও ঠিক সামরিক সরকারের সময় থেকে ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তার ঘটে এ দেশে। তিনি নয় বছর দেশ শাসন করেছেন। তখনও দেখেছি ঘুষ লেন-দেন হয়েছে নানা কাজে। এমনকি রাজনীতিকদের অন্য দল থেকে ঘুষের বিনিময়ে নিজের দলে নেয়ার গল্পও শুনেছি। এখন এরশাদ ঘুষের বিরুদ্ধে সোচ্চার! বগুড়া থেকে একজন ছাত্র সেদিন ফোন করে বললেন, আমরা যারা গরিব কৃষকের সন্তান তাদের ভবিষ্যত কী? আমরা তো ঘুষ দিতে পারি না, তাই চাকরি পাই না বা হয় না। তাহলে আমরা কি মরে যাব? ছেলেটি বহু কষ্ট নিয়ে কথাটি বলেছে। কারণ তার বাবা প্রান্তিক চাষী। ওরা দুই ভাই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে কষ্ট করে এইচএসসি পাস করেছে। ছোট ভাই দশম শ্রেণিতে পড়ে। পিতা-পুত্র অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চলে। এর পর লেখাপড়ার খরচ। পুলিশের কনস্টেবল পদের জন্য বগুড়া পুলিশ লাইনে দাঁড়িয়েছিল রফিকুল। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছিল সে। লিখিত পরীক্ষাও ভালো হয়েছিল। এর পর একজন দালাল তাকে বলেছে, তোমার ফিগার ভালো, পরীক্ষাও ভালো দিয়েছ। আজকের মধ্যেই যদি তুমি ৫ লাখ টাকা দিতে পার তবে তোমার চাকরি হবে। রফিকুল টাকা দিতে পারেনি। তাই চাকরিও হয়নি। রফিকুল পড়বে সে সামর্থ তার দরিদ্র কৃষক পিতার নেই। তার ইচ্ছা সে একটি চাকরি পেলে ছোট ভাইকে পড়াবে। কারণ ছোট ভাই সফিকুল ক্লাসে সেকেন্ড হয়েছে। দেশে গরিব মানুষদের সন্তানদের চাকরির স্বাভাবিক সুযোগ না থাকায় তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ধার-কর্য করে কিংবা পিতার শেষ সম্বল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ যেমন বসত ভিটা বিক্রি করে, গরু-ছাগল, গাছ এমনকি ঘর বিক্রি করে টাকা তুলে দিচ্ছে দালালের হাতে। ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে লাশ হয়ে সমুদ্রে অথবা বিদেশে জঙ্গলের মধ্যে গণকবরে তার স্থান হচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮-এর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন প্রতিটি পরিবার থেকে কমপক্ষে একজনকে চাকরি দেয়া হবে। নির্বাচনের পর যত ব্যক্তিকে চাকরি দেয়া হয়েছে সেটি যদি হিসাব করা হয় তা হলে সংখ্যাটি নিতান্ত কম হবে না। কিন্তু এই চাকরি সঠিকভাবে বন্টন হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা ছিল নির্বাচনের সময়, তার সঠিক প্রয়োগ হলে চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকতো না। পুলিশ, বর্ডার গার্ড, সেনাবাহিনী এবং ব্যাংকে প্রচুর লোক নিয়োগ হয়েছে। অন্যান্য বিভাগেও কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাকরি হয়েছে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই জানতে পারলাম বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে এখন প্রায় ৪ লাখ পদ শূন্য। এসব পদে লোক নিয়োগ জরুরি। শূন্য পদসমূহ পূরণ হলে বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। বেকারত্ব হ্রাস পাবে। এ ছাড়া সরকার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে সচেষ্ট হয় তা হলে সর্বত্র মঙ্গল। সারা বিশ্বে এখন লোক সংকট। অনেক দেশে নির্মাণ ও কৃষি শ্রমিক দরকার। গ্রীণল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বহু দেশে জনবল সংকট চলছে। অস্ট্রেলিয়া, সৌদী আরব, রাশিয়াসহ আরব বিশ্বের বহু দেশে কৃষি শ্রমিক দরকার। আমাদের জনশক্তি রপ্তানী ব্যুরোকে আরও কার্যকরী করা দরকার। জনশক্তিকে যথার্থ শক্তিতে রূপান্তর করতে হলে কারিগরি শিক্ষার প্রসার দরকার। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি ইন্সস্টিটিউট করার সরকারের যে পরিকল্পনা ছিল তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।আমরা আমাদের জনশক্তি রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করতে পারবো। যার দৃষ্টান্ত আমাদের বর্তমান অর্থনীতি। রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে। একই সঙ্গে চাকরি প্রদানে স্বচ্ছতা আনতে হবে। অন্যথায় জনদুর্ভোগ বাড়বে। সেইসঙ্গে বাড়বে অশান্তি। যা কারোরই কাম্য নয়।লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়