ভ্রমণ

এশিয়ায় অধরা সাহিত্যে নোবেল

মুম রহমান : পাঠক, আপনার উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই শুরুতে ছোট্ট একটা কুইজ দিচ্ছি; দেখুন তো এই নামগুলো পরিচিত লাগে কিনা – সেলমা লাগেরল্যাফ, কার্ল গুস্তাভ ভেরনের ফন হাইডেনস্টাম, কার্ল ফ্রিদরিখ গেওর্গ স্পিত্তেলের, এরিক আক্সল কার্লফেলৎদ, পের ফাবিয়ান লাগেরকিস, আইভিণ্ড জনসন, হ্যারি এডমুণ্ড মার্টিনসন। চিনতে পারছেন না?

 

ইতিহাস ক’জনকে মনে রাখে তা আরেকটু ঝালাই করার আশাতেই এই নাম ক’টি উল্লেখ করা। এরা সবাই সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী সুইডিশ লেখক। এ কথা তো জানাই, সুইডিশ নাগরিক আলফ্রেড নোবেল তার ডিনামাইট ফাটানো টাকার বৃহদংশ দিয়ে তার নামে নোবেল পুরস্কারের উইল করে গিয়েছিলেন। সেই উইল অনুযায়ীই তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারের প্রণয়ন করা হয়।

 

নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষের সীমানায় এসে এ পুরস্কারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কেননা, এই ১০০ বছরে তার স্বদেশে ৭টি পুরস্কার গেলেও সমগ্র এশিয়াতে ৭টি পুরস্কার আসেনি এবং তার চেয়েও বড় কথা তার দেশের যে সব লেখক পুরস্কার পেয়েছেন তার চেয়ে বহুমাত্রায় নামী-দামী [সর্ব অর্থেই] লেখকরা এ পুরস্কার থেকে বঞ্চিতই হয়েছেন। টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, মার্ক টোয়েন, লু স্যুন, ইবসেন, স্ট্রিণ্ডবার্গের মতো লেখকরা নোবেল পুরস্কার না পেলে তাদের গৌরব কমে না, বরং নোবেল পুরস্কারেরই মানহানী হয়। শুরু থেকেই নিরপেক্ষতার প্রশ্নে স্বচ্ছতা দেখাতে পারেনি নোবেল কমিটি। নোবেল পুরস্কারের শুরু থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথম ৬০ বছরের পুরস্কারের মধ্যে ৩১টি পুরস্কার পেয়েছে স্ক্যাণ্ডিনেভীয় অর্থাৎ নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কের লেখকরা, বাকী ২৮টি পুরস্কার গেছে ইউরোপ ও আমেরিকার লেখকদের কাছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি। এশিয়ার কোন লেখকের পক্ষে এই প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। এরও ২০ বছর পরে [১৯৩৩ সালে] রাশিয়ার লেখক ইভান বুনিন নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৪৫ সালে লাতিন আমেরিকায় প্রথম নোবেল পুরস্কার পান গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল।

 

পরবর্তী সময়েও সাহিত্যে এশিয়া, রাশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় নোবেল পুরস্কারের হার অত্যন্ত কম। শুধু ইউরোপ একাই সাহিত্যক্ষেত্রে যতগুলো নোবেল পুরস্কার পেয়েছে সারা বিশ্বের লেখককুল সমবেতভাবেও তার অর্ধেক পুরস্কারও পায়নি। স্বদেশে এবং ইউরোপে এই পুরস্কার সীমাবদ্ধ রাখার আগ্রহ কখনো অতিমাত্রাতেই ছিলো। সুইডিশ লেখক এরিক আক্সল কার্লফেলদকে ১৯১৮ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। অথচ তার মৃত্যুর পর ১৯৩১ সালে তাকে এই পুরস্কারটি আবার কেন দেয়া হয়েছিলো তার উত্তর আজও কেউ জানে না। বিশদ আলোচনায় যাওয়ার আগেই এ কথা বলে নেয়া ভালো, পৃথিবীর আর সব পুরস্কারের মতো নোবেল পুরস্কারও একটি পুরস্কারই, তার মূল্যমান যতো বেশিই হোক না কেন সাহিত্যে বিচারে এ পুরস্কার একমাত্র নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড নয়। নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষের হুজুগে উল্লাসে তাবত বিশ্বের লেখকদের সচেতনভাবেই মনে রাখা উচিত নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি বিশ্ব রাজনীতির বাইরের কোন ঘটনা নয়। এর সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ রাশিয়ার সাহিত্য এবং নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে তার সম্পর্ক।

 

