নিস্তব্ধ ভোর নিশ্চুপ নয়। মানুষের আনাগোনা জানান দিচ্ছে আমরা পেতে যাচ্ছি অন্যরকম ব্যস্ততম একটি দিন। সেই ব্যস্ততার কেন্দ্রবিন্দু আম। ইটপাথরের নগরী ঢাকা থেকে মধ্যরাতে আমরা যখন সাপাহারের দিকে যাত্রা শুরু করি, তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল কেমন হবে আমরাজ্যে আমের বাজার, আমের বাগান? গাছে ঝুলে থাকা পাকা আম নিজ হাতে পেড়ে খেতে কতই না সুস্বাদু হবে?
উত্তরাঞ্চলের জেলা নওগাঁ ধান উৎপাদনের শীর্ষে। সেই জেলার সাপাহার এখন আমের বাণিজ্যিক রাজধানী। শুধু সাপাহার নয়- পত্নীতলা, পোড়শা উপজেলায় বিস্তৃর্ণ মাঠজুড়ে আমের বাগান। আমের বাগান রয়েছে নিয়ামতপুর ও বদলগাছি উপজেলাতেও। শুধু সাপাহারে ২০ হাজার আম চাষির ঘামে ভেজা ১০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আমের বাগান যেন এক স্বপ্নপুরী। জুন-জুলাই মাসে এ অঞ্চল হয়ে ওঠে আম উৎসবের কেন্দ্রস্থল। এ সময়টায় এখানে গড়ে ওঠে হাজার হাজার কোটি টাকার আমবাজার। শুধু গত বছরেই এখানে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লেনদেন এবং প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয়েছিল। আম রাজ্যে সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না, স্বপ্ন-সাধনা, আশা-প্রত্যাশা শুধু আমকে ঘিরে।
রোববার ২২শে আষাঢ়, আমরা যখন সাপাহার পৌঁছাই, তখন ভোরের আলো ফোটেনি। আমের আড়ৎ ও রাস্তার ধারে অস্থায়ী হোটেলগুলোর কর্মচারীরা সবে কাজ শুরু করেছেন। গাড়ি থেকে নামতেই পাকা আমের গন্ধে মন ভরে যায়। আমরা স্থানীয় হোটেলে রান্না করা স্থানীয়দের ভাষায় খিচুড়ি আনন্দে আহার করে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় গিয়ে বিশ্রাম করি। সকাল ১০টায় ডাকবাংলো থেকে বেরিয়েই একটি আমের আড়তে বেঁচাকেনা চোখে পড়ে। বর্ষার আকাশে মেঘ থাকলেও রোদ উঠেছে। বাতাসে যেন আমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে। ছোট দোকানের সামনে একজন পাকা আম আলাদা করে সাজিয়ে রেখেছেন। আম খাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই হালকা হাসিতে সম্মতি জানান তিনি। অমনি আমরা ৬ আম্রপ্রেমী ১৫-২০টি আম চেটেপুটে সাবাড় করলাম। তৃপ্তির ঢেকুর জানান দিল সার্থক মোদের এ আম্রআহার।
স্থানীয় আমের বাজার
আমাদের গন্তব্য আম চত্ত্বর। তিনটি আমের প্রতিকৃতি দিয়ে বানানো আম চত্ত্বরে উপজেলা নির্বাহী অফিস। প্রতিটি মোড়, প্রতিটি রাস্তার ধারে-ধারে শুধু আমের স্তূপ। আম্রপালি, বারি-৪, আশ্বিনা, ব্যানানো ম্যাঙ্গো আর গৌড়মতি আমের যেন এক বর্ণিল প্রদর্শনী চলছে। বেশির ভাগই আম্রপালি। আমের ভ্যান, আমচাষীদের সঙ্গে ছবি তুলতে তুলতে আমরা পৌঁছে যাই ইউএনও সেলিম আহমেদের অফিসে।
ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরবর্তী ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি সাপাহারে নিয়োগেও তিনি অখুশী নন এটা প্রমাণ তার স্বতঃস্ফূর্ততা। ছুুটির দিনে তার উপস্থিতি, আন্তরিকতা এবং স্বল্পকালীন আলাপে আম ও আমচাষীদের নিয় তার কর্মপরিকল্পনা আমাদের রীতিমতো মুগ্ধ করে। সাপাহার তথা নওগাঁর আম সম্পর্কে দেশব্যাপীকে জানাতে আগামী ১৮ ও ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই দিনব্যাপী ‘ম্যাংগো ফেস্টিভ্যাল ২০২৫’। ‘আমের বাণিজ্যিক রাজধানী সাপাহার, নওগাঁ’ এই স্লোগানে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এবং উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় উৎসবটি হবে সাপাহার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। আলাপ শেষে সুমিষ্ট আম্রপালিতে আপ্যায়িত হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি আমের বাজারে।
আমের বাজার বলতে উপজেলার রাস্তাঘাট। প্রধান-অপ্রধান সড়ক, অলি-গলি শুধুই আমের সমাহার। যতদূর চোখ যায় আমের গাড়ির দীর্ঘ লাইন। ঢাকায় আছে যানজট সাপাহারে আমজট। গাড়ির সঙ্গে কৃষক দাঁড়িয়ে। ভিক্ষুক ও তৃতীয় লিঙ্গ মানুষেরা একটি করে আম চেয়ে নিচ্ছেন, কেউ কেউ উঠিয়ে নিচ্ছেন নিজহাতে। গাড়িতে পাকা আম উঠিয়ে আমাকে খাওয়ার অনুরোধ করলেন কল্যাণপুরের আমচাষী কাশেম আলী। তিনি বললেন, এখানে পাকা আমের কদর নেই। বিক্রি হয় গাছ থেকে পাড়া কাঁচা আম। তার কথার সত্যতা মেলল রাস্তার দুইধারে পড়ে থাকা শতশত পাকা আম দেখে। এখানাকার মানুষেরা নাকি গাছ থেকে নিচে পড়া আম উঠিয়ে মুখে দেয় না।
আম বাগান থেকে আম পেড়ে খাওয়া
সময় গড়িয়ে দুপুর হয়। আমের বাগান দেখতে গাড়িতে চড়ে বসি। কিন্তু বিধিবাম। আমজটের রাস্তায় গাড়ি সামনে যাবে না। বাধ্য হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। টানা বৃষ্টিতে কাঁদা আর পচা আম মাড়িয়ে রাস্তায় হাঁটা অতটা সহজ নয়। কত কিলোমিটার যাবো জানি না। এনআরবিসি ব্যাংকের মাইক্রোফ্যাইনান্সের এরিয়া ইনচার্জ আশরাফ ভাই আমাদের একদিনের ট্যুরিস্ট গাইড। তিনি সামনে, আমরা পেছনে পিঁপড়ার লাইন করে হেঁটে চলছি। ঝুম করে নেমে এলো বৃষ্টি। আমের আড়তে আশ্রয় নিতেই থেমে গেলো বৃষ্টি। আবার চলা শুরু। আড়ৎ শেষ হতেই আমের বাগান। রাস্তার দুই ধারে নানাজাতের আম গাছ। আমাদের গন্তব্য আরেকটু দূরে। সাপাহার উপজেলা পার হয়ে আমরা পত্নীতলা উপজেলায় প্রবেশ করেছি। সেখানে ফিরতি যাত্রার স্থানীয়ভাবে নির্মিত একটি ছোট ট্রাকে আমের ক্যারেটের উপর গিয়ে বসে পড়লাম। কিছদূর গিয়ে অর্জনপুর রাস্তায় নেমে আবার হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার ধারে একটি আমবাগানে গাছে ঝুলে আছে টসটসে আম্রপালি। গাছের নিচে শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করছে, তাদের হাসিতে মিশে আছে আমের রসাল আনন্দ। স্থানীয় এক বৃদ্ধ চাষি বললেন, এই আম আমাদের নাড়ির টান। আমরা আম চাষ করি, তাতে চলে সংসার, হয় সঞ্চয়, হয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আদর করে তিনি আমাদের একটি কাটিমন জাতের পাকা আম হাতে ধরিয়ে দিলেন।
মোটামুটি দেড় কিলোমিটার পথ গিয়ে কাঙ্খিত আমের বাগানে পৌঁছালাম। রাস্তা থেকে আরও কয়েকটি বাগান পরে আমচাষী ইসমাইলের বাগান। আম বাগানের মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটার চিকন রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে ঘর্মাক্ত আমরা। তবুও ক্লান্তি নেই। ইসমাইলের বাগানে যাওয়ার পথে শেয়ালের আনাগোনা চোখে পড়লো। বাগানে পৌঁছে ঝুলে থাকা আম দেখে আমরা আহ্লাদিত। একসারি বারি-৪ আরেক সারি আম্রপালি। এভাবে ইসমাইল গড়ে তুলেছেন ৬ বিঘা আমের বাগান। ইসমাইল পাকা আমা পেড়ে দিতে শুরু করলো। আমরা ইচ্ছামত খাওয়া শুরু করলাম। দুপুরে অনাহারী পেট বস্তার মত ভরে গেল গাছপাকা টসটসে আম আহারে।
স্থানীয় আমের হাট
আম খাওয়া শেষে আমরা আবার ডাকবাংলোর পথ ধরি। রাস্তা ধরে যেতে যেতে দেখি, জায়গায় জায়গায় ট্রাকে আম তোলা হচ্ছে। রাস্তাজুড়েই আম আর আম। মনে হচ্ছিল, আমই যেন এ অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি- সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। সন্ধ্যায় ফিরে এলাম ডাকবাংলোয়। দিনব্যাপী আমের রোমাঞ্চ শেষে ক্লান্ত হলেও তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ। সাপাহারের আম শুধু একটা ফল নয়, এটি এ অঞ্চলের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, মানুষের স্বপ্নের প্রতীক। সন্ধ্যার পর ক্যারেট বোঝাই আম্রপালি নিয়ে ঢাকার পথ ধরি।
আমের সুবাস, মানুষের হাসি, আর বাজারের চঞ্চলতা সব মিলে সাপাহারে কাটানো এই দিনটি রুপসী বাংলার আরেকটি রূপ হিসেবে আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আজীবন।