ভ্রমণ

রাতের রাজকোটে তিন যুবক

রাজকোট বিমানবন্দরে নেমেই হুমায়ূন আহমেদের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়লো তার লেখা একটি বইয়ের নাম। হুমায়ূন আহমেদ যখন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে ছিলেন, তখন বইটি লিখেছিলেন। ‘নিউ ইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’।

ভারতে এসেছি আজ চার দিন হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে সরাসরি দিল্লি গিয়েছিয়াম। বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট সিরিজ উপলক্ষ্যে। ৩ নভেম্বর প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মাঠে ছিলাম। দর্শক গ্যালারিতে না। একেবারেই মাঠে। ক্যামেরা হাতে। ফটোগ্রাফার হিসেবে। অসাধারণ জয়ের মুহূর্ত সবুজ গালিচায় দাঁড়িয়ে দেখেছি। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানিয়েছি। ছবি তুলেছি। দিল্লীর অরুন জেটলি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এরচেয়ে ভালো আর কী হতে পারে আমার জন্য!

যাই হোক, দ্বিতীয় ম্যাচের জন্য রাজকোটে আসার কথা। বলতে ভুলে গিয়েছি। আমার সাথে আছেন সিনিয়র কলিগ ফিরোজ আলম। ক্রিকেট ব্র্যান্ডিং আমার কাজের বড় একটা অংশ। ঐতিহাসিক এই ক্রিকেট সিরিজের সহযোগী পৃষ্ঠপোষক আমার কোম্পানি ওয়ালটন। সেই সুবাদেই আসা।

দিল্লী থেকে আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে। সময়মতো আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছেছি। গত দুদিন ধরে কয়েকবার যে কথাটি শুনছি, তা হলো দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ না হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ রাজকোটের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে নাকি বড়সড় ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। দিল্লীতে খেলা কাভার করতে আসা সাংবাদিক ভাই–বন্ধুদের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। আমার সাথে আসা ফিরোজ স্যারও বললেন, আভাসটা নাকি বেশ ভয়ঙ্কর। এছাড়া ঢাকায় দুয়েকজনের সাথে ফোনে কথা বলার সময়ও ওপাশ থেকে সবারই আশঙ্কা– ম্যাচ কি হবে? রাজকোট যাচ্ছি– ফেসবুকে এমন একটা স্ট্যাটাস দেখে মেসেজ পাঠিয়েছেন- ওখানে গিয়ে যেন সাবধানে থাকি।

এসব শুনে মন কিছুটা ভার। প্রথমত, খেলা না হলে দ্বিতীয়বার জয়ের আনন্দটুকু পাব না। দ্বিতীয়ত, ম্যাচটা যদি স্বাভাবিকভাবে না হয় তাহলে আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের যথেষ্ঠ ক্ষতি হবে। কারণ, প্রথম ম্যাচে ভারতের মাঠে বাংলাদেশ জিতে দ্বিতীয় ম্যাচের হাইপ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সিরিজ নিয়ে দুই দেশের কোটি কোটি দর্শকের উন্মাদনার শেষ নেই। এসব কারণে ম্যাচ না হওয়া কিছুটা চিন্তার বিষয় বটে।

সত্যি বলতে যখন রাজকোট এয়ারপোর্টে নামলাম, একবারের জন্যও মনে হয়নি এরকম কোনো সম্ভাবনা আছে। কারণ আকাশ ঝকঝকে ফকফকে আর ধবধবে। মনে হচ্ছে আগামী দুই-চার সপ্তাহেও কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নেই।

রাজকোট। ভারতের প্রসিদ্ধ রাজ্য গুজরাটের অন্যতম শহর। শুধু শহর বললে ভুলই হবে। এটি আসলে গুজরাটের চতুর্থ বৃহত্তম শহর। অর্থাৎ আহমেদাবাদ, সুরাট এবং বড়দরার পর রাজকোটের অবস্থান। আর এখানে এসে বুঝলাম রাজকোটকে কেন পুরো ভারতের মধ্যে নবম পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতটাই পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি তা এখানে না এলে বোঝানো যাবে না। এটি সারা ভারতের মহানগরগুলির মধ্যে পয়ত্রিশতম বৃহত্তম মহানগর। 

দিল্লীর অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় লেখক

ঢাকা থেকেই আমরা বুকিং ডটকমের মাধ্যমে হোটেল বুক করেছিলাম। রাজকোট এয়ারপোর্ট থেকে সম্ভবত এক কিলোমিটারের কাছাকাছি দূরত্ব এই হোটেলের। ফাইভ স্টার রেটিং এই হোটেলটি ফিরোজ স্যার বুকিং করেছিলেন খুব সস্তায়। বুক করার সময় আমরা দ্বিধায় ছিলাম, আসলেই ফাইভ স্টার রেটিং ব্যাপারটি সত্যি কি না। কারণ, আমরা একটা স্যুইট নিয়েছি মাত্র তিন হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতিদিন দুইজনের থাকা বাবদ তিন হাজার টাকা খরচ। ঢাকা থেকে ইন্ডিগো প্লেন ছাড়তে কিছুটা কালক্ষেপণ করেছিল বটে। কিন্তু দিল্লী থেকে রাজকোটে আসার এয়ার ইন্ডিয়া সঠিক সময়েই ছেড়েছিল।

দেড় ঘণ্টা আকাশে ওড়ার পর আমাদের মাটিতে নামানো হলো। আমরা রাজকোট এয়ারপোর্ট থেকে একটা অটোরিক্সা নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে হোটেলের সামনে নামলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, ‘এই শহর তোমার ভালো লাগবেই’। আসার আগে যদিও কিছুটা শুনেছিলাম এই শহরের গুণকীর্তন। আইটিডব্লিউ এর মোহাম্মদ শারিক কেরালারই ছেলে। ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার জন্য ওকে সারা ভারত ঘুরে বেড়াতে হয়। তাছাড়া নিজের দেশের ব্যাপারে ও জানবে এটাই স্বাভাবিক। শারিক যখন আমাদের অফিসে গিয়েছিলেন এই সিরিজের স্পন্সর বিক্রি সম্পর্কিত মিটিংয়ে; তখন ওর মুখেই শুনেছিলাম, অসম্ভব সুন্দর এই রাজকোট।

হোটেলে পৌঁছে আমাদের চিন্তা দূর হলো। হোটেলটা সত্যিই অসাধারণ। কক্ষে ঢুকে আমাদের আর তর সইছিল না। শহরের আশেপাশে ঘুরে দেখার জন‌্য মনটা আইঢাই করছিল। ফ্রেশ হয়ে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। দিল্লী থেকেই মনে হচ্ছিল, কিসে যেন কিছুটা কমতি আছে আমাদের। ঢাকা থেকে দিল্লী রাতে পৌঁছেছিলাম, সন্ধ্যায় ম্যাচের মধ্যে ছিলাম। আর ম্যাচের আগে সারাদিন আমার এক্রিডিটেশন কার্ডের আশায় উৎকণ্ঠায় কেটেছে। কখন কার্ড হাতে পাব। ওটা না পেলে আমি মাঠের ভেতর ঢুকতে পারব না। টিকটেই খেলা দেখতে হবে তাহলে। এসব কারণে কমতিটা ঠিকমত টের পাইনি।

একটু বলে রাখি, প্রথম ম্যাচে হাতে ভিআইপি টিকিট থাকা সত্ত্বেও কেনো মাঠে ঢোকা এতো জরুরি ছিল। সেটা হলো, বাংলাদেশে গত মাসে হয়ে যাওয়া তিনজাতি ক্রিকেট সিরিজের মাধ্যমে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে মাঠে ছবি তোলার জন্য অনুমতি পেয়েছিলাম। আর এবার বিসিসিআই থেকেও ভারতের মাঠে ছবি তোলার অনুমতিটা পেলাম। আমার ধারণা এটা আমার একটা বড় অর্জন। যেটা কমতি মনে হচ্ছিল বলছিলাম- আজ রাজকোট এসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মিস করছি। এরকম সুন্দর একটি জায়গায় যিনি আসলে প্রেমে পড়ে যেতেন, লেখার জন্য বড় একটা উপলক্ষ্য পেতেন, সেই উদয় হাকিম স্যারকে দারুণভাবে মিস করছি। কোনো ট্যুরে উনি থাকা মানে সেই ট্যুরের আনন্দ চারগুণ বেড়ে যাওয়া। কাজ করতে করতে, বেড়াতে বেড়াতে অনেক কিছু শেখারও সুযোগ থাকে।

সময় কম। আজ এইবেলা আর কাল পুরো দিনটাই হাতে আমাদের। আমরা যখন হোটেল থেকে বের হচ্ছি, তখন বিকাল ৪টা বেজে ৩০ মিনিটের মতো হবে। আমরা কোথাও গেলে খাওয়া নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না। ঘোরার ব্যাপারে আমাদের তিনজনেরই দর্শন এক। ঘুম আর খাওয়া কম, চোখ ভরে দেখে নেয়া যায় যত বেশি।

আমি আর ফিরোজ স্যার লাঞ্চের চিন্তায় গেলাম না। সিদ্ধান্ত হলো প্লেনে তো কিছু খেলামই। এখন বেলাও শেষ প্রায়। অনলাইনে দেখলাম রাজকোটে আইনক্স সিনেপ্লেক্স আছে যেটা আমাদের হোটেল থেকে পাঁচ ছয় মিনিটের পথ। তাহলে আজকে মুভি দেখি। আর আশেপাশে কিছু একটা খেয়ে নিলেই হবে।