এক সময়ের অখণ্ড রাশিয়া দুই মহাদেশ ইউরোপ ও এশিয়ায় সীমানা গেড়েছিলো। সমাজতান্ত্রিক এই বৃহৎশক্তি তার ক্রোড়ে বহু বিখ্যাত লেখকের জন্ম দিয়েছে। এক নিঃশ্বাসে আলেকজাণ্ডার পুশকিন থেকে শুরু করে শেখভ, তুর্গিনেভ, ম্যাক্মিম গোর্কি, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি প্রমুখের নাম উচ্চারণ করা যায়। নিঃসন্দেহে কালের কষ্টিপাথরে এরা কালজয়ী লেখক হিসেবে টিকে আছেন, থাকবেনও ভাবা যায়। অথচ নোবেল পুরস্কার এদের কাউকে সম্মানিত করেনি। রাশিয়ার যে সব লেখক এ পুরস্কার পেয়েছেন কম বেশি তাদের সবাই রাজনৈতিক কারণেই এ পুরস্কার পেয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। ইভান বুনিন, বোরিস পাস্তেরনায়েক, মিখাইল শলোকভ, আলেক্সজান্দার শোলানিৎসি, যোশেফ ব্রডস্কি – নোবেল বিজয়ী এই ক’জন রুশ লেখক কমবেশি বিতর্কিত। এবং সেইসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, এরা সবাই হয় রাশিয়া থেকে নির্বাসিত কিংবা কমিউনিজমের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ধারণা করা যায়, নোবেল পুরস্কার রাশিয়ার বিরুদ্ধেই রাশিয়ার লেখকদের দাঁড় করিয়েছিলো।

 

রবীন্দ্রনাথের মতোই জমিদার পরিবারে জন্ম এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ালেখা শুরু করলেও ইভান বুনীনের পরিণতকাল বিশ্বের নানা দেশ ঘুড়ে এবং শেষে ফ্রান্সে স্থায়ী বসবাস করে কেটেছে। রুশ প্রবাসী এই লেখক তার মেমোরিস অ্যাণ্ড পোট্রেট গ্রন্থে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাষাতেই রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, রুশ বিপ্লবের ভয়াবহতা দেখেই তিনি স্বদেশ ত্যাগ করেন। হয়তো রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধাচার তাকে পশ্চিমা পূঁজীবাদীদের কাছে বরণীয় করে তুলেছিলো।

 

পাস্তেরনায়েকের ‘ডাক্টার জিভাগো’ রাশিয়াতে প্রকাশিত হতে পারেনি, সে লেখা চোরাই পথে ইতালীতে চলে আসে, সেখান থেকেই ইংরেজী ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ছাপা হতে থাকে। এই জিভাগোই তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। কিন্তু সোভিয়েত লেখক গোষ্ঠী এবং সরকারের আদেশে ১৯৫৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। আলেক্সজান্দার সোলানেৎসি ও তার উপন্যাস রাশিয়ার বাইরে পাচার করে দিয়েছিলেন এবং প্যারিসে তা প্রকাশিত হয়। ‘গুলাগ আর্চিপেলেগো’ নামের এই উপন্যাসে দরিদ্র জনগণের উপর রুশ সরকারি বাহিনীর অত্যাচারের কথা তুলে ধরা হয়। এই উপন্যাস প্রকাশের কারণে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়। ১৯৭০ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলেও রুশ সরকার তাকে এ পুরস্কার গ্রহণের অনুমতি দেয়নি। তিনি অবশ্য এর চারবছর পর পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। যোশেফ ব্রডস্কিও একাধিকবার গ্রেফতার হওয়ার পর রাশিয়া থেকে বিতারিত হন। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে বয়ঃকনিষ্ট পুরস্কারপ্রাপ্তদের অন্যতম ব্রডস্কি যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় নামী লেখক হয়ে উঠেন! রুশ লেখকদের মধ্যে অন্যদের তুলনায় মিখাইল শলোকভের রুশ-বিরোধী মানসিকতা ততো প্রকট ছিলো না। রুশ লেখকরা হয়তো স্বদেশে যথার্থই নিযার্তিত ছিলেন কিন্তু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য কেবল কি ‘নিযার্তিত’- এর কোটা-প্রাপ্তিই যথেষ্ট ছিলো! নির্বাসিত লেখকদের প্রতি এই সহানুভূতি মানবতা প্রশ্নে কতোটা দৃঢ় আর তৎতকালীন বিশ্ব রাজনীতির প্রশ্নে কতোটা – সে প্রশ্ন রয়েই যায়। নতুন সহস্রাব্দের সূচনাতে চীনা লেখক জাও জিয়াংয়ের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিও রাজনৈতিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। উল্লেখিত রুশ লেখকদের মতো তিনিও স্বদেশ থেকে বিতাড়িত। কমিউনিস্ট চীনের বিরোধিতা তার লেখারও বৃহত্তর অংশ জুড়ে আছে। বৃহত্তম রাশিয়া খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়ার পর বৃহত্তর কমিউনিস্ট দেশ চীনের এই লেখককে পুরস্কার দেয়া রাশিয়ার এককালীন প্রেক্ষাপটকেই মনে করিয়ে দেয়। বিশেষতঃ ঝাও জিয়াং-এর পরিচিতি এবং লেখনী মান নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল বিজয়ী প্রথম এশিয়ান লেখক। ইণ্ডিয়া সোসাইটি থেকে ১৯১২ সালে প্রকাশিত তার ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রতীচ্যকে মুগ্ধ করে। আইরিশ কবি ইয়েটশ এই গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখে দেন এবং রবীন্দ্রনাথের ভূয়ষী প্রশংসা করেন। অথচ পরের বছরই রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইংরেজি জানেন না এবং কোন ভারতীয় ইংরেজী জানেন না বলে ধিক্কার দিয়েছিলেন। ইয়েটশ নিজে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এরও দশ বছর পর– তার আগে এশিয়ার কোন লেখকের পুরস্কার পেয়ে যাওয়া হয়তো তার ভালো লাগেনি! এ বছর ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক ভি এস নাইপলের নোবেল প্রাপ্তি ভারতবাসীদের তো বটেই পুরো এশিয়াবাসীদের আনন্দিত করেছিলো। নাইপল ভারতীয় হলেও ভারত থেকে দূরেই আছেন, এমনকি ভারতীয়রা যখন তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করছেন তখন তিনি বলেছিলেন– ভারতীয়রা সাহিত্যের কিছু জানে না, তারা মূর্খ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর দ্বিতীয় এশীয় লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা। ১৯৬৮ সালে নোবেল বিজয়ী এই জাপানী লেখক ১৯৭২ সালে আত্মহত্যা করেন।

