ভ্রমণ

মোরাভিয়ান গির্জা ও এক মানবতাবাদী শহরের গল্প

অহ নওরোজ :  মনে করুন আপনি একটি শহরে বেড়াতে গেলেন এবং গিয়ে জানলেন সেই শহরটি তৈরি হয়েছে একটি গির্জাকে কেন্দ্র করে। তাহলে নিশ্চয়ই অবাক হবেন এবং আপনার অবশ্যই ইচ্ছা জাগবে গির্জাটি দেখার। তবে কল্পনায় নয়, দুনিয়ায় বাস্তবে এমন অনেক কিছুই ঘটছে যেটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। বলছি ডেনমার্কের দক্ষিণ জটল্যান্ডে অবস্থিত ক্রিস্টিয়ানফেল্ড শহরের মোরাভিয়ান গির্জার কথা। চলতি বছরের গেল জুলাইয়ে পরিবেশগত অবস্থানসহ গির্জার এবং শহরের বিশেষ কিছু ভবনের স্থাপত্যকলার কারণে পুরো শহরটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি পেয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই গির্জার আদ্যোপান্ত।

মোরাভিয়ান গির্জাটি অবস্থিত ক্রিস্টিয়ানসফেল্ড  নামের ছোট্ট  শহরে। এই নামের বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘খ্রিষ্টানদের অঞ্চল’। নাম থেকেই বোঝা যায় এই গির্জার প্রভাব এই শহরে কতটুকু । ১৭৭৩ সালের দিকে এই শহরের  ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ড্যানিশ রাজা সপ্তম ক্রিস্টিয়ান। তবে শহরে অন্য কোনো কিছু নির্মাণের আগে গির্জাটির ডিজাইন করা হয়। এবং এটিকে নির্মাণ করা হয়। এরপর শহরের অন্যসব বাড়ি, রাস্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো গির্জার নির্মাণশৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়। এই গির্জাকে ‘মোরাভিয়ান চার্চ’ বলা হয় কারণ ওই সময় এই অঞ্চল ছিল একটি মোরাভিয়ান সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল।

  মোরাভিয়ান সম্প্রদায় হলো যিশুখ্রিষ্টের অনুসারী একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। তবে সাধারণ খ্রিষ্টানদের চেয়ে এদের চাল-চলনসহ মূলত ধর্মীয় আচার পালনে কিছুটা পার্থক্য  রয়েছে। যাই হোক, ১৮০০ সালের শুরুর দিকে এই শহর পুরোপুরি নির্মিত হয়ে যায়। এবং এরপরই দেখা যায় এই  শহরে মোরাভিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। লক্ষ্য মোরাভিয়ান চার্চ। তবে অন্য ধর্মের দর্শনার্থীরা যে ভিড় করেন না, এমনটি নয়। প্রতিদিনই প্রচুর দর্শনার্থী আসতে শুরু করলেন এই শহরে। ছোট্ট শহরের প্রত্যেকটি ভবনই তার দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের জন্য দর্শনার্থীদের নজর কাঁড়ে আর সবশেষে দর্শনার্থীদের কেন্দ্রস্থল তো সেই  গির্জা। খানিকটা ‘রথ দেখা কলা বেচা’র মতো। প্রার্থনাও হলো আবার বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু দেখাও হলো।

  চার্চের আশেপাশের অন্যসব ভবনগুলোর নির্মাণকৌশল একদম একই। শুধু এর চেহারা কিছুটা ভিন্ন। হয়তো দেখা যাবে অধিকাংশ ভবনের ছাদ গির্জার মতো কালচে না, একেবারে টকটকে লাল কিংবা লালচে। আর গম্বুজের বদলে দুই একটা উঁচু মিনারসদৃশ কিছু দেখা যেতে পারে। এগুলোকে ডাচ ভাষায় হাম্বুল বলে।   প্রত্যেক ভবনেই তার দুই একটা হাম্বুল দেখা যায়। এ ছাড়া ছাদের মাঝখানে সাদা রঙের ত্রিকোণ জানালা বেশ সুন্দর। প্রত্যেক ভবনেই একটি করে এমন জানালা আছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো গির্জাসহ প্রত্যেকটি ভবনই ডুপ্লেক্স। অর্থাৎ দোতালা। তাই আকাশপথে যাওয়ার সময় এদের লালচে টালির ছাদগুলো একই সমতলে দারুণ দেখায়। আর এই ভবনগুলোই এখনো পর্যন্ত রাজা সপ্তম ক্রিস্টিয়ানের আদর্শ  এবং রাজনীতির দর্শন বহন করছে। কীভাবে বলছি? একটু লক্ষ্য করুন, সব বাড়ি এক ঢঙে,আদলে এমনকি ডুপ্লেক্স কেন বানানো হলো? এটি এজন্য বানানো হলো যাতে একজন নাগরিক নিজেকে আরকেজন থেকে ছোট না মনে করে কিংবা কেউ তার অহংকার প্রকাশ করার সুযোগ না পায়। ভবনগুলোর বিশেষত্ব এখানেই যে, এগুলো একটি মানবতাবাদী শহর তৈরির আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা প্রকাশ করে। রাজা সপ্তম ক্রিস্টিয়ান চেয়েছিলেন একটি মানবতাবাদী শহর তৈরি করতে, যেখানে সাম্যবাদকে কেন্দ্র করে সবার মেজাজ-মনন গড়ে উঠবে। তাই এখানে সমস্যা নিস্পত্তির জন্য এবং কৃষিকাজের বাজেটের জন্য আলাদা আলাদা ভবন তৈরি করেছিলেন । এমনকি বিধবাদের যাতে হেয় না করা হয়, সে কারণে তাদের জন্য আলাদা ভবন তৈরি করা হয়, যেখানে তাদের কর্মসংস্থানের কিছু ব্যবস্থা থাকত। সেই ২০০ বছর আগের দালানগুলো আজো তেমনিভাবে আছে। হয়তো বৃষ্টিবাদল, ঝড়ঝাপটায় কিছু রঙ চটে গেছে কিন্তু এই শহরের ভবনগুলো বিশেষ করে এই চার্চ আজো এক জনবসতির ইতিহাস আমাদের সামনে আরো রঙিন করে তোলে।

  তৈরির সময় এটি ছিল জার্মানদের অধীনে। এরপর ১৯২০ সালের পর ডেনমার্ক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরে এটি ডেনমার্কের অধীনে চলে যায়। ১৯৭০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত শহরটি ডেনমার্কের পৌরসভা হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এটিকে  মিউনিসিপ্যাল সিটি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ডেনমার্ক সরকার। আগের মতো এই শহরে  প্রচুর মোরাভিয়ান সম্প্রদায়ের যিশু-অনুসারীরা বাস না করলেও আজ পর্যন্ত গির্জাটি সচল আছে। প্রভাবশালী একজন মোরাভিয়ান এটি নিয়ন্ত্রণ করেন। ঠিক ২০০ বছর আগের রীতিতে এখানে ধর্মীয় আচার পালন করা হয়।আজ শহরটি পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পরপরই এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় এত পরিমাণে বেড়েছে, যেটি চোখে পড়ার মতো। তাই দেরি না করে দেখে আসুন সময়ের সাক্ষী এই গির্জা।

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/রাসেল পারভেজ