ভ্রমণ

মেলাকা নদীর যত গল্প (প্রথম পর্ব)

বাসে চড়লাম সবে, টিকিট কিনতে হবে ড্রাইভারের কাছ থেকে, তিনি ড্রাইভিং সিটে বসে টিকিট বিক্রি করছিলেন। বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কানে এলো মিউজিক সিস্টেমে বাজতে থাকা তামিল গান। ড্রাইভার তামিলদের মতো দেখতে। আরো নিশ্চিত হবার জন্য টিকিট চাইলাম তামিল ভাষায়। তিনি ফটাফট টিকিটও দিয়ে দিলেন। আমার পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় জনাপঞ্চাশেক মানুষ; তারাও একই বাসের যাত্রী। তাই কথা না বাড়িয়ে সিটে গিয়ে বসলাম- গন্তব্য ঐতিহাসিক শহর মেলাকা।

আশপাশে দেখি বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ দক্ষিণ ভারতীয়দের মতো দেখতে; কথা বলছেন তামিল ভাষায়। মালয়েশিয়ায় আমি টাইম ট্রাভেল করছি নাকি! মাত্র তো প্লেনে চেপে চেন্নাই থেকে কুয়ালালামপুর এলাম, সেখান থেকে বাসে তিন ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে মেলাকা, এখান থেকে যাবো শহরের প্রাণকেন্দ্রে। এখন মেলাকা বাস স্টেশনে একি ভেল্কিবাজি! নাকি আমিই তামিলনাড়ু ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছি?

আসলে এরা ভারতীয় তামিল অভিবাসী, যাদের প্রোপিতামহ বা তাদেরও আগের পূর্বপুরুষ মালয়েশিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই জনগোষ্ঠীকে বলা হয় চিট্টি। যারা পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মেলাকায় আসেন ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার করতে। তারপর কেউ কেউ স্থানীয় নারী বিয়ে করে এখানেই স্থায়ী হয়েছেন। কিন্তু কয়েকশ বছর মালয়েশিয়ায় থাকলেও নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ভুলে যাননি।

চায়না টাউনে চাইনিজ টেম্পল

বাসচালক আমাকে নামিয়ে দিলেন মেলাকা হেরিটেজ টাউনের প্রাণকেন্দ্রে। সেখান থেকে আমার হোটেল হাঁটা পথের দূরত্ব- চায়না টাউনে। দু’একজনকে জিজ্ঞেস করেই হোটেল পেয়ে গেলাম। আসলে এটা হোম স্টে। সাধারণত আমি ভিনদেশে হোটেলের চেয়ে হোম স্টে-তে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সে দেশের সংস্কৃতি, খাবার বা ভাষার সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচয় ঘটে। হোম স্টে’র মালিক চাইনিজ মালয়েশিয়ান- নাম লি। পূর্বপুরুষ সপ্তদশ শতাব্দীতে চীন থেকে মেলাকায় এসেছিলেন ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক আমলে চাকরির সন্ধানে। পরে মালয়েশিয়ায় রয়ে গেছেন। ভদ্রমহিলা একাই থাকেন বাড়িতে একজন গৃহকর্মী নিয়ে। আমার মতো ট্যুরিস্টদের সঙ্গ দেন, নিজেও সঙ্গ পান। সঙ্গে মাস চালানোর জন্য খরচ উঠে আসে। আগে তাদের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। এখন তিনি হোম স্টে নিয়েই সুখে আছেন।

সদা হাস্যমুখ, ছিপছিপে গড়ন, কাঁধ সমান কালো চুলের মিষ্টি মেয়ে লি’র সঙ্গে মেলাকা নিয়ে অনেক কথা হলো দুপুরের খাবার খেতে খেতে; মেলাকা নদীর পাড়ে। বাড়িটা মেলাকা নদী ঘেঁষে। নদী একেক সময়ে একেক ঋতুতে একেক ভাষায় কথা বলে। নদীর জল, গাছপালা, তীরঘেঁষে একতলা, দোতলা কয়েকশ বছরের পুরনো টালির বাড়ি এমন ভুবন ভোলানো দৃশ্য খাবারের সময়কে আরো স্মরণীয় করে রাখল।

মালায়েশিয়ার আর দশটা শহরের মতো মেলাকায়ও মালয় জনগণের সঙ্গে চাইনিজ আর দক্ষিণ ভারতীয়দের সহাবস্থান শত শত বছর ধরে। হোস্ট হিসেবে লি অসাধারণ! খাওয়ালেন ভাতের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী মেলাকার তিন রকমের সবজি আর তরকারি। লি জানালেন শুক্র, শনি, রবিবার মেলাকার ‘জনকার স্ট্রিট’-এ বিকেলে জমজমাট উইকেন্ড বাজার বসে যা মেলাকার অন্যতম আকর্ষণ। আর সৌভাগ্যবশত সেদিন ছিল শুক্রবার। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে চললাম জনকার ওয়াকের উদ্দেশ্যে। কয়েক মিনিট হেঁটেই পেয়ে গেলাম জনকার ওয়াক বা স্ট্রিট যা চায়না টাউনেই অবস্থিত।