 

লাতিন আমেরিকায় প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ী লেখিকা গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল লেখক হিসেবে তেমন পরিচিত ছিলেন না। তার পুরস্কার প্রাপ্তির প্রায় ৩০ বছর পর ১৯৭১ সালে চিলিরই কবি পাবলো নেরুদা নোবেল পুরস্কার পান। রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে তাকেও জীবনের একটা দীর্ঘ সময় নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়। তবে মিস্ত্রালের মতো তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নেরুদার কাব্য প্রতিভা সারা বিশ্বেই সমর্থিত। নোবেল বিজয়ী অপর ল্যাটিন লেখক গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ তার জীবিতকালেই কিংবদন্তী হয়ে গেছেন। আধুনিক সাহিত্যে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। মিস্ত্রাল ছাড়া ল্যাটিন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার যোগ্যজনের হাতেই গেছে বলা যায়। কিন্তু বোর্হেস থেকে শুরু করে নিকোরো পারাবার মতো কবি-লেখকরা বঞ্চিতের তালিকাতেই রয়ে গেছেন। নাইজেরিয়ার ওলে সোয়েঙ্কা [১৯৮৬], মিশরের নাগিব মাহফুজ [১৯৮৮] এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নাদিন গর্ডিমার [১৯৯১] – এই তিন আফ্রিকান লেখকের কপালে নোবেল পুরস্কার জুটেছে অনেক পরে। এই যোগ্য প্রার্থীরা নোবেল পুরস্কার পেলেও বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের তুলনায় অপ্রতুলই বটে। সুইডেনের প্রায় অপরিচিত লেখকদের ঝুঁড়িতে নোবেল পুরস্কার ভরে উঠলেও এই মহাদেশের দিকে নজর পড়েছে খুব কমই। আমোস টুটুলা কিংবা চিনুয়া আচেবের মতো মহান লেখকরা এখনও নোবেল পুরস্কারের সীমানা থেকে দূরেই রয়ে গেছেন। পাশ্চাত্যের কাছে বরাবরই আফ্রিকা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আফ্রিকায় হীরার খনি আছে, সাহারা মরুভূমি আছে, গহীন অরণ্য আছে- আফ্রিকা সম্পর্কে এর বেশি জ্ঞান এখনও পাশ্চাত্যের গুটিকয়েক লোকেরই আছে। আফ্রিকার বহুবিচিত্র জাতি এবং ভাষার প্রতি নোবেল কমিটি নজর দেয়নি কখনই। নোবেল কমিটির একটি নিজস্ব অনুবাদ সেল আছে, তারা নির্দিষ্ট লেখকের লেখা প্রয়োজনে অনুবাদ করে কমিটিতে পেশ করে। প্রশ্ন জাগে, এই কমিটি আফ্রিকান ভাষার ক’জন লেখকের লেখাকে অনুবাদের যোগ্য বিবেচনা করেছে! ওলে সোয়েঙ্কা, নাদিন গার্ডিমার ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই কমিটির কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন।

 

এ প্রসঙ্গে লেখা দরকার, শুধু জাতিভেদই নয়, ভাষার ক্ষেত্রে নোবেল কমিটি পক্ষপাত দেখিয়েছে। ইংরেজি, স্পেনিশ, ফরাসী ও জার্মান ভাষায়ই অধিকাংশ নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাভাষী হলেও গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমেই কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কোন রকম সন্দেহ প্রকাশ না করেই বলা যায়, জীবনানন্দ দাস, তারাশঙ্কর, বিভূতিভুষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলাভাষী লেখকের নামও নোবেল কমিটি শোনেনি।

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৫/শাহনেওয়াজ