ভ্রমণ

মাথায় মারণাস্ত্র, হৃদয়ে দেশপ্রেম || তাপস রায়

এমন মৃত্যু আরেকটি মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। দু’জনের জন্যই সেদিন মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। মঞ্চের সবক’টি আলো ছিল তাদের দিকে। তাদের কথা শোনার অপেক্ষায় ছিলেন শ্রোতাবৃন্দ। সেই অপেক্ষা গড়াল আক্ষেপে! কারণ জীবনের একটি দুঃখময় ঘটনার সাক্ষী হয়ে তারা দেখলেন, বক্তা ভারসাম্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়ছেন মঞ্চে এবং মুহূর্তেই সাঙ্গ হলো অগ্যস্ত যাত্রা। গত বছর ৩০ নভেম্বর চিত্রশিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীর মৃত্যুর সঙ্গে গতকাল বরেণ্য বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুর এ এক অদ্ভুত মিল! দুজনেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুবরণ করেন।মৃত্যু বেদনাদায়ক, বড় মানুষের মৃত্যু অধিকতর বেদনাদায়ক। জাতির জন্য এমন মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই  দুর্ভাগ্যজনক ক্ষতির কারণ। অধিকাংশ সময় সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুজনিত ক্ষতি তাই অপূরণীয়। তার মৃত্যুতে ভারতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোক প্রকাশ করে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ‘প্রতিরক্ষা গবেষণায় তার অবদান দেশকে সমৃদ্ধ করছে’ মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, পথ প্রদর্শক ছিলেন আবুল কালাম। শোক প্রকাশ করেছেন দেশটির উপরাষ্ট্রপতিও। সেই শোক স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও স্পর্শ করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি শোক প্রকাশ করেছেন। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র বইছে শোকের ভারি বাতাস। ফেসবুকে অনেকে তাকে স্মরণ করে জীবদ্দশায় তারই জ্ঞানবাক্য পোস্ট করছেন।সেগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল এই কথাটিতে : ‘আমি বিশ্বাস করি, একশ কিলোমিটারের উপরে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না।’ (উৎস :  জুলাই ২২, ২০০৯ তারিখের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)। পাঠক, তিনি এমন এক সময় এ মন্তব্য করেছিলেন যখন দেশে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, এ শুধু ‘কথার কথা’ নয়, এটা ছিল তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কথা তিনি ‘উইংস অব ফায়ার`-এ লিখেও গেছেন। বইটিতে তিনি আন্তঃনদী সংযোগের কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ সব নদীর গতিপথ বদল করে শুধুমাত্র ভারতে পানি প্রবাহিত করার পরিকল্পনা ছিল তার। এর ফলে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো পানিশূন্য মরুভূমিতে পরিণত হবে এই সত্য এড়িয়ে তিনি এটা করতে চেয়েছিলেন!আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চরম ক্ষতিকর এবং খোদ ভারতেই এটি সমালোচিত হয়। তাছাড়া ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবী এর বিরোধীতা করেছেন। অরুন্ধতী রায় সে সময় আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রতিভা পাতিল, মনোমহন সিং-এর মতো ব্যক্তিত্বও এই প্রকল্পের পক্ষে ছিলেন না। ফলে বেঁচে গেছে বাংলাদেশ। অথচ রাষ্ট্রপতি হবার পর এপিজে আবদুল কালাম নিজের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। প্রকল্পটিকে জনপ্রিয় করতে একের পর এক রাজ্য তিনি ভ্রমণ করেছেন। একাধিক সেমিনারে এর সুফল তুলে ধরে বক্তৃতা করেছেন। অথচ এর প্রভাবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হবে এ প্রসঙ্গে একবারও বলেননি। অর্থাৎ তার একাগ্র আনুগত্য ছিল কেবলমাত্র জন্মভূমির প্রতি। যেখানে, যে মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর সেই মাটির প্রতি। তাছাড়া গুজরাটে সংঘটিত ২০০২ সালের দাঙ্গার বিরুদ্ধেও তাকে কখনও সরব হতে দেখা যায়নি; এমনকি দেশটির তৃতীয় মুসলিম রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই তিনি নেননি। এগুলো ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার’-এই প্রবাদবাক্য স্মরণ করিয়ে দেয়। তাতে অবশ্য প্রদীপের কৃতিত্ব ম্লান হয় না। এপিজে আবদুল কালাম ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ ছাড়াও ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। দেশপ্রেম এবং কাজের স্বীকৃতি তিনি জীবদ্দশাতেই পেয়ে গেছেন। ২০০২ সালে বিজেপি সরকারের আমলে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। শিক্ষাজগতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন প্রয়াত এই রাষ্ট্রপতি। গত বছর ঢাকা সফরে এসে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) ১১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি তার স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে বলেন : ‘... প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার এক স্কুলশিক্ষক ছিলেন শিব সুব্রমনিয়াম আয়ার, যাকে দেখলে ‘জ্ঞানের বিশুদ্ধতা’ কথাটার মানে বোঝা যায়। সেই শিক্ষক একদিন একটি পাখির ছবি এঁকেছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে শিখিয়েছিলেন পাখি কীভাবে আকাশে ওড়ে। বলেছিলেন, কালাম কখনো কি উড়তে পারবে এই পাখির মতো? সেই থেকে আমার আকাশে ওড়ার স্বপ্নের শুরু।’কিন্তু তার এই স্বপ্নপূরণ সহজ ছিল না। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। বাবা ছিলেন নৌকার মাঝি। মা গৃহিণী। ফলে খুব অল্প বয়সেই তাকে জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন পেশায় কাজ করতে হয়েছে। তিনি নিজেই বলেছেন সেই দিনগুলোর কথা : ‘আমি প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে গণিত শিক্ষকের কাছে যেতাম। বছরে মাত্র পাঁচজন ছাত্রকে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন। আমার মা আশিয়াম্মা ঘুম থেকে উঠতেন আমারও আগে। তিনি আমাকে গোসল করিয়ে, তৈরি করে তারপর পড়তে পাঠাতেন। পড়া শেষে সাড়ে পাঁচটার দিকে বাড়ি ফিরতাম। তারপর তিন কিলোমিটার দূরের রেলস্টেশনে যেতাম খবরের কাগজ আনতে। যুদ্ধের সময় বলে স্টেশনে ট্রেন থামত না, চলন্ত ট্রেন থেকে খবরের কাগজের বান্ডিল ছুড়ে ফেলা হত প্ল্যাটফর্মে। আমার কাজ ছিল সেই ছুড়ে দেওয়া কাগজের বান্ডিল সারা শহরে ফেরি করা, সবার আগে গ্রাহকের হাতে কাগজ পৌঁছে দেওয়া। কাগজ বিক্রি শেষে সকাল আটটায় ঘরে ফিরলে মা নাশতা খেতে দিতেন। অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই দিতেন, কারণ আমি একই সঙ্গে পড়া আর কাজ করতাম। সন্ধ্যাবেলা স্কুল শেষ করে আবার শহরে যেতাম লোকজনের কাছ থেকে বকেয়া আদায় করতে। সেই বয়সে আমার দিন কাটত শহরময় হেঁটে, দৌড়ে আর পড়াশোনা করে।’জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই তিনি স্বপ্নপূরণের পথে হেঁটেছেন। এবং আজ আমরা জানি তার সেই চেষ্টা সফলও হয়েছে। বিমান প্রকৌশলে পড়াশোনা করে ভারতের প্রথম মহাকাশযান তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন তিনি। ওই মহাকাশযান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ‘রোহিনী’ উৎক্ষেপণ করে। ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-২ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার হাত ধরেই দেশটি আজ পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং তিনি খ্যাত হয়েছেন ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে। ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার এই বিজ্ঞানী ৮৪ বছর বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে, রেখে গেলেন একটি প্রশ্ন। যে মিসাইলম্যানের জন্য ভারতীয়রা আজ ৭ দিনের শোক ঘোষণা করেছে, সেই মিসাইলম্যানের তৈরি মিসাইল ভবিষ্যতে কি আরো শোকের কারণ হবে না?রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়