ভ্রমণ

মেরি এন্ডারসনে এক সন্ধ্যা

আমাদের মূল গন্তব্য ছিল নারায়ণগঞ্জের পাগলাঘাটের ভাসমান রেস্তোরাঁ মেরি এন্ডারসন। বন্ধুরা সবাই বিভিন্ন গন্তব্য থেকে এসে বাহাদুর শাহ পার্কে মিলিত হওয়ার কথা। আমার বাসস্থান উত্তর কমলাপুরের কবি জসীমউদ্দীন রোড থেকে হাঁটতে শুরু করি টিকাটুলী, ইত্তেফাকের মোড় হয়ে হাটখোলা মোড়ের দিকে। এখানে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এরপর ঢুকে যাই পুরান ঢাকার বিখ্যাত এলাকা উয়ারির চণ্ডীচরণ বোস স্ট্রিটে। এরপর ওয়্যার স্ট্রিট, বলদা গার্ডেন হয়ে খ্রিস্টান কবরস্থান ফেলে টিপু সুলতান রোডে। 

বেশ খানিকটা যাওয়ার পর বামদিকের একটি গলিতে ঢুকে দেখি এর নাম ভজহরি সাহা স্ট্রিট বা ভূতের গলি। এখানে এসে থেমে যাই। এই মহল্লার কোথাও থাকতেন প্রিয় লেখক শহীদুল জহির। এরপর শহীদুল জহিরের দেখানো পথ ধরে এগুতে থাকলে দেখি, ভজহরি সাহা রোড বা ভূতের গলি ছোট হয়ে এসেছে। খানিকটা ভেতরে যাওয়ার পর গলিটি আরো ছোট হয়ে তস্যগলিতে রূপ নেয়। অপরিচিত বলে দুই একটি গলিতে ঢুকে দেখি ওগুলো কানাগলি। বেরোবার পথ নেই। এসব কানাগলি থেকে বের হয়ে একটি দোকানের সাইনবোর্ডে দেখি এটি লালমোহন সাহা স্ট্রিট। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পাই একটি মসজিদ। মসজিদের পাশেই মন্দির। এলাকার নাম দক্ষিণ মৈশুণ্ডি।

এটি ধোলাইখাল পুকুরপাড়; যদিও পুকুরের কোনো অস্তিত্ব নেই এখন। মন্দিরের সামনের সরু গলিতেই ঢুকে পড়ি। সারি সারি অসংখ্য দোকান। শুক্রবার বলে প্রায় সবগুলো দোকান বন্ধ। দু’একটি দোকানে লেদমেশিন চলছে। আমি গলির ভেতর থেকে বের হতে পারবো কি না এই সংশয়ে একজন মুসল্লীকে জিজ্ঞেস করি- ভাই, বড় রাস্তায় কি বের হতে পারবো? তিনি ঢাকাইয়া ভাষায় বলেন, হ, বাইর হইতে পারবেন, গেইট খোলাই আচে, যানগা। 

গলির দু’পাশের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট অসংখ্য বন্ধ দোকানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটি গেট দিয়ে বের হয়ে ধোলাইখালের বড় রাস্তায় উঠে আসি। তাকিয়ে দেখি এটিও লালমোহন সাহা স্ট্রিট। বড়ো রাস্তার ফুটপাত ধরে খানিকক্ষণ হেঁটে আবার নারিন্দা রোডে ঢুকে পড়ি। নারিন্দার মোড়ে লানচাঁন সুইটস-এ ২৮ টাকায় প্যাকেজ নাস্তা সেরে আবারো হাঁটতে থাকি। এবার মূল সড়কে উঠে সোজা হাঁটতে হাঁটতে একজন লেদমেশিনের দোকান মালিককে জিজ্ঞেস করি- সদরঘাট যাওয়ার সহজ রাস্তা কোনটি? দোকান মালিক রাস্তা দেখিয়ে বলেন, উল্টোদিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে প্রথম যে মোচড়টা পড়বে সেটি হচ্ছে হৃষিকেষ দাস স্ট্রিট, এটি ধরে লক্ষ্মীবাজার রোড ধরে এগিয়ে গেলে ‘জগন্নাথ’ পেয়ে যাবেন। আমি তাই করি এবং খুব সহজেই বাহাদুর শাহ পার্কে পৌঁছে যাই। আমাদের গন্তব্য মেরি এন্ডারসন হলেও আজ সকালেই পুরান ঢাকার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে চলে গেলাম। ভাবছি, মেরি এন্ডারসনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো কি যে অপেক্ষা করছে! 

অপেক্ষাকৃত কাছে বাসস্থান ও হেঁটে আসার কারণে অন্য বন্ধুদের থেকে অনেক আগেই পৌঁছে যাই বাহাদুর শাহ পার্কে। আমাদের কথা ছিল বিখ্যাত কল্পনা বোর্ডিং-এ দুপুরের আহার সারবো। আমি আগাম খোঁজ নিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ ধরে, পোগোজ স্কুল ছাড়িয়ে শাঁখারি বাজারের আরো খানিকটা ভেতরে কালিমন্দিরসংলগ্ন কল্পনা বোর্ডিং-এ আসি। হতাশ হই জেনে করোনার শুরু থেকে রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে আছে। কল্পনা বোর্ডিং মূলত থাকার হোটেল। জানা গেলো, এখানকার একটি কক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বুকিং দেওয়া থাকতো সব সময়। এ ছাড়া মুজিববাহিনী নাকি এখানেই গঠিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন ভারতীয় ভিসাও এখান থেকে ইস্যু করা হতো। সুতরাং কল্পনা বোর্ডিং-এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য কম নয়। বায়ান্ন বাজার, তেপ্পান্ন গলির পুরান ঢাকা বরাবরের মতো আজও আমাকে বিচিত্র ইতিহাস ও রহস্যের জগতে নিয়ে যায়। ভালো লাগার জগতে নিয়ে যায়।

আবার ফিরে আসি বাহাদুর শাহ পার্কে। সিপাহী বিদ্রোহের স্মারক বাহাদুর শাহ পার্ক এখন উন্মুক্ত। একা একা বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ। ভাবনায় আসে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে লালবাগ দুর্গসহ আশেপাশের যারা জড়িত ছিল তাদের এখানে এনে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল, সেইসব বীরদের কথা। সিপাহীদের যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল তার নামও গোরে শহীদ মহল্লা। এলাকার মানুষ দীর্ঘকাল বিশ্বাস করতো অনেক সিপাহী তখন ‘ভূতে’ পরিণত হয়েছিল সেই সময়। আরেকজন প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে সেই প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন। আমার ভাবনার মধ্যে ছেদ পড়ে। একে একে বন্ধু বাকিউল, টিটু এবং সুজন এসে উপস্থিত হয়। আমরা আর দেরি না করে বইয়ের পাইকারী বাজার বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং আসি। এখানে দুপুরের খাবার গ্রহণ করবো। এক সময়কার কবি সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল বিউটি বোর্ডিং। আহার শেষে দেরী না করে যাত্রা শুরু করি ফতুল্লার পাগলা ঘাটের উদ্দেশ্যে। সদরঘাট থেকেই সিএনজি নিয়ে সাবেক ঢাক-নারায়ণগঞ্জ সড়ক ধরে পৌঁছে যাই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। 

এখানে এসে বিকেল থেকেই চারবন্ধু সুখ-দুঃখের নানা কথার মধ্যে ডুবে থাকি ‘দুঃখিনী’ বুড়িগঙ্গার তীরে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে না:গঞ্জের আরো দু’জন স্থানীয় বন্ধু। সুন্দর একটি নদীকে কীভাবে অকাল বার্ধক্যের দিকে ঠেলে দেয়া হয়, ধীরে ধীরে মুমূর্ষু করে হত্যা করা হয়, সেই কথাই ভাবছিলাম। নদীর জীবনের সঙ্গে বড়ো মিল খুঁজে পাই মানুষের জীবনের। এ দেশের মানুষও নদী ও প্রকৃতির মতোই বড়ো অকালেই বুড়িয়ে যায়। হারিয়ে যায় নদীরই মতো। এইসব ভাবতে ভাবতে মেরি এন্ডারসনের ডেকের উপর দাড়িয়ে পূর্ব দিগন্তের অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। একসময় সন্ধ্যা নেমে আসে। প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের মনেরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। 

ভাসমান জাহাজ মেরি এন্ডারসন চলতে শুরু করে। এতো বছর পর যেনো কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙে মেরি এন্ডারসন আবারো ‘প্রমোদতরী’ হয়ে দূষিত ও দখল হতে হতে ক্ষীণকায় বুড়িগঙ্গা থেকে বড়ো কোনো জলপ্রবাহের উদ্দেশ্যে ভাসতে শুরু করেছে? খানিকক্ষণ পর আমাদের ‘ঘোর’ কাটে। তাকিয়ে দেখি, একের পর এক দক্ষিণবঙ্গগামী লঞ্চ ভেসে যাচ্ছে। চলমান জাহাজের সাথে মনে হচ্ছিল মেরি এন্ডারসনও চলতে শুরু করেছে! আমাদের মনে খানিকক্ষণের জন্য ‘বিভ্রম’ সৃষ্টি হয়েছিল সেই মুহূর্তে। 

মেরি এন্ডারসন জাহাজখানি নিয়ে ইতিহাসের কিছু কথা না বললেই নয়। ১৯৩৩ সালে কলকাতার শিপইয়ার্ডে একটি বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত রকেট স্টিমার নির্মাণ করা হয়। প্রথমে এর নাম দেয়া হয় ‘স্টেট ইয়ট মেরী এন্ডারসন’। বাংলার ব্রিটিশ গভর্নরদের জন্য প্রমোদতরী হিসাবে জাহাজটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে বাংলার গভর্নর ছিলেন স্যার জন এন্ডারসন। ধারণা করা হয়, গভর্নরের মেয়ের নাম মেরি’র নামেই এর নামকরণ হয় মেরি এন্ডারসন। প্রথম নির্মাণের পর দীর্ঘ পথচলার মধ্য দিয়ে এটি এখন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তিনটি শাসন কালপর্বেই জাহাজটি হয় গভর্নর, না হয় প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতিদের প্রমোদতরী হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৬৬ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও এই প্রমোদতরীতে ভেসে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের নদীপথে। দীর্ঘ যাত্রার পর পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে জাহাজটিকে রূপান্তরিত করা হয় ভিন্নরূপে, ভিন্ন মাত্রায়। ১৯৭৮ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিআইডব্লিউটিএ’র পাগলা ঘাটে নোঙ্গর করা অবস্থায় চালু করা হয় ‘মেরি এন্ডারসন ভাসমান রেস্তোরাঁ ও বার’। পরিচালনার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। আজ অবধি এর কার্যক্রম অব্যাহত আছে। 

যদিও মাঝখানে একটা বড়ো ধরনের ছন্দপতন ঘটে গেছে। মেরি এন্ডারসন নামক মূল জাহাজটি চিরতরে হারিয়ে যায় একটি দুর্ঘটনায়। এখন মৃত মানুষের স্মৃতির মতো টিকে আছে শুধু নাম ‘মেরি এন্ডারসন’। এটি আর বিভ্রম নয়, নির্মম বাস্তব! ১৫ অক্টোবর, ২০১৪ সালে মেরি এন্ডারসনের নিচতলায়, সম্ভবত শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে জাহাজটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। সেইসঙ্গে ভস্মীভূত হয় ঐতিহ্যবাহী একটি নিদর্শন। এখন অবশ্য আরেকটি জাহাজ এম ভি সোনারগাঁও, একই স্থানে রেখে এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। পুড়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে ব্যবসাটা না হয় চালু থাকুক! তবে পুড়ে যাওয়া জাহাজটি কি এক রহস্যজনক কারণে এখনো পাশেই ভাসিয়ে রাখা হয়েছে! একটি বিশাল জাহাজের মরিচাধরা লালচে পাটাতন এবং ছোপ ছোপ ছাইকালো অংশবিশেষ যখন পানিতে ভেসে ওঠে তখন বহু ইতিহাসের সাক্ষী শতবর্ষীয় পুড়ে যাওয়া ঐতিহ্যের দিকে তাঁকিয়ে বুকের কোথায় যেনো একটা বেদনাও অনুভূত হয়! 

বন্ধু টিটু, বাকিউল, সুজন এবং নারায়ণগঞ্জের বন্ধু মিন্টু ও মাসুদের সাথে বিচিত্র বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আড্ডা হয়। আজ আমাদের বহু বছরের পথ চলা এক বন্ধু বাকিউলের জন্মদিন ছিল। তাই সারাদিনের ভ্রমণে ও উদযাপনে ভিন্ন একটি মাত্রা যোগ হয়। মেরি এন্ডারসনের ডেকে বসে ওপারে দেখা যায় আলোক ঝলমলে পানগাঁও কন্টেইনার বন্দর। ইতোমধ্যে একটার পর একটা লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে শুরু করেছে। সময় যতো বাড়ছে লঞ্চের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এদের গন্তব্য কোনোটি বরিশাল, কোনটি ভোলা, কোনোটি হাতিয়া। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রশস্ততা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এবং সদরঘাট থেকে পাগলা ঘাট একেবারেই কাছে হওয়ায় স্বল্প গতি ও দূরত্ব নিয়ে চলছিল জলযানগুলো। ভেঁপু বাজিয়ে একটা আরেকটাকে সতর্ক করছিল। সতর্ক করছিল ছোট নৌকা ও মালবাহী বার্জগুলোকেও। খানিক পর যখন এই জাহাজগুলো মেঘনায় পড়বে, তখন এদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে, ভিন্ন হয়ে যাবে রুট। 

নদীর কিনারে এলে বুঝি মানুষের মনের অর্গল খুলে যায়। বেরিয়ে আসে কত সুখস্মৃতি, যা হয়তো বহুবার বলা হয়েছে একে অপরকে। দুঃখের অকথিত কথামালা, যা কখনো কাউকে বলা হয়নি বলতে ইচ্ছে হয় তখন। মনের এমন মুক্ত বিহঙ্গের ডানার দীর্ঘ উড়াল দেওয়া হয় সমুদ্রের কাছে গেলে আরো বেশি। হয়তো এই কারণেই সমুদ্র মানুষের কাছে এতো প্রিয়। সমুদ্রের বিশালতার কাছে বারবার মন ছুটে যেতে চায়। গতিশীলতা, চলমানতা, পরিবর্তন ও রূপান্তর খুব চোখে পড়ে নদীর কাছে এলেও। নদীর কাছে এসে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য নদীগুলোকে তো সুস্থ ও সুন্দর রাখার কথা। আমরা তা করিনি। আমরা নদীকে বছরের পর অত্যাচার করে চলেছি। তাই নদীও আজ অভিমানে দ্রুত মরে যেতে চায়। যেভাবে অভিমান করে বৃক্ষরাও মরে যায়। 

রাত হয়ে আসছিল। আমাদেরও অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর সময় চলে এলো। এবার ফেরার পালা। স্থানীয় বন্ধুদের বাসা পাগলা ঘাটের  কাছেই, দেলপাড়ায়। আমাদের বাকি চারজনের গন্তব্য ঢাকা। পাগলঘাট থেকে ঢাকা খুব দূরে নয়, তবে এক একজনের ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্য, দূরত্ব এবং ঢাকার পীড়াদায়ক যানজট বিবেচনায় নিয়ে, আমরা রাতকে আর বেশি দীর্ঘায়িত না করে উঠে পড়ি।