ভ্রমণ

কীসের লোভে হত্যা হত্যা খেলা?

জাহাঙ্গীর আলম বকুল

 

১.

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী নিহত পাঁচ জঙ্গির মরদেহ কেউ নিতে আসেনি। নিহত জঙ্গিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরও তাদের কর্মকাণ্ডে বাবা-মা বা স্বজনরা এতটা বিব্রত এবং লজ্জিত যে একনজর দেখতে আসতে পারেনি। মরদেহগুলো পড়ে আছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘরে। এখন গত্যন্তর না দেখে মরদেহগুলো বেওয়ারিশ দেখিয়ে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে পাঠানোর কথা ভাবছে প্রশাসন। নাম-পরিচয় জানা থাকা সত্ত্বেও ওই জঙ্গিদের মরদেহে প্রিয়জনের শেষ স্পর্শটুকু জুটল না।  

 

২.

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহের অদূরে ঈদের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর জঙ্গি হামলা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এখানে। এখানে হামলাকারী জঙ্গি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবীরের মরদেহ কেউ নিতে আসেনি। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাসরত আবীরের বাবা ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থানায় জিডি করেছিলেন। তিনি আদরের সন্তানের লাশটি পর্যন্ত নিতে আসেননি লজ্জায়। জানি না আবীরের মা নিজেকে কীভাবে শান্ত্বনা দিয়েছেন। অবশেষে প্রশাসনের সহায়তায় জেলা পৌর শহরের কবরস্থানে তার লাশের দাফন হয়েছে। সেই মরদেহের জানাজায় কেউ অংশ নিতে আসেনি। শুধু একজন স্থানীয় ইমাম জানাজা পড়িয়ে দাফন করিয়েছেন। ওই জঙ্গির বিশ্বাস ছিল- ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সে শহীদ হচ্ছে, অথচ তার মৃত্যুর পর জানাজায় কোনো মুসলমান অংশ নেয়নি।

 

৩.

সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত নয় জঙ্গির ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করেছে পুলিশ। তিন দিন পেরিয়ে গেলেও মাত্র দুজন অভিভাবক এসেছেন মরদেহের দাবি নিয়ে। প্রাণপ্রিয় সন্তানের মরদেহ দেখতে বাবা-মা আসবেন- এমন সম্ভাবনা কম। হয়ত এই জঙ্গিদেরও শেষ ঠিকানা হবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। অভিযানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার মো. রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মা রোকেয়া আক্তার তার সন্তান এক বছর আগে নিখোঁজ হয় বলে জানিয়েছেন। রিগ্যানের নিখোঁজের পর জিড়িও করেছিলেন তিনি। মেডিক্যালে ভর্তির জন্য কোচিং করা অবস্থায় নিখোঁজ হয় রিগ্যান। মেধাবী এবং এলাকার ভালো ছেলে রিগ্যান আজ পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে বেডে শুয়ে। তার সহযোগী জঙ্গিদের মতো বেহেস্তের টিকিট পেতে পেতে সম্ভবত আর পাওয়া হলো না তার!

 

৪.

বেশ কয়েক বছর আগে, যখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারা, নকশালপন্থিদের অবাধ বিচরণ ছিল, তখন ‘ক্রসফায়ার’ও শুরু হয়নি। প্রতিপক্ষের সঙ্গে গোলাগুলিতে সর্বহারা, নকশালপন্থিদের নেতারা নিহত হতো এবং তাদের মরদেহ পড়ে থাকত মাঠে। এই সকল নেতাদের নামে খুন, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজির অসংখ্য মামলা থাকত থানায়। এলাকার খেটে খাওয়া মানুষেরা এই সকল নষ্ট মানুষের অত্যাচারে এতটাই অতিষ্ঠ থাকত যে, তাদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে দলে দলে গিয়ে মরদেহে থু থু দিত। কতটা ঘৃণা আর আক্রোশ থাকলে একজন মানুষের মরদেহে আরেকজন মানুষ, আরেকজন মুসলমান থু থু দেয়। সেই দিনও হয়ত বেশি দূরে নয়, সারা দেশের মানুষের মধ্যে যেভাবে ঘৃণা দানা বাঁধছে, তার বহিঃপ্রকাশ একদিন হয়ত এভাবেই হবে।

 

৫.

এই তরুণদের পরিণতি এমন হওয়ার কথা ছিল না। এরা অধিকাংশই দেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে পড়েছে। তারা প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দেশব্যাপী নিখোঁজের যে তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে অনেকে আছেন যারা ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। সন্তান জন্মানোর পর আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের বাবা-মা স্বপ্ন দেখে সন্তানকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। নাহলে অন্তত দেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। একটি সন্তানকে এই পর্যায়ে আনতে বাবা-মার যে পরিশ্রম, যে ত্যাগ- তা কেবল তারাই জানেন। সেই আদরের সন্তানটির ছিন্নভিন্ন মরদেহ যখন বাবা-মা দেখেন, তখন কতটা কষ্ট তাদের সহ্য করতে হয়। পারিপার্শ্বিকতার কথা চিন্তা করে সন্তানের মরদেহটি পর্যন্ত নিতে যেতে পারেন না। এই বাবা-মায়েরা এমনটি তো চাননি। তারা চেয়েছিলেন সন্তানের আনন্দে ঘেরা একটা ভবিষ্যত। বাবা-মা সন্তানদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন, এমন তথ্য আমরা এখনো পাইনি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সন্তানদের জঙ্গিবাদের জন্য কোনো বাবা-মাকে হয়রানি করেনি। এটা খুব ভালো দিক।   

 

বাবা-মার কষ্ট-ত্যাগের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু যে যুবকটি জীবনের কঠিন ধাপগুলো পার হয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত, যার সামনে সুখের দিন, সে কেন স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেঁচে নিচ্ছে? এই ‘কেন’-এর উত্তর খুঁজতে হবে।

 

৬.

জঙ্গি হামলা চালাতে গিয়ে যারা মারা গেছে বা যাচ্ছে- তারা সবাই যুবক এবং জঙ্গি সংগঠনের প্রান্তিক পর্যায়ের সদস্য। গ্রেপ্তার জঙ্গিদের যে জবানবন্দি প্রকাশ হয়েছে, তাতে আমরা দেখছি- এদেরকে প্রিয়জন বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধীরে ধীরে জিহাদি ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে এই ধরনের নৃশংসতা করানো হয়। এদের কারো অতীতে এ ধরনের নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার বা অপরাধ সংঘটনের নজির নেই। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন থেকে তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যে মানুষ হত্যার মতো নৃশংসতা হাসতে হাসতে করতে পারছে। কারা তাদের দিয়ে এ সব করাচ্ছে এবং কেন করাচ্ছে?

 

৭.

আলো হাসি গানে ভরা এই পৃথিবী। এখানে প্রতিদিন ফুল ফোটে, পাখি গায়। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত সাজে নতুন সাজে। সৃষ্টিকর্তা অপার সৌন্দর্যে সাজিয়েছেন পৃথিবীকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য। জীবনকে ভালোবাসলে জীবন আনন্দ দেয়। জীবনের এই আনন্দের চেয়ে বড় আনন্দের স্বপ্নে বিভোর করে বিপথগামী করা হচ্ছে তরুণদের। যে পথে সেই আনন্দের ভুবনে প্রবেশের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে, সেটি সঠিক পথ নয়। ইসলাম কখনো সেই পথ সমর্থন করে না।

 

ইসলাম কখনো মানুষ হত্যা সমর্থন করে না (বিচারের মাধ্যমে হত্যা ছাড়া)। নিরাপরাধ মানুষ হত্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাপ। দেশের ভেতরে অরাজকতা (ফিতনা) সৃষ্টি করতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যারা ইসলাম ধর্ম সম্পর্ক স্বল্প জ্ঞান রাখেন, তারাও বিষয়গুলো জানেন। অজানা থাকার কথা নয়- যারা তরুণদের বিপথগামী করে এই সব করাচ্ছে, তাদেরও। তারপরও তারা তা করাচ্ছেন। কোন লোভে করাচ্ছেন?

 

বেহেস্তে যাওয়ার গ্যারান্টি সেই অর্থে কোনো মুসলমানের নেই। একজন ঈমানদার মুসলমান সারা জীবন ইসলামের নির্দেশিত পথে চললে আল্লাহ দয়াবশত তাকে বেহেস্ত দিতে পারেন। অমুসলিম বিদেশিদের ইসলামের শত্রু বানিয়ে হত্যা করে ডাইরেক্ট বেহেস্তে যাওয়া- এটা ইসলাম ধর্মের পথ নয়। এটা পার্থিব কোনো লাভের পথ।

 

উত্তরবঙ্গ থেকে আটক এক জঙ্গির উদ্বৃতি দিয়ে সম্প্রতি সিলেটের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, ২০০৪ সালের দিকে ওই যুবক জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হয়। এরপর তাকে কুরআনের বিভিন্ন অংশ থেকে খণ্ড খণ্ড লাইন মুখস্ত ও এর বাংলা অনুবাদ শেখানো হয়। যেসব লাইন শেখানো হয়, সেগুলো পুরোপুরি অসম্পূর্ণ। এ কারণে কুরআনের সঠিক মর্মবাণী সম্পর্কে তারা কোনো ধরনের ধারণা নিতে পারে না। উসকানিমূলক অসম্পূর্ণ যেসব আয়াতের অংশ শেখে, সেগুলো দিয়ে তারা সহজে মানুষ খুন করার প্রেরণা পায়।  

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৬/রফিক