চায়না টাউনের পুরোটাতেই ঔপনিবেশিকতার ছাপ প্রকট। প্রতিটি বাড়িঘর সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ধাঁচে নির্মাণ করা। তবে বাড়ির দরজায় ঠিকানা বা বাড়ির নাম্বার লেখা ম্যান্ডারিন ও ইংরেজি ভাষায়। এখানকার চাইনিজরাও নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করছেন একে অন্যের সঙ্গে। তাঁরা নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলেন। খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, উৎসব মেনে চলেন চাইনিজ রীতি অনুযায়ী। অলিগলিতে অলিখিত চাইনিজ নিয়ম। টেম্পল, নেইমপ্লেটে ম্যান্ডারিন লেখা, মাথার উপরে ঝুলন্ত কাগজের ঝালর, চাইনিজ ডিজাইন করা ড্রাগন, সিংহ ইত্যাদি। চাইনিজ ছেলেমেয়েদের নম্র হাসি দেখলে আবারও ভুল হয়, মনে হয় আমি বোধহয় চীন দেশেরই কোনো মফস্বল শহরে এসে গেছি।

জনকার ওয়াক

জনকার ওয়াকের রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘর ছাড়াও অনেক রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট রয়েছে যেখানে এন্টিক, স্যুভেনিয়র, কাপড়, চীনামাটির বাসনপত্র, চিত্রকর্ম ইত্যাদি পাওয়া যায়। আর উইকেন্ড মার্কেটের ব্যাপারই আলাদা। পুরো পথটাই যেন পথের অস্থায়ী বাজার যেখানে খাবার, কাপড়, মসলা, চা, ফুল, ফল, মনোহারী দ্রব্য থেকে শুরু করে হাত দেখা গনকেরও অস্থায়ী দোকান খুঁজে পাওয়া যাবে। পথিমধ্যে এক ইউরোপীয় ট্যুরিস্টকে দেখলাম রাস্তায় বসে বাদ্য বাজিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে সাহায্য চাইছেন যাতে সামনে আরো ভ্রমণ করতে পারেন। আরেকজন ইউরোপীয়কে দেখলাম টেনিস বল দিয়ে খেলা দেখিয়ে সাহায্য চাইছেন। পথচারীরা তাদের নিরাশ করছেন না। আসলে এটাই বিশ্বাস, অকৃত্রিম ভ্রমণ পিপাসুদের ছুটে চলার আশা, স্বপ্ন পূরণের নিয়ম। আমি ভাবলাম, বাহ! বেশ তো, ভবিষ্যতে ভ্রমণ করতে গিয়ে ভিনদেশে যদি অর্থসংকটে পড়ি তাহলে তা থেকে মুক্তির উপায়ও আছে। ভাবতে ভালো লাগে আমিও এমনই বছরের পর বছর ভ্রমণ করব দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, এক নদী থেকে আরেক সমুদ্রে।

জনকার ওয়াকজুড়েই খাবার বা স্ন্যাকসের এত বাহার যা দেখলেই পেট ভরে যায়। নানা রঙের ডাম্পলিংস, গ্রিলড অক্টোপাস, নাম না জানা মাছ ভাজা, মালয়েশিয়ান ফ্রিটার, চাইনিজ মিষ্টিজাতীয় খাবার, ভারতীয় চানাচুর, শ’ খানেক ধরনের জুস- কি নেই এখানে! স্ন্যাকস খেতে খেতে সন্ধ্যা নামতে নামতে অন্ধকার হয়ে এলো। আমি হাঁটতে থাকলাম নদীর দিকে। একটা তামিল গির্জা দেখলাম, সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে তাই বন্ধ। ভারতে যেমন তামিল ভাষায় তামিলিয়ান গির্জায় প্রার্থনা করা হয় এখানেও ঠিক একইভাবে। একশ বছরের পুরনো গির্জা। আমার জানার কথা নয় এত কিছু, গির্জার তামিলভাষী দ্বাররক্ষক জানাল। কারণ আমি বন্ধ হয়ে যাওয়া গেইটের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলাম। একবার দেয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টাও করেছি। আমার ভাঙাচোরা তামিল শুনে ভেবেছে আমি কুয়ালালামপুর থাকি। জুড়ে দিলো গল্প। তার নাম সুদর্শন। পিতামহ এসেছিলেন তামিলনাড়ু থেকে, এখন পরিবারের সবাই এখানেই থাকে। মালয়েশিয়াই তার দেশ, মেলাকা তার শহর। সুদর্শনকে বিদায় জানিয়ে চললাম সন্ধ্যা রাতের মাদকতায় ভরা সপ্তদশ শতাব্দীর বাড়িঘর পেরিয়ে, সন্ধ্যাতারার হাত ধরে আরেকটু দূরে৷

পথিমধ্যে পড়ল আলোকসজ্জিত রিকশা যা ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনে নিয়োজিত। মেলাকা নদী রাতেও তার শোভা বাড়িয়ে চলেছে। চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি, মেলাকা নদী ভেসে যাচ্ছে ভ্রমণার্থীদের কলকাকলী আর হরেক খাবারের সুগন্ধে। জলের বুকে রঙিন আলোর ছড়াছড়ি, কেউ কাঁপিয়ে যায় তো কেউ শান্ত করে। কেউ তীব্র আলোয় ঝকমকিয়ে যায়, আবার কেউ নরম আলোয় মন ভোলায়। সরু নদীর দু’কূলজুড়ে রেস্তোরাঁ। নৌ ভ্রমনের ব্যবস্থাও আছে।

নদীর শান্ত জলে ছায়া দেখতে দেখতে, আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঠান্ডা বাতাসে রাতের খাবারের সময়টা মোহময় হয়ে ওঠে। নদীর কূল ধরে হেঁটে হেঁটেই ফিরে গেলাম আমার অস্থায়ী ডেরায়। পরদিন ভোরে উঠে কফি খেয়ে ছুটলাম মালয়েশিয়ার সবচেয়ে পুরনো শহর অভিযানের নেশায়। চায়না টাউন থেকে বের হয়ে ঠিক করলাম প্রথমে যাবো মালয়েশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ইউরোপীয় স্থাপনা দেখতে। মেলাকা পত্তনের ঘটনাটা মনে পড়ল। সালটা ১৩৯৯ বা ১৪০০, রাজা পরমেশ্বর নিজ জন্মভূমি সিঙ্গাপুর থেকে একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর রাজ্য তখন প্রবল প্রতাপশালী মাজাপাহিত রাজার দখলে। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে উত্তর দিকে যেতে থাকলেন আত্মগোপন করে। ১৪০২ সালের কোনো এক দিনে বারতাম নদীর তীরে জেলেদের গ্রামে জাহাজ থামিয়ে তিনি একটি আমলকী গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার মনে হলো সম্ভাবনাময় এ গ্রামটি হতে পারে তাঁর নতুন রাজ্য। তিনি স্থানটির নাম দিলেন মেলাকা বা মালাক্কা। মালায় বা স্থানীয় ভাষায় মেলাকা মানে আমলকী (যেহেতু আমলকী গাছের ছায়ায় বসে তিনি রাজ্যপত্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন)। পরে বারতাম নদীর নাম পালটে হয়ে যায় মেলাকা নদী। আমাদের দেশেও অনেক জায়গার সুন্দর সুন্দর নাম আছে ফলের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা।

জনকার ওয়াকে রিকশা

রাজা পরমেশ্বর জেলেদের গ্রামগুলোকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে চাষাবাদের দিকে উৎসাহিত করলেন। তাতে রাজ্যের খাদ্যসংকট যেমন মিটবে সেইসঙ্গে পাহাড় পর্বতও গাছগাছালির কারণে মজবুত থাকবে। পাহাড়ি মাটিতে কলা, আখ, মিষ্টি আলু ইত্যাদি লাগিয়ে পাহাড়কে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। পাহাড় আর নদীর জল উভয়েই চাষাবাদের অনুকূল ছিল বলে মেলাকা খুব দ্রুত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাজ্যে পরিণত হলো। সেইসঙ্গে রাজা মনোনিবেশ করেছিলেন রাজ্যের অবকাঠামোগত উন্নয়নেও।

রাজা পরমেশ্বরের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো মেলাকাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করা। তাই সমুদ্র উপকূলের বন্দরকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে তিনি মেলাকার স্থানীয় জনগণ এবং আদিবাসী উভয়কেই কাজে লাগিয়েছিলেন সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামো নতুনভাবে নির্মাণে। আর বাকি আদিবাসীদের তিনি নিজের সামরিকবাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে নিজ রাজ্যের সামরিক শক্তি আরো মজবুত করেছিলেন।

রাজা পরমেশ্বরের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। মূলত চীন দেশের রাজাদের সঙ্গে। এক বছরের মধ্যেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আরব দেশসমূহে মেলাকার বাণিজ্যবন্দর, বাণিজ্য বাজারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। মেলাকা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা রাজা পরমেশ্বরের সুদূর প্রসারী চিন্তার কারণে মেলাকা এক দশকের মধ্যেই সমৃদ্ধশালী ও বিখ্যাত বাণিজ্যভূমি হিসেবে স্থান পেয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্রে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পুরো মালয়েশিয়া ও সুমাত্রার কিছু অংশ মেলাকা সালতানাতের করায়ত্ব হয়। সেসময় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মাজাপাহিত রাজারও মেলাকা সালতানাতকে ঘাটানোর সাহস ছিলো না।

রাজা পরমেশ্বরের শাসনামলে সাধারণ জনগণের জীবনে কোনো অভাব ছিলো না। ধারণা করা হয় রাজা পরমেশ্বর হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। অনেকে এও বলেন যে, মালয়েশিয়ায় ইসলামের প্রসারকালে তিনি শেষ বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কারণ তাঁর উত্তরসূরির নাম ইস্কান্দার শাহ। তবে অনেকে ধারণা করেন ইস্কান্দার শাহ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, রাজা পরমেশ্বর নয়। রাজা পরমেশ্বর দেহত্যাগ করেন ৭০ বা ৭১ বছর বয়সে ১৪১৪ সালে। বলা হয়ে থাকে, তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে তাঁর জন্মভূমি সিঙ্গাপুরে। মতান্তরে এও বলা হয় যে, হিন্দু আচার অনুষ্ঠান অনুযায়ী তাকে দাহ করা হয়। যদিও এখন মেলাকায় রাজা পরমেশ্বর বা মেলাকা সালতানাতের রেখে যাওয়া কোনো নিদর্শন নেই। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইউরোপীয়দের রেখে যাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন এখনো অনেক গল্প বলে যায়।

আ ফামোসা দুর্গ

মেলাকার প্রাণকেন্দ্র বিখ্যাত রেড স্কয়ার পার হয়ে খানিক এগুলেই মিলবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইউরোপিয়দের রেখে যাওয়া সবচেয়ে পুরনো দুর্গ ‘আ ফামোসা’। পর্তুগিজ রাজা মেলাকার বাণিজ্য খ্যাতির কথা জেনে ১৫০৯ সালে নৌ-সেনাপতি ‘ডিয়োগো লোপেজ ডি সিকোয়েরা’ কে মেলাকা পাঠান। সেটাই ছিল প্রথম কোনো ইউরোপিয় নাগরিকের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পদার্পণ। সুলতান মাহমুদ শাহ প্রথমে ডি সিকোয়েরাকে সাদরে গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার কাছে আসা আন্তর্জাতিক মুসলমান ব্যবসা সমিতির প্রতিনিধিদল খ্রিস্টান আর মুসলমানদের দ্বন্দ্বের আশঙ্কায় পর্তুগিজদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এই বলে যে- খ্রিস্টান পর্তুগিজ বাহিনী মুসলমান রাজ্যের জন্য বিভীষিকা বয়ে আনতে পারে। এরপর সুলতান মাহমুদ পর্তুগিজদের চারটি জাহাজ আক্রমণ করেন।

১৫১১ সালে মেলাকা সালতানাতের খ্যাতি যখন তুঙ্গে তখন পর্তুগিজ বাহিনী মেলাকা আক্রমণ করে। ১২০০ সৈন্য আর ১৬/১৭ টি জাহাজে ভাইসরয় ‘আফোনসো ডি আলবুকারক’ সুলতান মাহমুদ শাহ-এর কাছে দুর্গ নির্মাণ আর বাণিজ্য স্থাপনার প্রস্তাব দেয়, সুলতান তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ক্রুদ্ধ পর্তুগিজ বাহিনী সকল শক্তি দিয়ে মেলাকা আক্রমণ করে। সুলতানের সেনাবাহিনীও কম যায় না। প্রায় চল্লিশ দিন যুদ্ধের পর পর্তুগিজ বাহিনীর জয় যখন নিশ্চিত তখন সুলতানের পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। পর্তুগিজদের মেলাকা দখলের পর শাসনকাল তেমন সুখকর ছিলো না। স্থানীয় মুসলমানরা পর্তুগিজ শাসকের বশ্যতা স্বীকারে নিমরাজি ছিল। আর সেইসঙ্গে পর্তুগিজদের ১৩০ বছরের শাসনামলে মেলাকা দখলের জন্য সুলতান মাহমুদ এবং তার বংশধরেরা আশপাশের রাজ্যের সহায়তায় মেলাকা দখলের চেষ্টা চালায় ছয় বার। পার্শ্ববর্তী দেশ চীনও পর্তুগিজদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে বিমুখ থাকায় মেলাকার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ মেলাকা সালতানাতের তিল তিল করে গড়ে তোলা বাণিজ্য বন্দর অচিরেই তার জৌলুশ হারাতে থাকে। পর্তুগিজ সরকার বাইরের আক্রমণ সামলাতে আর নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে ব্যস্ত থাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের পতন ঘটে। (চলবে)