ভ্রমণ

প্রাথমিক শিক্ষা ও বাস্তবতা

শাহনাজ শিল্পী : বাংলা ভাষাভাষীদের প্রাচীনতম প্রবাদ হচ্ছে ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ কিংবা ‘শিক্ষা জাতির বিবেক’। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় স্বভাবতই ভাবার সময় এসেছে, ‘শিক্ষা’ আর ‘শিক্ষক’ শব্দ দুটির মানে আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।

 

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা একদিন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল। বাবা-মায়ের পরেই তৃতীয় ক্ষেত্র হিসেবে প্রথম স্থান দখল করে নিতেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

 

প্রাথমিক স্তরের এই শিক্ষাকে বাস্তবমুখী, কার্যকরী ও নিশ্চিত করার জন্য সরকারের মাঠ পর্যায় থেকে সর্ব্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই রয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। সকল পদক্ষেপের একটাই উদ্দেশ্য, প্রাথমিক স্তরের নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো যাতে প্রাথমিক স্তর শেষে শিশুরা অর্জন করতে পারে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতাটা একেবারেই ভিন্ন বলে মনে হয় আমার কাছে। কারণ এই বিভাগকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ বা দেখার সুযোগ আমার খানিকটা হয়েছে।

 

একজন শিক্ষককে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। সরকার থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য উপকরণ-সরবরাহ বাবদ খরচ করা হয় কোটি কোটি টাকা কিন্তু সাফল্য বলতে উল্লেখ করার মতো বিশেষ কিছু আছে কি?

 

শতভাগ ভর্তি ও পাস আর কোয়ালিটি বোধ করি কখনোই এক কথা নয়, উপরোক্ত সাধারণ জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, নৈতিকতা যতটা শেখার কথা বা উচিত তার কাছাকাছিও কি আমাদের শিশুরা পাচ্ছে? প্রাথমিক স্তরের পর একটি শিশুর সামর্থ্য নেই বা থাকলেও মাধ্যমিক স্তরে পড়ার সমৃদ্ধ কারিকুলাম আমাদের নেই যে, সেখান থেকে জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনার যাবতীয় রসদ নিতে পারবে।

 

আজকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুধু করে উচ্চ পর্যায়ের যত আমলা, কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছেন, তাদের আনেকেরই হাতেখড়ি তাদের অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত মায়ের হাতে, যাদের নেই তেমন কোনো সার্টিফিকেট। ওই মায়েদের যদি সন্তানকে শেখাতে কোনো প্রশিক্ষণ না লাগে, তাহলে আমাদের শিক্ষকদের এত প্রশিক্ষণ কেন লাগবে। আমি আসলে প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করছি না। অবশ্যই প্রশিক্ষণ একজন মানুষকে সমৃদ্ধ করে। তবে নিজেকে নিজে সমৃদ্ধ করতে না চাইলে কারো পক্ষে তাকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। আমাদের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের অবস্থাটা আজ খানিকটা তেমনই। এর মধ্যে যে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক নেই, তা কিন্তু নয়। তবে উল্লেখ করার মতো সংখ্যা সত্যিই কম।

 

একজন শিক্ষক ক্লাস নেওয়ার পরে যদি শ্রেণিকক্ষের বোর্ড এবং ছাত্রছাত্রীদের খাতা ছাড়া, মনে কোনো দাগ না কাটে, তাহলে সেই ক্লাসগুলোকে কি আর বিশেষ মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে। সরকারের এমন কিছু বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ আছে, যা দিয়ে গাধা পিটিয়েও মানুষ করা সম্ভব কিন্তু আমাদের শিশুরা তবুও সেখান থেকে কিছু পাচ্ছে না। এটা সত্যিই কষ্টের হবে, যদি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেও সচল না হন।

 

তাই আমাদের মূল্যবোধ আর বিবেককে জাগ্রত করেই প্রাথমিক স্তরের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। কিছুটা হলেও একটি শিক্ষিত প্রজন্ম রেখে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্ব স্ব অবস্থান থেকে অবদান রেখে যাওয়া যেতে পারে।

 

লেখক : শিক্ষাকর্মী

 রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জুলাই ২০১৫/কমল কর্মকার