ভ্রমণ

‌‌‌বিশ্ব ডাক দিবস ও আজকের প্রেক্ষাপট

দিলারা হোসেন : ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল টেলিফোনে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই যুগে ডাক বিভাগের গুরুত্ব যে অনেক কমে এসেছে তা বলাই বাহুল্য। তারপরও সামাজিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা বাণিজ্যে ডাক ব্যবস্থা এখনও অপরিহার্য।

 

আজ ৯ অক্টোবর। প্রতি বৎসর এদিনে ‌‌‌বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়। ইউরোপের ২২টি দেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের এদিনে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে গঠিত হয় ‘জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন’। এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বের প্রতিটি দেশের মধ্যে ডাক আদান-প্রদানকে অধিকতর সহজ ও সমৃদ্ধশালী করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজনীন পারস্পরিক যোগাযোগকে সুসংহত করা।

 

এক সময় এ জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন বা ইউপিইউ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৬তম অধিবেশনে প্রতি বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে জার্মানীর হামবুর্গে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ডাক ইউনিয়নের ১৯তম অধিবেশনে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবসের নাম বদলে হয় বিশ্ব ডাক দিবস । বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ওই সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই থেকে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

 

ডাক ব্যবস্থা সৃষ্টিরকালে ডাক বিভাগের মূল কাজ ছিল ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, সরকারি চিঠিপত্র গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি করা। পরবর্তীতে ডাক বিভাগের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয় মানি অর্ডারসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম। দেশব্যাপী সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির আছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। সে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ২০ ডিসেম্বর বর্তমান ‘ডাক ভবনে’ বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।

 

একুশ শতকের সূচনালগ্নে সারা বিশ্বের ডাকব্যবস্থা বিস্ময়কর সাফল্যের পর ই-মেইলসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে দ্রুত যোগাযোগের নতুন দিগন্ত। আমাদের দেশের ডাক ও গ্রামীণ ডাক-ব্যবস্থার তেমন, উন্নতি হয়নি। পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অবিভাগীয় ডাকঘর, ডাককর্মী এবং ডাকসার্ভিসের অবস্থা শ্রীহীন। দৈনন্দিন কর্মচঞ্চল জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ, পরাজিত এই বিভাগটির শম্বুকগতিতে পরিবর্তন প্রত্যাশিত নয়।

 

পোস্টমাস্টার, পিয়ন ও রানার এই তিন অপরিহার্য ডাকঘর কর্মীর পেশাগত জীবনেও লাগেনি আধুনিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির স্পর্শ। পেশা যোগ্যতাহীনতার কারণে চাকরির অনিশ্চয়তা, ন্যূনতম বেতন; তাদের ঠেসে রেখেছে এক হতাশার মাঝে।

 

সরকারি ডাকসেবা সময়োপযোগী করার লক্ষ্য নিয়ে ২০০০ সালে ই-পোস্ট সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। সম্ভাবনাময় সার্ভিসটি দীর্ঘ ১২ বছর পরও খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলছে- প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল সঙ্কটের কারণে। সারাদেশে ডাকঘর বা পোস্ট অফিস আছে ৯ হাজার ৮৮৯ টি, এর মধ্যে জেনারেল পোস্ট অফিস চারটি। জেলা শহরগুলো মিলিয়ে ৬৬টি। এরপর উপজেলা, গ্রামে রয়েছে ৮২০০টি এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ডাকঘর।

 

বর্তমানে অ্যাসিস্ট্যান্ট পোস্টমাস্টার, পরিদর্শক, অপারেটর, মেইল অপারেটর ও রানারসহ সারাদেশে ডাক বিভাগে কর্মরত লোকবল রয়েছে ১৭ হাজার ৯১৩ জন। পূর্ণাঙ্গ বেতনস্কেলভুক্ত ও বেতন স্কেল ছাড়া ৪১ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকেন। এতো বড় ও সম্ভাবনাময় এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রযুক্তি নির্ভর কর্মকাণ্ডে পরিচালিত করতে পারলে সাধারণ মানুষ স্বল্প খরচে অনেক বেশি সেবা গ্রহণের সুযোগ পেত।

 

কালের বিবর্তনে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন তথা আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভব হওয়ায় এখন আর প্রিয়জনের কোন খবরের জন্য ডাক পিয়নের পথ চেয়ে থাকতে হয় না ।

 

প্রিয়জন পৃথিবীর যে কোন দেশে থাকুক না কেন মোবাইল এবং ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যে তার সংবাদ নেওয়ার পাশাপাশি তার সঙ্গে যে কোন চিঠিপত্র আদান প্রদান করা যায়। আর তাদের সঙ্গে টাকা পয়সা লেনদেন করতেও এখন আর পোস্ট অফিস বা ডাকপিয়নের প্রয়োজন হয় না ।

 

ঘরে বসেই অনলাইন, বিকাশ, এম ক্যাশ, মুবি ক্যাশসহ যাবতীয় মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা পয়সা দ্রুত লেনদেন করা যায় বলে মানুষের কাছে এখন আর ডাক পিয়নের কোন কদর নেই।

 

পাশাপাশি একই কারণে মানুষ এখন আর ডাক বাক্সে বা পোস্ট অফিসে গিয়ে আর চিঠি পোস্ট করে না। কেবল কোন চাকরি বা সরকারি অফিসের কিছু চিঠিপত্র বা অন্য কোন জরুরি ডকুমেন্টস সরাসরি পোস্ট অফিসে গিয়ে অথবা ডাক বাক্সের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। ফলে এ পরিস্থিতিতে ডাক বাক্সের গুরুত্ব একদম কমে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও আর ডাক বাক্সগুলোর যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ হয় না ।

 

এমনকি ডাকপিয়নও আর আগের মত ডাকবাক্সের খোঁজ খবর রাখেন না। ডাক বাক্সের রং এখন আর তুলির আচড় লাগে না , নেই তালাও। চলার পথে কখন ও কোথাও ২/৩ টি ডাকবাক্স চোখে পরলেও সেটা খুবই জরাজীর্ণ অথবা ব্যবহারের অনুপযোগী।

 

‘রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?’

 

কবি সুকান্ত এই প্রশ্নের মাধ্যমে সরকারের এই দুস্থ, সৎ ও পরিশ্রমী কর্মচারীদের জীবন থেকে দুঃখের কাল নতুন যুগে, সম্ভবত স্বাধীনতার পর কেটে যাবে বলে আশা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর এই সৎ ও পরিশ্রমী রানারদের চাকরির সুযোগ-সুবিধার তেমন কোন তুলনামূলক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। সাধারণ মানুষের উৎপাদন ও আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জীবনের মৌলিক প্রয়োজনসমূহের লভ্যতাও বেড়েছে, কিন্তু অন্য শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের আপেক্ষিকতায় ওপরে উঠে যায়নি। ডাক বিভাগের চাকরির মই ধরে রানারদের উপর উঠে যাওয়ার কোন ঘটনাও দেখা যায়নি। ডাক বিভাগের কাঠামোয় তার অবকাশও সৃষ্টি হয়নি।

 

বর্তমানে দেশের ডাক বিভাগে অনুমোদিত রানার পদের সংখ্যা ১৫৪৯টি। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ডাক বিভাগ স্থানীয় পর্যায়ে রানার পদবির লোকবল নিয়োগ করত। সরকারের কর্মচারীদের শ্রেণি বিভাগের হিসেবে রানার পদটি চতুর্থ শ্রেণি বা নিম্নতম পদের। দেশে রেল, বিমান, নৌ ও সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃতি ও আধুনিকায়ন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসারণের ফলে আগের দিনের রানারের কাজের পরিধি ও প্রয়োজন উভয়ই কমে গেছে। সুকান্ত যে, ‘রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে’-এর কথা বলেছেন, তা এখন রানারের পদক্রমার বিশেষণ হিসেবে প্রায় হারিয়ে গেছে।

 

ডাক ব্যবস্থার সেই রানার আর পিয়ন বাহিত বোঝা টানার দিন এভাবেই হয়ত শেষ হয়ে যাবে। আগের দিনের খবরের বোঝা দূরে সরিয়ে রানার এবং তার সহকর্মীদের যুগ বিবর্তনের আলোকে নতুনতর কার্যক্রম ও দায়িত্বের আলোকে সুকান্তের কথা মনে রাখতে হবে : ‘সময় হয়েছে নতুন খবর আনার’। এই নতুন খবরের প্রত্যাশায় কবির আহ্বানের অনুরণন করে ডাক বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের বিস্তৃত পটে বলতে চাই - ‘শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ ভীরুতা পিছনে ফেলে- পৌঁছে দাও এ নতুন খবর, অগ্রগতির মেলে।’

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৫/দিলারা/শাহ মতিন টিপু