ভ্রমণ

টুঙ্গিপাড়ার পথে

আজ আমরা চলেছি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়ার  উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে এতো দিন মাঝখানে বিশাল এবং একইসঙ্গে প্রমত্তা পদ্মা ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিতে হতো। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বড়ো প্রতিবন্ধক হয়ে ছিল পদ্মা নদী। এখন আর এই প্রতিবন্ধকতা নেই।

আমাজানের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মার উপর দিয়ে এখন নিয়মিত যানবাহন চলছে। আমরা যখন টুঙ্গিপাড়ার পথে যাত্রা করেছিলাম, তার এক মাস পরেই সেতুর উদ্বোধন হওয়ার কথা। ফলে সেদিন আমাদের সেই পুরনো পথ ধরে, ঝুঁকি নিয়ে প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিতে হয়েছিল।

মেঘলা আকাশ। চৈত্রের তপ্ত রোদ নেই। কয়েকদিন অস্বস্তিকর গরমে বৃষ্টির আভাস প্রকৃতিতে। তাই সকালের আবহাওয়া প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। শীতের সকালের কথা খুব মনে পড়ে। আক্ষেপ হয় শীতকালটা আরো ভালোভাবে ভ্রমণ এবং কাজের মধ্যে কাটাতে না পেরে। আক্ষেপটা শুধুই ভ্রমণ নয়, চলমান জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘সময়’ নিয়েই বেশি। মানুষের পুরো জীবনটাই তো এক একটা ভ্রমণ। দার্শনিকরা তাই জীবনকে বলছেন অনিশ্চিত পরিভ্রমণ।

আমি ও বন্ধু সাইয়িদ সুজন সকাল সাড়ে ৮টায় জিপিওর মোড়ে একত্রিত হই। আমাদের মূল গন্তব্য টুঙ্গিপাড়া হলেও কোটালীপাড়ায় কবি সুকান্তের আদিভিটা দেখারও ইচ্ছে আছে। হাতে সময় থাকলে গোপালঞ্জের অন্যান্য দর্শনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও যাওয়া যেতে পারে। 

জ্যোতিষীরা দৈনিক পত্রিকায় বিভিন্ন রাশির জাতকের রাশিফল গণনা করে লেখেন ‘আজ আপনার ভ্রমণযোগ ভালো’ অথবা ‘আজ ভ্রমণযোগ ভালো নয়’। বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন এই জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস না থাকায় ‘ভ্রমণযোগ’ ভালো না মন্দ তা দেখার কারণ নেই। তারপরও বাস্তবে আজ আমাদের ‘ভ্রমণযোগ’ ভালোই বলতে হবে। কারণ একদিনের এই ভ্রমণে আমাদের সময়গুলো যথার্থ ব্যবহার হয়েছে। একে একে যদি বলি, আমরা সময়মতো গুলিস্তান পৌঁছাতে পেরেছি। খুব বেশি অপেক্ষা না করেই মাওয়াগামী একটি ভালো চলতি এসি গাড়ি পেয়েছি এবং এটিতে চড়ে ১ ঘণ্টাতেই মাওয়া ঘাটে পৌঁছে যাই। ঘাটে নেমেই স্পিডবোটে এক দুর্দান্ত এবং শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রায় মাত্র ১০ মিনিটে তরুণ চালকের মাধ্যমে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে কেওড়াকান্দি পৌঁছে যাওয়া কী ‘ভ্রমণযোগ’ ভালো না হলে সম্ভব?

অবশ্য পদ্মায় সলিল সমাধি হলে কোনোদিনই জানা হতো না আমাদের দুজনেরই ভ্রমণযোগে একসঙ্গে মন্দ লেখা ছিল কিনা! স্পিডবোটে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে ‘বেঁচে থাকা যে কী আনন্দের’ এই বোধ খানিকক্ষণের জন্য হলেও আমাদের জেগেছিল! বেঁচে থাকায় অভিজ্ঞতার ঝুলিও বেশ সমৃদ্ধ হয়! 

সকাল ১১টায় কেওড়াকান্দি নেমে প্রথমেই ইলিশ ও ইলিশ ভাজার স্বাদ নিয়ে সকালের নাস্তা সারি। এই খাবার আমাদের দুপুরের আহারে প্রয়োজনিয়তা অনেকটা মিটিয়ে দেয়। এরপর পেয়ে যাই খুলনাগামী একটি এসি বাস। বাসটি মাত্র রওয়ানা হয়েছে, তাই এটি থামিয়ে দুই বন্ধু চেপে বসি। এই বাসটির গতি সম্ভবত আমরা দুজন ছাড়া অন্যান্য যাত্রীদের বেশ প্রশংসা কুড়ায়। নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগেই আমাদের গোপালগঞ্জের পুলিশ লাইনে নামিয়ে দেয় তারা।

গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইনে নেমে একপ্রস্থ চায়ের আড্ডা। এখানে অপেক্ষমান এক ভদ্র ও মার্জিত তরুণ অটোওয়ালার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারিনি আমরা। চায়ের দোকানে পরিচয় হয় বাচ্চু শেখ নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি  নিজেকে ‘শেখ পরিবারে’র লোক বলে পরিচয় দেন। তার কথা বললে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে বিশেষ সমাদর পাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদিও বলেন তিনি। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অটোচালক ইয়াছিন শেখের উপর পূর্ণ ভরসা রেখে রওয়ানা হয়ে যাই টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক থেকে চলে এসেছি পিরোজপুরের মহাসড়কের দিকে। দুইপাশে ধান ও বিভিন্ন সবজি খেত এবং বিশাল বিশাল বিল চোখে পড়ে। এই বিলগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ‘বাওড়’ বলে। সিলেট অঞ্চলে হাওড়, এই অঞ্চলে বাওড়। আরো খানিক্ষণ যাওয়ার পর আমরা মহাসড়ক ছেড়ে বামদিকের একটি সড়কে উঠি। ইয়াছিন শেখ জানায়, এটিই টুঙ্গিপাড়ার রাস্তা। এখান থেকে মাইলখানেক গেলেই বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পৌঁছে যাবো আমরা। 

চমৎকার পরিচ্ছন্ন সবুজ একটি গ্রামে প্রবেশ করি। বড়ো বড়ো মাঠ, স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা চোখে পড়ে। খানিকক্ষণ পর আমরা দেখতে পাই বিশাল একটি ফটক এবং বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফটকের উপরে স্বর্ণালী অক্ষরে বড়ো করে লেখা: ‘জাতির পিতার সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স-১নং গেট।’ 

প্রবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। আমরা ফটক অতিক্রম করে ঢুকে পড়ি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদি বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানেই কোথাও চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি। মূল গেটের ভেতরে প্রবেশ করতেই ডানদিকে পড়বে জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার ভবন। আমরা সমাধিস্থল দেখে তারপর জাদুঘরে আসবো। সময় হলে গ্রন্থাগারেও কিছুক্ষণ সময় কাটানো যাবে। বিশেষ নকশাঁয় নির্মিত বড়ো আকারের একটি ভবন দেখে বুঝতে পারি এটিই বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ। আমরা ভেতরে প্রবেশ করার উদ্যোগ নিই। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানিয়ে দিলেন, সমাধিসৌধের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। ভেতরে প্রবেশ করে পাশাপাশি দুটো কবর দেখতে পাই। একটি বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান এবং অপরটি মাতা সায়েরা খাতুনের। একপাশে বড়ো জায়গাজুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবর।

কবরগুলো সাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো। সমাধিসৌধের উপরের অংশ সাদা পাথরে তৈরি একটি গোলাকার গম্বুজ। গম্বুজের দেয়াল জাফরি কাটা। জাফরি কাটা অংশ দিয়ে সূর্যের আলো কাঁচের কারুকাজের মধ্য দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। যে কোনো সমাধি দেখলে ব্যক্তিগতভাবে মনের গভীরে বেদনার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যে মানুষগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ক থাকে। আজ যে মানুষটির সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তিনি ব্যক্তি বা পরিবারের উর্ধ্বে উঠে একটি জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভয়াবহ নিপীড়ন এবং দুঃসহ শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা তাঁর কঠোর সমালোচকরাও অস্বীকার করতে পারেন না। এই বিশাল মহীরুহ হয়ে ওঠা নেতাকে দেশী-বিদেশী চক্রান্তের মাধ্যমে কতিপয় কুচক্রী সামরিক অফিসার নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে। কঠোর গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে শুধু বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় এনে দাফন করা হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে। যুক্তরাজ্যে অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ঘাতকের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।

সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে এসে আমরা চলে যাই মূল বসতভিটার উদ্দেশ্যে। এখানে বাড়িটিকে সংস্কার করে এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে যেনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সকল লোকজন এখনো জীবন্ত। খানিকক্ষণ পূর্বে ঘরে তালা দিয়ে কোথাও গিয়েছেন তাঁরা। বাড়ির বারান্দায় বিশাল একটি পেইন্টিং। এখানে পরিচয় হয় খুলনা থেকে আসা তরুণ নাজমুলের সাথে। নাজমুলের মূল বাড়ি মাগুরায়। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে খুলনার একটি কলেজে শিক্ষকতা করছে। খুলনা থেকে সে একাই এসেছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও সমাধিস্থল ঘুরে দেখার জন্য। আমাদের সঙ্গে বেশ সখ্য হয়ে যায় তার। আমরা যতক্ষণ ছিলাম নাজমুলও আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।

মূল বাড়ি দেখা শেষে আমরা পেছনের দিকে যাই। এখানে বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষের আদি বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই লিখেছেন:  “আমার জন্ম হয় টুঙ্গীপাড়ার শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন করেছিলেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলে ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালনগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোটসময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত।” 

আমরা এই পুরোন দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। এরপর সমাধি সংলগ্ন একটি কৃত্রিম ঝরনাধারার সামনে এসে দাঁড়াই। ঝরনাধারাটি যেখান থেকে পড়ছে সেখানে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত সেই কবিতাটি চোখে পড়ে। কবিতাটি ঢাকার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুরের সামনে লেকের পাড়ের একটি স্মৃতিস্তম্ভেও লেখা আছে: “যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

অন্নদাশঙ্কর রায় মূল কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি। যখন চারিদিকে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানের জেলে শেখ মুজিবুর রহমানকে যে কোনো সময় ফাঁসি দেওয়া হতে পারে। অন্নদাশঙ্কর রায় সেদিন গড়ের মাঠে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিবাদ এবং বাংলাদেশের পক্ষে সংহতি সমাবেশে বক্তব্য রাখার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে তিনি মূল সভাস্থলে আর পৌঁছাতে পারেননি। তবে ফিরে এসে লিখলেন এই অসাধারণ কবিতাটি। কবিতাটি লেখার পেছনে তাঁর আশঙ্কা এবং প্রচন্ড আবেগ কাজ করেছে, পাকিস্তানের জেলে শেখ মুজিবুর রহমানকে বোধকরি ফাঁসিই দিয়ে দেয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র-এই ভেবে! 

আমরা এরপর চলে আসি জাদুঘরে। এখানে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোকচিত্র, দলিল এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। পাশেই রয়েছে একটি সাজানো গোছানো গ্রন্থাগার। এখানে মূলত রাজনৈতিক ধারারই বইপত্র বেশি। গল্প-উপন্যাস-কবিতাও আছে। বেশিরভাগ বই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত। আমরা এখানে কিছু বই উল্টেপাল্টে দেখি। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস পাঠ করতে গেলে অনিবার্যভাবে আসবে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর অবদানের কথা। কারণ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রত্যক্ষভাবে এরাই ছিলেন তাঁর অগ্রজ নেতৃত্ব।

আমরা গ্রন্থাগার থেকে বের হয়ে এসে ছবি তুলে নাজমুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোটালিপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। এবারের গন্তব্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক ভিটা। অটোওয়ালা ইয়াছিন শেখ তখনো আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। ইয়াছিন আমাদের পৌঁছে দেয় কোটালিপাড়া যাওয়ার মাহেন্দ্র স্টেশনে। এখানে এসে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদের। কোটালিপাড়া যাওয়ার বাহন পেয়ে যাই। আরে! আবার দেখা নাজমুলের সঙ্গে। কী ব্যাপার? নাজমুল জানায়, সে মধুমতি নদীর ঘাট দেখতে এসেছে। এখান থেকেই নাকি বঙ্গবন্ধু ঢাকা বা কলকাতার উদ্দেশ্যে লঞ্চে যাত্রা করতেন। আমিও নাজমুলের সঙ্গে খানিকটা এগিয়ে নদীর ঘাট দেখে আসি। বুঝতে পারি, তরুণ নাজমুল বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশাল এক ব্যক্তিত্বের জীবন ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো পাঠ করার চেষ্টা করছে। 

আরেকবার নাজমুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোটালিপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। পথে যেতে যেতে কতো ভাবনাই না মাথায় আসে। ইতিহাস কীভাবে অবিসংবাদিত নেতা সৃষ্টি করে। আবার একজন নেতাও কীভাবে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারেন, এই ভাবনাও মাথায় ঘুরেফিরে আসে। সংখ্যায় বিরল হলেও পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নেতৃত্ব দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বও সময়কে ধারণ করে রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ এবং বাঁক বদল করতে সক্ষম হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভাগ্যও সুপ্রসন্ন হয়েছিল তাঁর। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে যে দীপ্ত উচ্চারণে জনসমুদ্রে জোয়ার সৃষ্টি করে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, এর মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্খা এবং স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন তিনি। যদিও পাকিস্তানের মতো দানবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ প্রস্তুতি তখন ছিল না বললেই চলে। শুধু দুঃসাহসের উপর ভর করে, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করা এবং বিপুল আত্মত্যাগই যুদ্ধের প্রাথমিক পর্ব অতিক্রম করেছিল এই জাতি। এরপর অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতিসহ আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ আমাদের দিকে ঘুরে যায়। উল্লেখ্য, ৭ই মার্চের ভাষণ আজ ইউনেস্কোর বিশ্বের ‘ডকুমেন্টারি ঐতিহ্য’ হিসাবে স্বীকৃত। 

কোটালিপাড়া যাওয়ার পথে বন্ধু সুজনের সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হয়। বঙ্গবন্ধু সময়ের দাবি যথার্থরূপে মেটাতে পেরেছিলেন বলে তিনি এতো বড়ো নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে সময়ের সন্তান। মানুষকে বুঝতে পারা, মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া, মানুষকে কাছে টানা ও ভালোবাসায় মোহাবিষ্ট করার মতো ক্যারিশমা এবং সবচেয়ে বড়ো যে গুণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দেওয়ায় তাঁর পক্ষে অনেক কিছু চলে এসেছিল। 

ব্রিটিশ আমলে কিশোর বয়সে তিনি স্বদেশীদের সঙ্গে বিশেষ করে সুভাষ বোসের সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই প্রতিবাদী এবং অনেক ক্ষেত্রে আপোসহীনতার কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। পরিণত বয়সে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বড় একটা সময় জেলে কাটিয়েছেন। তিনি ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তান আন্দোলন যেমন করেছিলেন সফলভাবে এবং পাকিস্তানপর্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও ৬ দফাকে জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন।  ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই মুক্তির ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠেন। তাইতো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে: ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। জনপ্রিয়তার পারদ তাঁর চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছেছিল বলেই ৭০-এর নির্বাচনে এতো বিপুল ভোটে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন তিনি। যা পাকিস্তানি শাসকচক্র কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি এবং তার ফলস্বরূপ পটভূমি তৈরি হয় ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের। 

আমি ও সুজন আলোচনা করি, যদি ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সব দল মিলে একটা ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করতে পারতো তাহলে কী হতে পারতো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ? বোধকরি, তখন ইতিহাসটা অন্যরকম হলেও হতে পারতো। হয়তো পরবর্তীতে ঘটতো না বহু বিভৎস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং রুখে দেওয়া যেতো নানা দেশী-বিদেশী চক্রান্ত! এমন ভাবনা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেবেছিলেন। দুর্বল অবস্থান থাকায় তা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। 

দুইপাশে বিশাল দুটি বাওড়ের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। ভাবনায় আসছে নানা কথা। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর স্মৃতিধন্য এলাকায় আসাটা যে প্রত্যেক ভ্রমণকারীর জন্য জরুরি, এ বিষয়ে আমি ও বন্ধু সুজন খুবই জোর দিয়ে একমত হই। যেতে যেতে মাহেন্দ্র চালকের কাছে জানতে চাই তার নাম। তিনি জানান, তার নাম বাবুল শেখ। আমরা বেশ অবাক হয়ে বলি, আপনাদের এলাকায় কী সবাই শেখ পরিবারের বংশধর নাকি? বাবুল শেখ রসিক মানুষ। জবাব দেন, আরে না মিয়াভাই, আমরা হচ্ছি প্রজা শেখ। ‘বঙ্গবন্ধুরা’ হচ্ছেন রাজা শেখ। বাবুল শেখের কথায় আমরা হেসে উঠি। আজ বড্ড বেশি ইতিহাস অনুসন্ধান এবং বঙ্গবন্ধুর করুণ মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমাদের মনের ভেতর দীর্ঘক্ষণ বিষণ্নতা তৈরি করে রেখেছিল। বাবুল শেখের কথায় খানিকটা মুক্ত হাওয়া বয়ে যায় আমাদের মনে। ইতোমধ্যে দুইপাশের বিশাল বিশাল মাঠ এবং জলাভূমি থেকেও বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির হিমেল হওয়া বইতে শুরু করেছে।