রাজকোট এয়ারপোর্টে লেখক মিলটন আহমেদ ও ফিরোজ আলম

আমরা বেরিয়ে পড়ি। হোটেলের সামনে দুই তিন মিনিট অপেক্ষার পর একটা অটোরিকশা পেলাম। কোথায় যাব বললাম, কিন্তু বুঝলো না। আশেপাশের তিন চারটা জায়গার নাম বললাম, গুগলে ম্যাপ দেখালাম। তাতেও কাজ হলো না। পরের অটোকে বললাম। একই অবস্থা। আমরা আবিস্কার করলাম রাজকোটের মানুষ হিন্দিতে পারদর্শী না। এদের নিজেদের ভাষা গুজরাটি। সেটা আরো বুঝলাম খানিক পরে। সিনেমা হলের টিকিট কেনার পর হাতে সময় ছিল। হালকা কিছু খেয়ে নেয়া যায় কি না ভেবে আশেপাশে ঢুঁ মারতে গেলাম। কিন্তু কোথাও একটি অক্ষর পর্যন্ত হিন্দি দেখতে পাইনি আমরা। সবখানে গুজরাটি ভাষায় লেখা।

৫টা বিশে আমাদের সিনেমা দেখার টাইম। পাশাপাশি তিনটি হলে মুভি চলে এই ওয়ার্ল্ড আইনক্সে। একটিতে হাউজফুল ফোর, আরেকটিতে টারমিনেটর সিরিজের নতুন মুভিটা। অন‌্য একটায় এখানকার গুজরাটি সিনেমা। আমরা প্রথমটা দিল্লীতে দেখে ফেলেছি। সময় কাটানোর জন্য নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো ভেবেই দ্বিতীয়টার টিকিট কিনলাম। এখন হলিউডের মুভির বড় একটা অংশই হলো কার্টুন টাইপের সিনেমা তৈরি করা। ওদের মেকিং এমন, যে ফরমেটেই সিনেমা বানানো হোক না কেন, পৃথিবীব্যাপী চলবেই। যাই হোক, আমরাও বুঝে গিয়েছিলাম এই টারমিনেটর সিরিজের মুভির স্টোরি কী। এই সিনেমায় সবসময় ভিলেন অতিমাত্রায় শক্তিশালি থাকে। এক পর্যায়ে এসে সেই শক্তিশালি ভিলেনের পতন হবেই।

টারমিনেটর শেষ হওয়ার পনের মিনিট আগে জিটিভির তায়েব অনন্ত আমাকে কল করে বলে, ব্রাদার কোথায় আছেন? চলেন আজকে মুভি দেখি। আমি বললাম আমি সিনেমা হলে। মুভি দেখছি। অনন্ত আসবে বলে ঠিকানা চাইলে আমি বললাম, ব্রাদার, সিনেমার আর মাত্র পনের মিনিট আছে। শেষের দিকে। তিনি হতাশ কণ্ঠে বললেন, ভাবলাম আপনার সাথে সময় কাটাবো। তাহলে রাতে ডিনার করি? একজন কাছের মানুষ ডিনার করতে চাইলেন; খুবই ভালো লাগছিলো। বললাম আমাদের হোটেলে চলে আসেন। আমরা যাচ্ছি।

অনন্তের আসতে ১০ মিনিট লাগবে বলে আমরা আর রুমে গেলাম না। ওর অপেক্ষায় সুইমিং পুলের পাশে হেলান চেয়ারে গিয়ে দুজন বসলাম। পুলটা লবি পেরিয়ে হোটেল এরিয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে। নির্জন পুকুর পাড়ে নিয়ন আলোয় আমাদের মনোযোগ মোবাইলে। আগেই জেনেছিলাম এই হোটেলের রুফটপে রেস্টুরেন্ট আছে।

অনন্ত তায়েব এসেই জানতে চাইলো- ব্রাদার আপনাদের ক্ষুধা লাগেনি? আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। চলেন আগে ডিনার করি। ছাদের উপরে চলে গেলাম। গল্প আর আড্ডা দিতে দিতে আমরা সময় নিয়ে ডিনার শেষ করলাম। ভেজিটেবল বিরিয়ানি। সাথে ডাল ভুনা। দারুন রেসিপি দুটোই। তৃপ্তি নিয়ে খেলাম।

খাওয়া শেষে আমরা নিচে নেমে সুন্দর এলাকাটায় ত্রিশ মিনিটের মতো হেঁটেছি। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরত্ব। ছোট ছোট বাড়ি এখানে। বড়জোর দোতলা। আমি, ফিরোজ স্যার আর তায়েব অনন্ত। তখন রাত সাড়ে এগারটার মতো হবে। রাস্তায় হাঁটছি আমরা। নির্জন রাস্তায় রাতে ফোঁটা ফুলের মৃদু সুবাস নাকে আসছে। দারুণ এক অনুভূতি। মনে পড়ে গেলো হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাসের কথা– ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’। ওই উপন্যাসে সারারাত রাস্তায় তিন যুবক হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায়। আজকে আমরাও তিন যুবক। মনে হচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের তিন যুবক বাংলাদেশ থেকে রাজকোটের রাস্তায়। হাউজফুল ফোর যদি হয়, টারমিনেটর ফোর যদি হয় তবে চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক- উপন্যাসটিরও সিক্যুয়াল হতে দোষ কী? ভারত/সুজন/সনি