ভ্রমণ

আপনাকে অভিবাদন রমিজ রাজা

রহমান সিদ্দিক : আপনাকে অভিবাদন রমিজ রাজা। অভিবাদন এই কারণে যে, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল আপনাদের মনে, তা ভুলতে না পারার জন্য।

 

একাত্তর আপনাদের মন থেকে মুছে যাক, তা আমরা চাই না। আমরা চাই ওই ঘটনা দুস্বপ্নের মতো প্রতিনিয়ত আপনাদের তাড়া করে ফিরুক। আপনি যে ঘুমে, জাগরণে, স্বপনে একাত্তরে পাকিস্তানের পরাজয়ের কথা মনে পড়ে আঁতকে ওঠেন, নিয়াজি আর ইয়াহিয়া খানের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন, তা ভেবে আমরা আহ্লাদি হয়ে উঠি। বারবার আমাদের আহ্লাদি হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আপনাকে অভিবাদন মিস্টার রমিজ রাজা।

খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে মেলানো উচিত কি উচিত না সে প্রশ্নের জবাব তাত্ত্বিকরা দিতে পারবেন। তবে খেলাধুলা অনেক সময় কূটনৈতিক ভূমিকাও পালন করে থাকে। দুইটি বৈরি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন ও স্বাভাবিক করতে ক্রীড়াদল পাঠানোর ঘটনা বিশ্বে কম ঘটেনি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পিংপং কূটনীতির কথা আমরা জানি। ভারত-পাকিস্তান চিরবৈরি এই দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অনেকবারই ক্রিকেট কূটনীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। উভয় দেশ উভয় দেশে ক্রিকেট দল পাঠিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এভাবেই বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশই খেলোয়ারদের শান্তির দূত করা হচ্ছে।

 

খেলা-কূটনীতির সব নীতিবোধকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়ারদের নিয়ে মাঝে-মধ্যেই যেসব তীর্যক মন্তব্য করেন রমিজ রাজা, তাতে তার হীনমন্যতারই পরিচয় বহন করে। আর এই হীনমন্যতার জন্ম যে একাত্তরে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

গেল বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এতো সুন্দর পারফরমেন্স করল, তা দেখে বিশ্বের বাঘা বাঘা খেলোয়াররা পর্যন্ত পরিবর্তিত বাংলাদেশকে দেখে অভিনন্দিত করলেন; শুধু গাত্রদাহ হলো রমিজ রাজার। ইংল্যান্ডকে হারানোর পর বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করে তিনি একের পর এক বিবৃতি দিতে লাগলেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

 

আমাদের খেলোয়াররা ঠোঁট কামড়ে অপেক্ষা করছিল এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে। এর কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর। সেখানে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে ধবলধোলাই (আমাদের গণমাধ্যম একে আদর করে নাম দিয়েছে বাংলাওয়াশ) করে রমিজ রাজার অবজ্ঞার মোক্ষম জবাব দিয়ে দিয়েছে বাংলার তরুণরা। ওই পরাজয়ের পর যে রমিজ রাজা স্থির থাকতে পারবেন না, তা বলাই বাহুল্য। সেখানেও তাকে দেখা গেছে বাংলাদেশকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করতে।

 

নামের সঙ্গে রাজা থাকলেই কী, মনে যদি দীনতা থাকে ওই লোক তার দৈন্য প্রকাশ করবেই। পাকিস্তানের নষ্ট মানসিতকার এই রাজা এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে যে আচরণ করলেন, তা তার আগের সমস্ত অভব্যতা ও ধৃষ্টতাকে ছাড়িয়ে গেছে। দুবাইতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সুপার লিগে পেশোয়ার জালমি হয়ে খেলছেন তামিম ইকবাল। টানা দুই ম্যাচেই অর্ধশত করেছেন। তার দলও জিতেছে। প্রথম ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললেও, তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।

 

ওই লিগে বাংলাদেশের আরেক খেলোয়ার বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান করাচি কিংসের হয়ে খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা ‘ভুলক্রমে’ পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে সাকিবের জায়গায় ডেকে বসেন লেন্ডন সিমন্সকে। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে ‘ভুল’ শুধরে সাকিবকে ডেকেছিলেন। তার ওই ভুল যে ইচ্ছাকৃত তা তার অতীত ইতিহাসই প্রমাণ করে। এভাবে তিনি বাংলাদেশের খেলোয়ারদের অপমানিত করে পৈশাচিক আনন্দ পান। কিন্তু এই অপমান যে পক্ষান্তরে তার গায়েই লাগে নির্বোধ এই লোকটি সম্ভবত তা অবগত নন।

পরের দিন শনিবার যেই কাণ্ডটা ঘটালেন রমিজ রাজা, তা বিশ্বের তাবৎ ক্রিকেটপ্রেমীদের বিস্মিত করেছে; করেছে ক্ষুব্ধ। রাইজিংবিডির খবর থেকে জানা যায়, দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকট স্টেডিয়ামে শনিবার রাতে ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় রমিজ রাজাকে। তিনি অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সেরে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ ঘোষণা করে ডাকেন তামিম ইকবালকে।

 

অতিথিদের কাছ থেকে তামিম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গেলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রমিজ রাজা বলে ওঠেন, ‘আমি তো তোমার ভাষা জানি না, ইংরেজিতে বলবে? নাকি...?’ তামিম বুঝিয়ে দেন তিনি ইংরেজিতেই বলবেন। বললেনও তাই। রমিজ রাজার কপোলে যেন আরেকটি চটির আঘাত এসে লাগলো। যেমন লেগেছিল অন্য অনেকবার।

 

তামিমের ইংরেজিজ্ঞান নিয়ে রমিজ রাজার অজানা কিছু নেই। আগেও অনেকবার তামিমের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেছেন তিনি। ওই ম্যাচের আগের দিনও মাঠের সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে এক উপস্থাপিকাকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তামিম; এবং সেটা ইংরেজিতেই। ওই স্টেডিয়ামে উপস্থিত রমিজ রাজার তা না দেখার বা না শোনার কথা নয়। বাবরি চুল দিয়ে তার এক কান ঢাকা থাকলেও ওই সাক্ষাৎকার চুলের ফাঁক গলে তার কর্ণকুহরে না পৌঁছানোর কারণ নেই। তারপরও কেন এমন আচরণ করলেন রমিজ রাজা? এই প্রশ্নের উত্তরও খুব সোজা। একাত্তরের ওই পরাজয়। তারপর বাংলাদেশি তরুণদের হাতে একে একে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের পরাজয়। একাত্তরের ওই ঘটনা, ওই ‘গাবুইরা মাইর এবং ক্রিকেট পরাজয়, রমিজ রাজাকে যে ভূতের মতো তাড়া করে ফিরছে।

 

‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’ এর প্রমাণ যেমন একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা পেয়েছিল। পরাজিত ওইসব পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তের ধারা এখন রমিজ রাজাদের শোণিতে প্রবাহিত হচ্ছে এবং তিনিও পাটকেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন। খেলোয়াড়রা জবাব দিচ্ছে তাদের ব্যাট-বলে, ভাষায়। বাংলাদেশি তরুণরা জবাব দিচ্ছে তাদের মতো করে, নানা উপায়ে। এমনই এক অভিনব জবাব দিয়েছেন কিছু বাংলাদেশি তরুণ উইকিপিডিয়ায় ঢুকে তার প্রোফাইল পরিবর্তন করে।

 

শনিবার রাতে উইকিপিডিয়ায় থাকা রমিজ রাজাকে নিয়ে নিবন্ধটি ৪০ বার সম্পাদনা করা হয়েছে। সেখানে রমিজ রাজার পরিবর্তে ‘রমিজ গাজা’ বানিয়ে দিয়েছেন সম্পাদনাকারীরা। তার ক্যারিয়ারের রান করে ফেলা হয়েছে শূন্য। সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার অংশটি মুছে সেখানে বাংলা ও উর্দুতে কিছু গালি লিখে রাখা হয়েছে। একেই বলে যেমন কর্ম তেমন ফল। এই ফল রমিজ রাজার মতো বিকৃত মানসিকতার লোকদের প্রাপ্যই ছিল।

 

রমিজ রাজা যে রোগে ভুগছেন, তার নাম উন্মাদনা। কিশোর বয়সে শোনা তার দেশের সেনাদের মৃত্যু ও লজ্জাজনক পরাজয়ের মধ্য দিয়েই এই উন্মাদনা রোগের বীজ রোপিত হয়। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ আরো ডালপালা মেলছে। ফলে তার প্রলাপ বকা আরো বাড়ছে। আমরা চাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রলাপ বকে যান।

 

একাত্তরের পরাজয়, বর্তমানে ক্রিকেটে বাংলাদেশি তরুণদের হাতে খেলার মাঠে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তার উন্মাদনা রোগ আরো বিকশিত হোক। প্রতিটি পরাজয় তার মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দিক; তার শরীরে অদৃশ্য ফোস্কা পড়ে সে ছটফট করুক। এতে আমাদের খুব আমোদ হবে। আপনার উন্মাদ বচন দিয়ে আমাদের বারবার আমোদিত করে যাওয়ার জন্য আপনাকে আবারও অভিবাদন রমিজ রাজা।

 

লেখক : সাংবাদিক

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/নওশের