ভ্রমণ

ভ্রমণে যেতে মাঈন সাজেন নিতান্ত গরিব-ভিখারি

সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা যুবক মাঈন উদ্দিন আহমদ। স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা হবেন। পাশাপাশি তিনি ঘুরে বেড়াতে চান দেশে-বিদেশে। ভ্রমণ তার কাছে নেশার মতো। যত প্রতিবন্ধকতাই থাক না কেন, ভ্রমণে তাকে যেতেই হয়, যেতেই হবে। এরই মধ্যে মাঈন ৬৪ জেলায় ঘুরেছেন। এমনকি শূন্য পকেটেও তিনি বহুবার পাড়ি দিয়েছেন দূরের পথ। এ জন্য সেজেছেন ‘নিতান্ত গরিব-ভিখারি’। 

মাঈন উদ্দিন আহমদের জন্মস্থান লক্ষ্মীপুর সদরে। বাবার চাকরির সুবাদে তিনি ঢাকা থাকেন। পড়ালেখা শেষ করেছেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্নাতক শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি শখের বসে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণ শুরু করেন। এখন পর্যন্ত তিনি দেশের ৪৮৫টি উপজেলায় পা রেখেছেন। এতে সময় লেগেছে দীর্ঘ সাত বছর।

২০১৭ সালের মার্চ থেকে তার ভ্রমণ শুরু। ভ্রমণের প্রয়োজনীয় টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন টিউশনি আর কোচিং সেন্টারে পড়িয়ে। সব সময় যে, টাকা সংগ্রহ করে তিনি ঘর ছেড়েছেন এমন নয়। পকেটে টাকা না থাকলেও তিনি ভ্রমণে বেরিয়েছেন। এ জন্য বিভিন্ন কৌশল নিতে তিনি দ্বিধা করেননি। কখনো দরিদ্র, কখনো বাস শ্রমিক, কখনো ভিখারি সেজেছেন। টাকা বাঁচাতে বেছে নিয়েছেন লক্করঝক্কর সস্তা গণপরিবহন। গাড়ির হেলপারকে বলে-কয়ে, অনুরোধ করে বসেছেন বাসের পেছনের সিটে, এমনকি ছাদে উঠে পাড়ি দিয়েছেন দূরের পথ। কখনো পরিচয় দিয়েছেন কারওয়ান বাজারের শ্রমিক, কখনো সেজেছেন হকার।   

এ নিয়ে মজার সব গল্পও আছে। একবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে পথে ট্রেনের দরজায় বসেছেন লুঙ্গি পরে, গায়ে গামছা। টিটি যথাযথ বিশ্বাস করেছেন- তিনি আসলেই দরিদ্র মানুষ। ফলে তিনি আর  ভাড়া চাননি। এছাড়া বাসের ছাদে, সবজির ট্রাকে, লঞ্চের মেঝেতে শুয়ে অনেকবার তিনি ভ্রমণ করেছেন। মাত্র ৫০০ টাকায় চারদিন ঘুরেছেন দুর্গাপুরের বিরিশিরি, জয়িন্তাপুরের লালাখাল, খইয়াছড়া ঝরনা। এমনকি অন্য পর্যটকের কাছ থেকে চেয়ে খেয়েছেন। কখনো খেয়েছেন রুটি-কলার মতো সস্তা কোনো খাবার। 

মাঈন বলছিলেন সেন্টমার্টিন ভ্রমণের কথা। মাত্র ১৯০০ টাকায় তিনি তিন রাত তিন দিন কাটিয়েছেন সেখানে। খাওয়ার জন্য একটি সস্তা রেস্তোরাঁ খুঁজে নিয়েছিলেন। কোনো হোটেল-মোটেলে রুম নেননি। নিজের ব্যাগ, মানিব্যাগ, মোবাইল জমা রেখেছিলেন ওই রেস্তোরাঁর এক কর্মীর কাছে। যাযাবরের মতো কাটিয়েছেন বিচে-বিচে, এখানে সেখানে। রাতে লুঙ্গি পরে ঘুমিয়েছেন বিচের বেঞ্চিতে। তবুও তিনি মাঝপথে ভ্রমণ ছেড়ে আসেননি। ইচ্ছামতো পুরোটা সেন্টমার্টিন ঘুরে তারপর বাড়ি ফিরেছেন।  

পাহাড়ের বুকেও বারবার চষে বেরিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবন, কক্সবাজারের জনমানবহীন স্থানগুলোতেও গিয়েছেন। ভ্রমণ গ্রুপ বিন্দাস, ভ্রমণকারীর দলের সঙ্গী হয়ে গিয়েছেন সাজেক, জাফলং, লালাখাল, ফয়েস লেক, রাতারগুল। এক্সপো মোর কিংবা চল ঘুরি গ্রুপের সঙ্গে তিনি ট্র্যাকিং করেছেন পাহাড়ে। বর্ষা-শীত-রোদ সবই তিনি গায়ে মেখেছেন, সয়ে নিয়েছেন।

মাঈন উদ্দিন বলেন, প্রতি মাসে টিউশনির টাকা থেকে কিছু অংশ জমিয়ে রাখতাম। দেখা যেত প্রয়োজনের থেকে কম টাকা জমা হয়েছে। কিন্তু মন মানত না। আমার এমন অভ্যাসের কারণে বাসা থেকেও আমাকে অতিরিক্ত টাকা দিত না। এছাড়া কোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে সেখানকার বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজন খুঁজতাম, যেন একবেলার ব্যবস্থা হয়। আর্থিক সংকট সত্ত্বেও এভাবেই ভ্রমণ করেছি দেশের সবকটি জেলা। 

ভ্রমণে গিয়ে প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি তিনি খেয়েছেন ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো। বিভিন্ন জেলার খাবারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুলনার আব্বাস হোটেলের চুইঝাল, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, চট্টগ্রামের মেজবানি, দিনাজপুরের কালাভুনা, জয়পুরহাটের দুধসহ অনেক মজাদার খাবারের স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বান্দরবনের পাহাড়ি মুরগির মাংস আর জুম চাষের চালের ভাত খুবই মজার ছিল। 

স্মরণীয় একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বান্দরবনের আলিকদম মারায়ন তং ক্যাম্পিংয়ে প্ল্যান ছিল রাতে বারবিকিউ করব। তবে রাত ৮টা বাজতেই তুমুল বৃষ্টি। দুই ভাই তাবুর ভেতরে দুই কোণ চেপে ধরে রেখেছি। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, সঙ্গে প্রচুর বাতাস। ভেবেছিলাম, তাবুর সঙ্গে আমরা উড়ে যাব। এক প্রকার ভয় ও আনন্দ কাজ করছিল। এর মধ্যেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, বুঝতেই পারিনি। রাত সাড়ে ১২টায় বৃষ্টি থামার পর বারবিকিউ আয়োজন শুরু হয়। তবে রাত দেড়টায় ফের মুষলধারে বৃষ্টি। সবাই আবার তাবুর ভেতরে। প্রচুর নাটকীয়তার পর রাত ৩টায় চোখে ঘুম নিয়ে চিকেন বারবিকিউ খেতে হয়েছে। 

ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, পাহাড় ট্রাকিং ছাড়াও বগুড়ার পোড়াদহ মেলা ও লালনের আখড়া ও নবান্ন উৎসব আমার কাছে ভালো লেগেছে। এমন বিভিন্ন সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানুষের বিভিন্ন আচার-আচরণ, একেক জেলার মানুষের একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি জানতে এবং শিখতে আমার মন সবসময়ই উৎসুক। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে শত শত পুরাতন ঐতিহাসিক স্থাপনা। এগুলো দেখাই হলো আমার মূল লক্ষ্য।

মাঈন উদ্দিন আরো বলেন, প্রতিটি মানুষের কম-বেশি ভ্রমণে যাওয়া দরকার। নিজেকে একটু ভালো রাখার জন্য হলেও ভ্রমণ জরুরি। ভ্রমণ হলো আত্মার খোরাক। ভ্রমণ মানুষের মনের জড়তা দূর করে।