ভ্রমণ

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: তৃতীয় পর্ব

বিমানের পাইলটের তথ্য অনুযায়ী আমরা এখন ভূপৃষ্ঠ থেকে ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে আছি। মেঘের দেশে ভাসছি! মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে সবুজ পৃথিবী দেখা যাচ্ছে। নদীগুলোকে সাপের মতো আঁকাবাঁকা দেখাচ্ছে। চার পাঁচজনের একটি দল অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প ট্রেকিং-এ যাচ্ছে। তাদের একজন সিট থেকে আমাদের দেখে উঠে এলেন কথা বলার জন্য। আমরা তাদের শুভকামনা জানালাম। ইতোমধ্যে বিমানের ক্রুরা যাত্রিদের স্ন্যাকস দিলেন। সবার মতো আমরাও খাচ্ছি। মুহিত ভাই এবং সেই ইউরোপিয়ান ভদ্রলোক গল্পে মেতে উঠেছেন। খুবই আগ্রহ নিয়ে মুহিত ভাইয়ের পর্বতারোহণের গল্প শুনছেন তিনি। আমি বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। মেঘগুলো এতো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন স্রষ্টা। দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে!

আমরা যে হিমালয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি তার জানান দিচ্ছে মেঘের উপর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র চূড়া। পৃথিবীতে আট হাজার মিটারের ১৪টি পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে বিমান থেকে ৫টি পর্বতশৃঙ্গই দেখা যায় যদি আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা হলো ৩য় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার। আমাদের বহন করা বিমানটি প্রায় সোয়া বারোটার দিকে কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে এসে চোখ কপালে! হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এতো যাত্রীর ভিড় আগে কখনো এখানে দেখিনি। দুর্গাপূজার ছুটির কারণে এই অবস্থা। সবাই ছুটি কাটাতে এসেছে নেপালে। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। মুহিত ভাই মোবাইলের সিম চেঞ্জ করে দাওয়া শেরপাকে ফোন করে জানালেন আমরা ইমিগ্রেশনে আছি। দাওয়া শেরপাও জানালেন আমাদের রিসিভ করতে সে বাইরে অপেক্ষা করছে। দাওয়াকে আমি আগে দেখিনি তাই পরিচয় হয়নি এখনো। যাই হোক, আগে এয়ারপোর্টের কাজে সেরে বাইরে যাই। এখানকার কাজ শেষ হতে বেশখানিকটা সময় লেগে গেলো।

অনেক ঝক্কিঝামেলা পেহাতে হলো বেল্ট থেকে ডাফলব্যাগ পেতে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখি দাওয়া দাঁড়িয়ে আছে। সাদা মুক্তার মতো দাঁত বের করে হাসছে। আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ব্লু জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা। ছোট্ট ব্যাকপ্যাকটা সামনে রাখা। ত্রিশের কাছাকাছি বয়সী একজন তরুণী। সে মিংমা শেরপার ছোট বোন। মিংমা শেরপা হলেন ইমাজিন নেপাল এজেন্সির মালিক। এই ইমাজিন নেপালের মাধ্যমেই আমরা হিমলুং অভিযান করবো। নেপালী রীতিতে দাওয়া আমাদের উত্তরীয় পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। দাওয়া ফোন দিয়ে ড্রাইভারকে ডাকলেন। আমাদের জন্য আগে থেকেই গাড়ি প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো। ট্রলি থেকে ডাফলব্যাগগুলো গাড়িতে তুলে আমরা উঠে বসলাম। দাওয়া অবশ্য আমাদের সাথে যাচ্ছে না। সে স্কুটি নিয়ে এসেছিলো। আমাদের পেছনে আসবে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সেই চিরচেনা কাঠমান্ডু শহর। আমার এখন এগিয়ে চলছি থামেলের পথে। তৃতীয়বারের মতো আমার নেপাল আসা। এর আগেও আরো দু’বার এসেছি পর্বতাভিযানে। প্রথম এসেছিলাম ২০১৫ সালে মাউন্ট কেয়াজো-রি অভিযানে। মাউন্ট কেয়াজো-রি খুম্ব রিজনে। খুম্ব রিজনটা হলো এভারেস্ট রিজন। লুকলা হয়ে নামচে বাজার থেকে মেনদে হয়ে কেয়াজো-রি যেতে হয়েছিলো। সেবার আমার ৭ জনের একটা বড় টিম ছিলো। পাঁচজন পর্বতারোহী মূল অভিযানে আর বাকি দুজন নারী অভিযাত্রী ফৌজিয়া রিনি ও শায়লা পারভীন বিথী বেসক্যাম্প পর্যন্ত। মূল অভিযানে আমিই ছিলাম নবীন। এটাই ছিলো আমার প্রথম ৬ হাজার মিটারি বা ২০ হাজার ২৯৫ ফুট উঁচু কোনো পর্বত অভিযান। মুহিত ভাইয়ের নেতৃত্বে বিপ্লব ভাই আর আমি কেয়াজো-রির শিখরে লাল-সবুজ পতাকা ওড়াই। নুর ভাই এবং শামীম ভাই চূড়ার কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছিলেন সেবার। 

২০১৭ সালে দ্বিতীয় বারের মতো নেপাল আসি ২০ হাজার ৫০০ ফুট উঁচু লারকে পিক অভিযানে। এই অভিযানেও ৬ জনের একটি দল ছিলাম। মুহিত ভাইয়ের নেতৃত্বে নূর ভাই, বিপ্লব ভাই, শায়লা পারভীন বিথী এবং আমি। আমাদের দলে আরো একজন ছিলেন তিনি হলেন সানভি। তিনি অবশ্য এই লারকে বেসক্যাম্প পর্যন্তই। এবার আবহাওয়ার বৈরীতায় ১৮ হাজার ৫৩৭ ফুট উচ্চতার হাইক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে হয়েছিলো।

গাড়ি সোজা চলে এলো এজেন্সির বুকিং করা হোটেলের গেইটে। হোটেল হলি হিমালায়া, এই হোটেলে এর আগে আমি আসিনি। এবারই প্রথম। তবে মুহিত ভাই এখানে আগেও একাধিকবার থেকেছেন। দাওয়া শেরপাও চলে এসেছে। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে গেইটে থাকা দুইজন সিকিউরিটি গার্ড কাছে এসে অভ্যর্থনা জানালো। গাড়ি থেকে ব্যাগগুলো নামিয়ে হোটেলের ভেতরের অভ্যর্থনা ডেস্ক থেকে রুমের চাবি নিয়ে দ্বিতীয় তলার ২০৩ নাম্বার রুমে চলে এলাম। আমাদের সাথে দাওয়াও এলো। হোটেলের দুই কর্মী আমাদের ডাফলব্যাগ রুমে দিয়ে গেলো। বিকেলে আবার আসবে জানিয়ে দাওয়া শেরপাও চলে গেলো। আমরা লাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম। মুহিত ভাইয়ের মোবাইলে একটি ফোন এলো হিমালায়ান ডাটাবেজ থেকে। হিমালায়ান ডাটাবেজের একজন ভলেন্টিয়ার আমাদের সাথে দেখা করার জন্য হোটেলে আসছেন। তাই তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে আবার হোটেলে ফিরে এলাম।

বিকেল ৫ টার দিকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। কাঁশফুলের মতো সাদা মাথার চুল ও দাড়ি-গোঁফ ছোট করে কাটা। চোখের চশমা মুছতে মুছতে আমাদের সাথে পরিচিত হলেন। আমাদের রুমের সামনেই বসার মতো সুন্দর একটি জায়গা আছে। চারটে বেতের চেয়ার ও একটি ছোট টি-টেবিল রাখা। সেখানেই আমার বসেছি। চিপস আর কাজুবাদাম খাচ্ছি। ভদ্রলোকের নাম জীবন শ্রেষ্ঠা। তিনি হিমালায়ান ডাটাবেজের সাথেই কাজ করছেন। হয়তো আপনাদের হিমালায়ান ডাটাবেজ নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে? তাহলে আসুন এর সাথে আগে পরিচয় করিয়ে নিই। হিমালায়ান ডাটাবেজ হচ্ছে হিমালয়ের আট হাজার মিটার পর্বত অভিযানের বিভিন্ন তথ্যের বিশ্বস্ত ও অনেকটাই নির্ভুল আর্কাইভ। হিমালয়ে আট হাজার মিটার পর্বত অভিযান করেছেন কিন্তু হিমালয়ান ডাটাবেজের ভলান্টিয়ারদের সম্মুখীন হননি এরকম পর্বতারোহী খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে অভিযান ও পর্বতারোহীদের খুঁটিনাটি বিষয় লিপিবদ্ধ করা থাকে। বর্তমানে এখানে সাত হাজার মিটার পর্বত অভিযান ও পর্বতারোহীদেরও লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়েছে। এই হিমালয়ান ডাটাবেজের স্রষ্টা হলেন মিস এলিজাবেথ হাউলে।

টাইম সাময়িকীর সাংবাদিক মার্কিন নারী হাউলে ৩৭ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে নেপালে আসেন। তখন অবশ্য তিনি সাংবাদিকতার কারণেই এসেছিলেন। আর তখন থেকেই পর্বতের প্রেমে পড়ে যান। সেই যে প্রেমে পড়লেন আর সেই প্রেমের টানেই ফেরা হলো না ঘরে। এরপর থেকে আজীবন কাটিয়ে দিলেন নেপালের কাঠমান্ডুতেই। তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টসহ হিমালয়ের অন্যান্য পর্বতশৃঙ্গ আরোহণের নানান খুঁটিনাটি বিষয় নথিবদ্ধ শুরু করেন। বিশেষ করে আট হাজার মিটার পর্বতশৃঙ্গ। যদিও তিনি কখনো কোনো পর্বত অভিযানে যাননি। এমনকি এভারেস্ট বেসক্যাম্পেও। তারপরে কি এক পর্বতের মোহ তাকে বেঁধে রাখে। হয়তোবা তিনি সেজন্যই বিয়ে না করেই পর্বত নিয়ে সংসার করেছেন। তিনি পৃথিবীর পর্বতারোহীদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও ভালোবাসার মানুষ। তাইতো তার সম্মানে নেপাল-তিব্বত সীমান্তের কাছে পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ ধবলাগিরি রেঞ্জে নেপালের হুমলা জেলায় অবস্থিত ৬ হাজার ১৮২ মিটার উচ্চতার একটি পর্বতশৃঙ্গের নামকরণ করা হয়েছে ‘হাউলে শৃঙ্গ নামে। যদিও তিনি এই নামকরণে খুশি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘পর্বতের স্থানীয় নামই থাকা উচিৎ। কোনো ব্যক্তির নামে পর্বতের নাম হওয়া উচিৎ নয়।’ ঢাকা/তারা