ভ্রমণ

চা বাগানের বাঁকে বাঁকে

পড়ন্ত বিকেল। দু’পাশে বিলের মাঝে সরু পিচঢালা রাস্তা। গ্রাম বাংলার চিরচেনা নয়নাভিরাম দৃশ্য। বাইক্কা বিল যাওয়ার সময় মনে আপনা আপনি গেয়ে ওঠে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে…’। এ ছাড়াও চা বাগান, টিলা, লেক, রাবার বাগান, লেবু বাগান সব মিলিয়ে সবুজের ছড়াছড়ি চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে। 

প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষেই বন্ধুরা বলছিল একটা ট্যুর দেবো কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চার আর মেলেনি, তাই যাওয়াও হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ কলেজের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পরিকল্পনা হলো শ্রীমঙ্গল ঘুরতে যাবো একদিনের জন্য। ভাবলাম ভার্সিটির বন্ধুরাও যেহেতু ট্যুরের কথা বলেছিল, ওদেরও বলি। ওরাও রাজি। ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন তো রাজি হলোই, সঙ্গে বন্ধু রানা বললো ওর সংগঠন মুক্ততরীর (নারায়ণগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন) কয়েকজন ওর সঙ্গে যাবে। এদিকে শাকিল মাহামুদ জানালো ওর সঙ্গে কলেজের চার বন্ধু যাবে। সব মিলিয়ে বিশাল ২১ জনের টিম হয়ে গেলাম আমরা। নির্ধারিত হলো ২৩ জানুয়ারি আমরা সারাদিন শ্রীমঙ্গল ঘুরবো।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২২ জানুয়ারি রাতে উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল যাবো, তবে বিপত্তি হলো রাত দেড়টার ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে যাবে। এত রাতে পৌঁছালে ঝামেলা, তাই সিদ্ধান্ত হলো সিলেটগামী সুরমা মেইলে আমরা যাবো। ২১ জানুয়ারি রাত ৯টায় সুরমা মেইলে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তবে আমার যেই ৩ জন কলেজ বন্ধু নিয়ে প্রথমে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত তারাই পারিবারিক সমস্যার কারণে যাবে না বললো। ডিপার্টমেন্টের বন্ধু রিয়াজ, ফয়সাল, তাসিব, শাকিল মাহমুদ, রানা, অহিদুল, মোহাম্মদ শাকিল, ফারহানসহ সব মিলিয়ে ১৭ জনের টিম নিয়ে আমরা রওনা হলাম। ট্রেন কমলাপুর স্টেশন থেকে বের হতেই শুরু হলো আড্ডা-গান, শেষ রাতে একটু সবাই ক্লান্তি দূর করতে আড্ডায় ক্ষ্যান্ত দিলেও শায়েস্তাগঞ্জ পার হতেই কুয়াশাচ্ছন্ন শ্রীমঙ্গলে অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই।

রাস্তার দু’পাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমরা পৌঁছলাম শ্রীমঙ্গল। আগে থেকেই আমি দুটো গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম, তারা স্টেশনেই ছিল। চাদের গাড়িতে উঠে তো সবার সে কী উল্লাস! প্রথমেই আমরা চলে গেলাম পানসী রেস্টুরেন্টে। সেখানে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে রওনা হলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে।

লাউয়াছড়া যাওয়ার পথে আমাদের রীতিমতো অবাক করে দিয়েছিল!সকাল সকাল তেমন কোনো গাড়ি বা মানুষ ছিল না, দু’পাশে গাছ উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছিল। হীম শীত উপেক্ষা করে আমরাও গাড়ির উপরে বসে শুরু করলাম গান, সাথে ছবি তোলা, ভিডিও করা। এত চমৎকার রাস্তায় ছুটে বেড়ানো হয়তো এর আগে আমাদের কারোই হয়নি। সাড়ে ৮টার দিকে আমরা নামলাম উদ্যানের সামনে। নেমেই সেখানে সবাই সকালের চা পান সেরে নিলাম। উদ্যানে প্রবেশ শুরুর সময় ৯টা, তাই আমরা সেখানে বাইরেই কিছু ফটোসেশন করলাম। এরপর টিকিট মাস্টার আসলে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমরা যেহেতু সবাই শিক্ষার্থী, তাই আইডি কার্ড দিয়ে ২০ টাকা করে আমাদের প্রবেশ মূল্য দিতে হয়েছে।

যাদের নিরিবিলি জায়গা ভালো লাগে, উদ্ভিদ নিয়ে জানার আগ্রহ তাদের সময় নিয়ে লাউয়াছড়া ঘুরতে ভালো লাগবে। তবে আমাদের টিম বড় হওয়ায় এবং একদিনে অনেক জায়গা ঘুরবো, তাই আমরা এখানে বেশি ভেতরে যাইনি। গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে বড় বড় পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন গাছ, বিরল প্রজাতির গাছের দেখা মিলবে এখানে। একটু সামনে গেলেই দেখা মিলবে রেললাইন। সেখানে গিয়ে আমরা সবাই ছবি তুললাম, রেললাইনের এখানেই হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ‘আমার আছে জল’-এর শুটিং হয়েছিল। রেললাইনের বাম পাশ দিয় সামনে গেলেই দেখা মিলবে গবেষণা কেন্দ্র। আমরা ১ ঘণ্টা সময়ের মতো এখানে থেকে বের হয়ে যাই মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে।

জীববৈচিত্রের অভয়াশ্রম হিসাবে লাউয়াছড়া ব্যাপক সমাদৃত। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২০০ হেক্টরের বনাঞ্চলজুড়ে প্রায় আড়াই হাজারের অধিক বন্যপ্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় ৪৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক, হনুমান, শকুন, লজ্জাবতী বানর, মায়া হরিণসহ নানা প্রাণীর দেখা মেলে এই উদ্যানে। এ ছাড়াও প্রায় ৬৮ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে এখানে।

