যুদ্ধ দিনের স্মৃতি

নিয়াজির বৃথা আস্ফালন

|| তাপস রায় ||

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে দুই পাকসেনার কথোপকথন।

: আইয়ুব, ইয়াহিয়া যতই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করুক, বাঙালির বুদ্ধি আছে।

: বুদ্ধি না ছাই! বুদ্ধি থাকলে কেউ লুঙ্গি পরে যুদ্ধ করে?

: কিন্তু কাছা তো খুলে যাচ্ছে আমাদের।

 

একাত্তরে ডিসেম্বরের শুরু থেকেই মুক্তিসেনাদের বিপুল বিক্রমে কাছা খুলে যেতে শুরু করে পাকসেনাদের। সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় সেনা। ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমাণ্ড গড়ে তোলা হয়। শুরু হয় শত্রুর বিরুদ্ধে তুমুল আক্রমণ। সম্মিলিত বাহিনী ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে উত্তরবঙ্গে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ঢাকায় যাবার পথ প্রায় রুদ্ধ করে দেয়। এদিকে যশোর পতনের পর পাকবাহিনী মাগুরা হয়ে ফরিদপুরের দিকে পালাতে থাকে। তাদের একটি অংশ পালাতে থাকে খুলনার দিকে। যৌথ বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। কুষ্টিয়ায় মিত্রবাহিনী শত্রুর ওপর আক্রমণ চালালে তারা অবস্থান ছেড়ে নাটোর ও পাবনার দিকে পালিয়ে যায়। অর্থাৎ শত্রুর পতন যে সময়ের ব্যাপার তা স্পষ্ট হতে শুরু করে এ সময় থেকেই।

 

বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটার খবর আসতে থাকে। ওদিকে পরাজয় ঘনিয়ে আসছে জেনে জাতিসংঘে চলতে থাকে পাকিস্তানের অপতৎপরতা। জাতিসংঘ থেকে ১০ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হয়- সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ভারতের তখন অন্য সুর। মিসেস গান্ধী নয়াদিল্লি থেকে স্পষ্টতই যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান এড়িয়ে যান। তার দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। তাহলে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবের ভবিষ্যত কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া যায় ইন্দিরা গান্ধীর কঠোর জবাব। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্পূর্ণ হবে, যখন ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে।

 

বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবার আশঙ্কায় ভেতরে ভেতরে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তানি জেনারেলরা। ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খান তখন বেসামাল। ঢাকায় জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলীরা দিশেহারা। খবর আসতে থাকে চারদিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে সম্মিলিত বাহিনী। স্বাভাবিকভাবেই তখন জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে প্রচণ্ড যুদ্ধ হবে সেই শঙ্কায়। বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যেতে শুরু করে। যদিও ঢাকার আশপাশের এলাকা তখন মুক্ত।  

 

এমন অবস্থায় জাতিসংঘের অনুরোধে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা এক সকালে সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। উদ্দেশ্য বিদেশী নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা করা। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধ বিরতি ও পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘ সদর দফতরে জরুরি আবেদন জানান। ওদিকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স দ্রুত বঙ্গোপসাগরের দিকে আসতে শুরু করেছে। আর তাতেই পাল্টে যায় তাদের সুর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, আত্মসমর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

 

সমস্ত দেশ যখন প্রায় হাতছাড়া, নিজের সৈন্যরা প্রতিটি রণাঙ্গনে মার খেয়ে নাস্তানাবুদ, একের পর এক অবস্থান ত্যাগ করে পালাচ্ছে তারা ঠিক তখনও ঢাকা সেনানিবাসে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে জেনারেল নিয়াজি হুংকার দিচ্ছেন, একটি প্রাণ জীবিত থাকা পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তখন তাদের পিছু হটার পালা। পালানোর সময় তারা যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইতিহাসে তার তুলনা পাওয়া যায় না। প্রথমে তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অবাধ লুণ্ঠন। তারপর রাগে-ক্ষোভে প্রতিশোধ নিতে গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয় তারা।

 

১২ ডিসেম্বর রাতে প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আল-বদর ও আল-শামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের ডেকে পাঠান সদর দফতরে। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় গোপন শলাপরামর্শ। এই বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়। ফরমান আলী তাদের হাতে তুলে দেন একটি তালিকা। তালিকায় দেশের বুদ্ধিজীবীসহ কৃতী সন্তানদের নাম ছিল। পরদিন থেকেই শুরু হয় বাঙালিকে মেধাহীন করার সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞ। পরাজয় নিশ্চিত জেনেই তারা এই হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল। এই আল-বদর ও আল-শামসের সদস্যরা ছিল দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য। বাহিনী দুটি রাও ফরমান আলীর ব্রেইন চাইল্ড।

 

ওদিকে মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল অরোরা যৌথ বাহিনীকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা মুক্ত করার নির্দেশ দেন। কারণ ঢাকা মুক্ত হলেই পাকিস্তানি বাহিনীর বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলো স্বাভাবিকভাবেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার পতন যতোই ঘনিয়ে আসতে লাগলো পাকসৈন্য ও তাদের দোসরদের বুদ্ধিজীবী হত্যার তৎপরতা ততোই বাড়তে লাগল।  

 

যুদ্ধের এ অবস্থায় যৌথ বাহিনী যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। যেহেতু সামনে বিজয় অপেক্ষা করছে, তাই যৌথ বাহিনী জানমাল ও সময় নষ্ট করতে চাইছিল না। লক্ষ্য তখন একটাই, যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা জয় করা। বলে রাখা ভালো, যৌথ বাহিনীর আক্রমণের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা বাধা দেওয়ার পরিবর্তে দলে দলে আত্মসমর্পণ করেছে। কিছু জায়গায় তারা একটিও গুলি না ছুড়ে অস্ত্র সংবরণ করেছে। এসব খবর যত প্রচার হতে থাকে ততোই  ঢাকায় অবস্থানরত পাকসেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এর মধ্যে একদিন বিবিসি থেকে প্রচারিত এক খবরে বলা হয়, নিয়াজি সৈন্যদল ফেলে রেখে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন।

এ খবর শুনে নিয়াজি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে চিৎকার করে বলেন, কোথায় বিবিসির লোক? আমি তাকে বলতে চাই, আমি এখনও পূর্ পাকিস্তানে আছি।  আমি কখনও এভাবে জওয়ানদের ফেলে যাব না।

 

তারপরও সবাই জেনে যান, এ অবস্থায় বাঁচার একমাত্র পথ আত্মসমর্পণ। ১৩ ডিসেম্বর রাতে গভর্নর ডা. মালিক আত্মসমর্পণের অনুমতি চেয়ে ইসলামাবাদে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি তারা বার্তা পাঠান। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই বার্তা নাকচ করে দিয়ে জানান, নিশ্চয় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করবে। তিনি নির্দেশ দেন, ‘অপেক্ষা করো এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাও।’

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা