যুদ্ধ দিনের স্মৃতি

কতটুকু রক্ত ঝরলে খেতাব পাওয়া যায়?

এম এ রহমান : ২০ আগস্ট ১৯৭১। যে স্বপ্ন নিয়ে সেদিন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান দেশকে শত্রুমুক্ত করতে অসীম দেশপ্রেমে ও সাহসিকতায় বিমান উড়িয়েছিলেন, সেদিন ৯ নম্বর সেক্টরে বাংলার মাটিতে সহযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য শত্রুকে রুখে দিতে অনেকটা একাই দাঁড়িয়েছিলেন আরেকজন মানুষ।

 

তিনি সাব সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস খান। এজন্য তাকে দিতে হয়েছে প্রাণ।

 

স্বাধীনতার পরে শহীদ ইলিয়াস খানকে সেভাবে মনে রাখেনি কেউ। এই মৃত্যুহীন প্রাণ পায়নি তার প্রাপ্য সম্মান। বীরত্ব সূচকে ভূষিত হয়নি। কিন্তু ইলিয়াস খান ও তার পরিবারের ত্যাগ, সেই ঋণ কীভাবে শোধ করবে মাতৃভূমি। যদিও কোনো পদক প্রাপ্তির আশায় জীবন উৎসর্গ করেননি তিনি।

 

মাতৃভূমির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন যে যোদ্ধা, সেই যোদ্ধার শোকাহত পরিবারের আক্ষেপ, ‘কতটুকু রক্ত ঝরলে, একটি খেতাব পাওয়া যায়।’

 

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিন তিনটি সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস খানের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার উজ্জ্বল ইতিহাসের বিবরণ নিয়ে আজকের আয়োজন-

 

এক সময়ের নদীয়া বর্তমান কুষ্টিয়ায় জন্ম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস খানের। ১৯৩৬ সালের মে মাসে জন্ম নেওয়া এই যোদ্ধার ছেলেবেলা কাটে সেখানেই। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন তিনি। ছাত্রজীবন শেষ করার আগেই বিলুপ্ত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) হিসেবে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হন ইলিয়াস খান। পারিবারিক সূত্রে বিয়ে হয় নড়াইল জেলার নূরুল হক গাজীর মেয়ে শাহিদা বেগম হেনার সঙ্গে।

 

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি বেনাপোলে ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অসীম সাহসীকতার সঙ্গে লড়াই করে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে খেতাব লাভ করেছেন। পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেও বঞ্চনার স্বীকার হন ইলিয়াস খান। শেষমেষ পশ্চিম পাকিস্তানি এক মেজরের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেন এবং ১৯৬৭ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন তৎকালীন সুবেদার ইলিয়াস খান। এরপর খুলনায় ক্রিসেন্ট জুট মিলসে কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন।

 

সে সময়ে ছয় দফা ও গণ অভ্যুত্থান সবকিছুই ইলিয়াস খানকে প্রভাবিত করে। ইপিআরের চাকরি ছাড়ার পরই সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এ সময় প্রায়ই মনের নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা স্ত্রী হেনার সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন।

 

সত্তরের নির্বাচনের পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র চলছিল তখন কী মনে করে শিশু সন্তান আর অসুস্থ স্ত্রীকে নড়াইলে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু নিজে থেকে যান খুলনায়।

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরের দিন ৮ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক ও জনতাকে খুলনায় ক্রিসেন্ট জুট মিলের ফুটবল মাঠে যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। এ সময় জুট মিলের শ্রমিক সংগঠনের নেতা হাবিবুর রহমান, কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম ও অধ্যাপক সুফিয়ান (যিনি এমপি মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী) তার সঙ্গে ছিলেন। ওই সময় খুলনায় বাঙালিদের ওপর হামলা হয়। ইলিয়াস খান তখন অবাঙালি ম্যানেজারের অস্ত্র ছিনিয়ে নেন এবং বাঙালিদের ভৈরব নদী পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সাহায্য করেন।

 

১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইলিয়াস খান নড়াইলে তার শ্বশুর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি প্রতিদিনই তার ছয় ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিওতে আকাশবাণী কলকাতা, বিবিসি এবং ভয়েস অফ আমেরিকার খবর শুনে দেশের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনে মনে সাহস অর্জন করে সবার অগোচরে আবারো সেখানেই মুক্তিযোদ্ধা তৈরির কাজ শুরু করেন। এলাকার যুবক এবং সামর্থ্যবান পুরুষদের যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন।

 

শুরু হয় নড়াইলের কালিয়া উপজেলার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষণের কৌশল ও স্থান পরিবর্তন করেন মাঝে মধ্যেই। কারণ, ওই সময়ে পাকিস্তান আর্মি গ্রামে গ্রামে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। সেখানে তৎকালীন এমপি এখলাস সাহেবের সঙ্গে ইলিয়াস খানের যোগাযোগ হয়। এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য বেশ সাড়া পান তিনি। ট্রেনিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধও চলতে থাকে। এ সময় ভাটিয়া পাড়া, কালিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালান ইলিয়াস খান।

 

১৯৭১ সালের মে মাসের এক সন্ধ্যা। ইলিয়াস খান তখন শশুর বাড়িতে। রাতে খাবার শেষে স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু সেটা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। রাত বারোটার দিকে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। না খুললে ভেঙে ফেলার হুমকি দেয় আগত ব্যক্তিরা। ইলিয়াস খান পরিবারের বুঝতে আর বাকি রইল না আগাতরা রাজাকার বেশধারী ডাকাত। দরজা খুলতেই দরজার দুইপাশে ইলিয়াস খান এবং হেনাকে দাঁড় করিয়ে দুজনের বুকে দুটো বন্দুকের নল চেপে ধরে ডাকাতরা। মুহূর্তেই এক ঝটকায় রাইফেল কেড়ে নিয়ে স্ত্রীর সামনের ব্যক্তিকে লাথি মেরে ফেলে দেন ইলিয়াস খান। স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে ইলিয়াস খান বলেন ‘পালাও’।

   

শুরু হয় রাজাকারদের সঙ্গে মারমারি। ডাকাতদের সর্দার ছিল পাশের গ্রামের মনসুর বিশ্বাস। রাইফেলের বাট দিয়ে আবছা অন্ধকারে তিনি প্রায় সকলকেই ধরাশায়ী করে ফেলেছিলেন। মারামারির একপর্যায়ে ইলিয়াস খান পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে গুলি করার জন্য যখনই ট্রিগারে চাপ দেবেন তখন রাজাকার বাহিনীর একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দশ বারো জন সেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পানির নিচে চেপে ধরে। শুরু হয় ইলিয়াস খানের সঙ্গে তুমুল ধস্তাধস্তি।

 

এদিকে স্ত্রী হেনা অন্ধকারে দৌঁড়ে কাছাকাছি তার এক চাচার সাহায্য চেয়েও পাননি। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুকুরে কর্দমাক্ত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে রাজাকার মনসুর বিশ্বাস রাইফেলের বাট দিয়ে ইলিয়াস খানের মাথায় সজোরে আঘাত করে। সেই সিঁড়িতে পড়ে গেলেন ইলিয়াস খান। এবার রাজাকারের দল একের পর এক আঘাত করে ইলিয়াস খানের শরীরে। মৃত মনে করে দ্রুত পালিয়ে যায় ওই রাজাকাররা।

 

এদিকে শাহিদা বেগম ও তার ভাইসহ গ্রামের লোকজন বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। ইলিয়াস খান প্রাণে বাঁচলেও সমস্ত শরীর রক্তে ভেসে যায়। তবে মাথার বাম দিকের আঘাত ছিল মারাত্মক। ঘরে কোনো ওষুধ না থাকায় রান্না ঘর থেকে হলুদ নিয়ে লাগিয়ে ও পরনের শাড়ি ছিড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা হয় ইলিয়াস খানের মাথায়। অঝোরে কাঁদছেন স্ত্রী ও তার বড় মেয়ে শিউলি। এত কিছুর পরও ইলিয়াস বলেন, ‘চিন্তা করো না, আমি ভালো হয়ে যাবো।’

 

শুধু কি তাই, রাতে আরো একদল ডাকাত আসে ইলিয়াস খানের বাড়িতে। তাদের হাতে অস্ত্র দেখে হেনা মনে করেন এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সাহায্য করতে এসেছেন। তাই স্বামীর দিকে না তাকিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, আপনারা কেন এত দেরি করে এলেন! বলেই শব্দ করে কাঁদতে থাকেন। কিন্তু যখন ডাকাত নেতা ঈমান বলে উঠল ‘আপনি আমাদের চিনেন?’ তখন সবাই বুঝতে পারে এরা মুক্তিযোদ্ধা নয়, ডাকাত। এমনকি ঈমান ডাকাতকেও চিনতে পারে। ইলিয়াস খানের আশঙ্কা তার স্ত্রী ডাকাতদের চিনে ফেলেছেন তাই মৃত্যু অবধারিত।

 

কিন্তু না, ডাকাত দল আহত লোক ও লণ্ডভণ্ড ঘর দেখে বুঝতে পারে নেওয়ার মতো কিছু নেই। তারা বাইরে এসে বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরের দিন সকালে অনেক দূর থেকে আসা ডাক্তার ইলিয়াস খানের চিকিৎসা শুরু করেন।

 

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইলিয়াস খানের বড় মেয়ে ও বর্তমানে দুদকের উপপরিচালক সেলিনা পারভীন শিউলি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বাবাকে ডাকাত দল অত্যাচার করেছে, তাতে তিনি ওখানেই মারা যেতে পারতেন। এত অত্যাচারের পর অন্য কেউ হলে যুদ্ধ যাওয়ার চিন্তা করতেন না। কিন্তু ইলিয়াস খান ছিলেন বীর। তিনি চেয়েছেন যে কোনো কিছুর বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা।

 

শরীর একটু সুস্থ হতেই ইলিয়াস খান নিয়মিত বিভিন্ন অপারেশনে যেতে শুরু করলেন। তার বাড়িতে আক্রমণকারী ওই রাজাকার ডাকাতদেরকে অপারেশন চলাকালে পেলেও ডাকাত সরদার মুনসুরকে খুঁজে পাননি।

 

একপর্যায়ে নয় নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে ইলিয়াস খানের যোগাযোগ হয়। ইপিআর বাহিনীতে চাকরি করার সময় থেকে জলিল সাহেব তার পরিচিত ছিলেন। জলিল সাহেব ইলিয়াস খানকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ ও সীমান্তে যুদ্ধ অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। এরপরই তিনি ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

 

পরবর্তী সময়ে মেজর জলিল ও অনেকের অনুরোধে ভারতে প্রশিক্ষণ শিবিরের দায়িত্ব নেন ইলিয়াস খান। এরপর তিনি ৭নং সেক্টরের মেহেদীপুর সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেশকিছু দিন। কিছুদিন পর বীরশ্রেষ্ঠ  মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের হাতে মেহেদীপুর সাব সেক্টরের দায়িত্ব দিয়ে তিনি চলে যান নয় নম্বর সেক্টরে। সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে বিভিন্ন শিবিরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপারেশনেও যোগ দেন।

 

নয় নম্বর সেক্টরে যোগদানের পরে ইলিয়াস খান হিঙ্গলগঞ্জ, টাকি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে অংশ নেন।

 

ইতিমধ্যে ইলিয়াস খান ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন নড়াইল, গোপালগঞ্জ এবং ফরিদপুর অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন।

   

বিভিন্ন বই এবং তার সহযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্য এবং ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধের যেসব দলিল সংগৃহীত হয়েছে সেখানে দেখা যায়, সাত নম্বর সেক্টরের মেহেদীপুর সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ইলিয়াস খান দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে সফলতার সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন।

 

এ সময় মেজর জলিল আবারও তাকে নয় নম্বর সেক্টরে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি মেহেদীপুর সাব সেক্টরের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে দিয়ে (যিনি শহীদ হন এবং বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পান) নয় নম্বর সেক্টরে এসে সেই একই কাজ করেন।

 

১৯৭১ সালে সাতক্ষীরা অঞ্চলে রাজাকারের অত্যাচার বেড়ে যায়। এ সময় ইলিয়াস খান, লেফটেন্যান্ট বেগ ও ক্যাপ্টেন হুদার বাহিনী যৌথ আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। তাদের প্রতিরোধে রাজাকার আলবদর এলাকা থেকে সরে যায়। এ সময় আটক হয় ৪৫০ জন রাজাকার। শ্যামনগর থানায় মুক্তিবাহিনী অবস্থান নিলে এলাকাটি মুক্তাঞ্চল হিসাবে গণ্য হয়।

 

২০ আগস্ট ১৯৭১। স্থানীয় এমপি ফজলুল হকের পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরলেন। সেই মাছ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকদিন পরে সুস্বাদু খাবার খান। তবে খাবার খাননি ইলিয়াস খান। সহযোদ্ধা খাজা সাহেব একটা প্লেটে ভাত, বাটিতে মাছের ঝোল আর ডাল নিয়ে ইলিয়াস খানের রুমে এসে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ইলিয়াস খান বলেন, ‘মন ভালো নেই। স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য খুব খারাপ লাগছে।’ খাজা সাহেব জোর করায় এক টুকরো মাছ খেয়েছিলেন ইলিয়াস খান। ওটাই ছিল তার জীবনের শেষ খাবার।

 

ওই দিন রাত আনুমানিক তিনটা। অজ্ঞাত কারণে ইলিয়াস খানের ঘুম ভাঙে। বাইরে আসতেই নজরে আসে ডিম লাইট জ্বালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বহর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের কাছাকাছি চলে এসেছে। হুইসেল বাজিয়ে সকলকে জীবন বাঁচাতে বললেন তিনি। সামনে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর মর্টার শেল নিক্ষেপ করে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকটা দিকভ্রান্ত হয়ে যায়।

 

এ সময় ইলিয়াস খানের সঙ্গে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল কাদের নামের দুই জন ইপিআর সদস্য এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ ছাড়া ছিলেন একজন গুলি বহনকারী মুক্তিযোদ্ধা বরকত। তুমুল যুদ্ধ আর বৃষ্টির মতো গুলি চলে। মুক্তিযোদ্ধারা সকলে অনেকেই নিরস্ত্রভাবে প্রাণ বাঁচাতে থাকেন। কিন্তু ইলিয়াস খান তার চার সহযোদ্ধাকে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাধের দুইপাশে পাক বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধা মুখোমুখি। ভোর হয়ে আসছে কিন্তু চলছে যুদ্ধ। ইতিমধ্যে সহযোদ্ধা তিনজন শহীদ হয়েছেন। একা লড়াই করে যাচ্ছেন ইলিয়াস খান।

 

গুলি এগিয়ে দিতে দিতে সহযোগী ছেলে বরকত বলে, ‘স্যার আর গুলি নাই।’ ইলিয়াস খান নির্দেশ দেন যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কাছে যে গুলি আছে সেগুলো নিয়ে এসো। কিন্তু বরকত গুলির শব্দে তার কথা বুঝতে পারেননি।

   

ইতিমধ্যে পিছনে জয় বাংলা ধ্বনি শোনা গেল। ইলিয়াস খান যখন পিছনে ফিরে দেখতে যান ঠিক তখনই একটা গুলি তার কানের পাশ দিয়ে চলে যায়। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ওরা মুক্তিযোদ্ধা না, রাজাকার। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কোনোভাবেই ধরা দেবেন না। দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গুলি চালান।

 

আট জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। কিন্তু এজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাকে। একঝাঁক গুলি এসে লাগে তার বুকে। লুটিয়ে পড়েন কাদা জলের সাথে রক্ত মাখা মাটির ওপর। তখনও বেঁচে আছেন গুলি এগিয়ে দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা বরকত। তিনি ইলিয়াস খানের গুলিবিদ্ধ দেহ বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একজন দেশপ্রেমিক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার মা জানতে পারলেন না যে, একমাত্র সন্তান ইলিয়াসের ছয় ফুট লম্বা ধবধবে ফর্সা গায়ের রং রক্তে লাল হয়ে গেছে।

 

এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে পাকিস্তানিরা এগিয়ে আসে। ইলিয়াস খানের লাশের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধা বরকত। হানাদাররা বরকতের দেহটি লাথি মেরে ফেলে দেয়। কিন্তু রাগ ঝাড়তে ইলিয়াস খানের মৃতদেহের ওপর আবারো গুলি চালায়। সমস্ত বুক একেবারে ঝাঁজরা করে দেয়। কিন্তু এই গুলির একটিও লাগেনি বরকতের গায়ে। তিনি বেঁচে থাকলেন সত্য বলার জন্য।

 

যেহেতু ইলিয়াস খানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি ঐ এলাকায় ছিল না, তাই পড়ে ছিল লাশ। স্থানীয় বাসিন্দা মেহেরউল্লা গাইন ও আরো কয়েকজন দুপুরে নামাজের পরে এগিয়ে আসেন। চারটি লাশ সেই ধানক্ষেতে কবর দেওয়া হয়।

 

ইলিয়াস খান যেদিন এই অঞ্চলে যুদ্ধে যান, সেদিন মেজর জলিলকে বলেছিলেন যে, তিনি যদি কোন যুদ্ধে শহীদ হন তবে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তার মৃত্যু সংবাদ যেন তার পরিবারের কাছে না দেওয়া হয়। মেজর জলিল তার কথা রেখেছিলেন। তিনি ইলিয়াস খানের শ্যালককে খবরটা দেন। কাউকে জানাতে নিষেধ করেন।

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইলিয়াস খানের বাবা মোবারক হোসেন খান নিজে ছেলের খোঁজ করতে করতে শ্যামনগর যান। ছেলের শহীদ হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ইচ্ছায় তার কবর ছেলে ইলিয়াস খানের কবরের পাশে কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

 

বাবার সাহসিকতার বর্ণনা করতে গিয়ে ইলিয়াস খানের বড় মেয়ে সেলিনা পারভীন শিউলি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার বাবা দেশের জন্য শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন। সে সময় তিনি তার স্ত্রী ও ছোট ছোট তিন সন্তানের দিকে না তাকিয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দেশের জন্য আর কী করলে বীর খেতাব পাওয়া যায় আমার জানা নেই। তবে আমাদের পরিবারের এই আক্ষেপটা কাজ করে। আমার মা আজ পাগল প্রায়। এখনো তিনি বাবার জন্য অপেক্ষা করছেন।

 

সেলিনা পারভীন শিউলি বলেন, ‘আমি অনেক ছোট ছিলাম। আমি দেখেছি আমার মা কতটা কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। আমি আমার মা, বাবার জীবিত সহযোদ্ধা ও বিভিন্ন বই থেকে আমার বাবার যুদ্ধের কিছু কাহিনী সংগ্রহ করেছি। এখনো তথ্য সংগ্রহ করছি।’

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৬/এম এ রহমান/সাইফ/শাহনেওয়াজ