চারপাশে চায়ে ঘেরা উঁচু উঁচু টিলা আর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে লেক। মাধবপুর লেকে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো লাল পদ্ম। লেকের পাড়ে বসে লাল পদ্ম দেখতে দেখতে-দেখতে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া যেতেই পারে এখানে। লেকের পাড় দিয়ে সামনে গেলেই শুরু টিলা, একের পর এক টিলার বুকে সবুজ চা বাগান ভ্রমণপিপাসুদের মনে নাড়া দেবেই। টিলার উপর থেকে লেকের সৌন্দর্য যেন আরও বেশি মনে হয়। লেক, টিলা আর চা বাগানের মিশেল পেয়ে ক্যামেরায় বন্ধী করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো সবাই। সেইসঙ্গে টিম মেম্বাররাও এক ফ্রেমে বন্ধী হলাম এখানে।

এর মাঝেই দেখা হলো এক চা শ্রমিকের সঙ্গে, তিনি শুনালেন চা শ্রমিকেদের কষ্টের কথা। সারাদিনে চা পাতা তুলে বা চা গাছ কেটে একজন শ্রমিক আয় করে মাত্র ১২০ টাকা। খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে এসব চা শ্রমিকদের।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টিলার উপরে উঠে মনে হচ্ছিল এখানেই যদি থেকে যেতে পারতাম, আহা কতই না সুন্দর আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি। আমরা মোট ৪টি টিলা পর্যন্ত উঠি এরপর ফিরে আসি। লেক থেকে বের হওয়ার সময় দেখা মেলে পাহাড়ি পেঁপের। স্কুল বন্ধ থাকায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে এসেছে পর্যটকদের কাছে পেঁপে বিক্রি করতে। দাম একটু বেশি চাইলেও বন্ধু অহিদুল দামাদামিতে পাক্কা শেষ পর্যন্ত সুলভ মূল্যয়েই পেঁপে খেলাম আমরা। পাহাড়ি পেঁপের স্বাদটাও ছিল দারুণ। মাধবপুর লেকের পর আমাদের গন্তব্য ছিল লাল পাহাড়।

লাল পাহাড় যাওয়ার পথেই আমরা দেখলাম নূর জাহান টি গার্ডেন ও রাবার বাগান। চায়ের রাজধানী যে শ্রীমঙ্গল তা অনুভব করা যায় মাধবপুর লেকের টিলাগুলোতে ও লেক থেকে লাল পাহাড় যাওয়ার পথে। এই পথের দুইধারে যতদূর চোখ যায় দেখা মেলে শুধু সবুজ চা বাগানের। সতেজ সবুজ পাতায় পূর্ণ বাগানের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছে আর আমাদের গলাফাটানো গানও চলছে। সত্যিই এ এক অন্যরকম এডভেঞ্চার ছিল আমাদের জন্য। এই রাস্তায় চা বাগানের পাশাপাশি দেখা মিলবে লেবু ও আনারস বাগান। পাহাড়ের বুকে সারি সারি আনারস রয়েছে বাগানগুলোতে।

লাল পাহাড়ে সড়ক থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে উঠতে হয়। পাহাড়ে যাওয়ার আগে আমরা হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর হাঁটা শুরু, একটু বেশি উঁচু হওয়ায় কেউ কেউ যেতে চাচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত একজন বাদে সবাই যাই। চা বাগান পেরিয়ে লাল পাহাড়ের উপরে উঠলাম আমরা। উপরে একটি মন্দির রয়েছে। উপরে উঠলে চারদিকের দৃশ্যটা সুন্দরভাবে দেখা যায়। ওইখানে আরও একটি পাহাড় রয়েছে, সময় কম থাকায় আমরা সেটায় না যেয়ে ফিরে আসি গাড়িতে। এরপর যাই বধ্যভূমি’ ৭১ এ।

শহরের ভানুগাছ সড়কে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সেক্টর হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন ভুরভুরিয়া ছড়ার পাশে অবস্থিত বধ্যভূমি’ ৭১ পার্কটি। এখানে রয়েছে ‘সীমান্ত ৭১ ফ্রেশ কর্নারসহ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১’।  এছাড়াও এখানে নানা রকম চায়ের সমাহার। ৩,৭,১০ সহ বিভিন্ন লেয়ারের চা পাওয়া যায় এখানে। শুধু লেয়ার চাই নয়, প্রায় সব ধরনের চা পাওয়া যায়।

আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য ছিল শহর থেকে বেশ দূরে বাইক্কাবিল। বিলের জলরাশির ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পার হয়ে গাড়ি থামতেই শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির শব্দ, আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াউড়ি আর পানিতে মাছের লুকোচুরি খেলা মাতিয়ে রেখেছে এই বিলটিকে। শীতের সময় পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এই বিল। শীত মৌসুমের পুরোটা সময় পাখির কলকাকলীতে মুখর থাকে চারপাশ।

শীতের কুয়াশা ভেদ করে অতিথি হয়ে এখানে এসেছে নানা জাতের সৈকত পাখি। গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা চিটি আর কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, পাতিসরালী, রাজসরালী, মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঙ্গাহাঁস, গুটি ঈগলসহ আরও অনেক প্রজাতি। বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সেখানে তৈরি হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, সারি সারি টিলা আর তার বুকে চা বাগান সতেজ সবুজ পাতায় পূর্ণ হয়ে আছে শ্রীমঙ্গলের নিসর্গশোভা। সব মিলিয়ে ভ্রমণপিপাসুদের মন কাঁড়বে চায়ের রাজধানী।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ।