বিশ্ব বাতায়ন

এই করোনাকালে জাপানের কাছ থেকে যা শেখার আছে

দিন যত গড়াচ্ছে পৃথিবীতে করোনা রোগী বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এ ভাইরাস কোথায় গিয়ে থামবে কেউ বলতে পারছেন না। পৃথিবী আজ থমকে আছে। তবে আশা এতোটুকুই- মানুষের সচেতনতা। যে যত সচেতন এ ভাইরাস থেকে তার বাঁচার সম্ভাবনা তত বেশি। করোনা এমন এক ভাইরাস যা মানুষের মাধ্যমে ছড়ায়। এ জন্য যতটা সম্ভব সচেতন হওয়াই একমাত্র মুক্তির উপায়।

জাপানে করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় প্রথমবারের মতো জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটি। টোকিও, ওসাকাসহ সাত প্রদেশে ৬ মে পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। ৭ এপ্রিল থেকে আগামী ১ মাসের জন্য টোকিও, ওসাকাসহ আরও ৫টি প্রিফেকচারে স্টেট অব ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকবে।

প্রিফেকচারগুলো হলো- টোকিও, সাইতামা, কানাগাওয়া, চিবা, ওসাকা, হিওগো এবং ফুকুওকা। জরুরি অবস্থা ঘোষিত অঞ্চলের গভর্নররা বাসিন্দাদের বাড়িতে অবস্থান করতে বলেছেন। তবে ‘অতি প্রয়োজন’ হলে কেউ বের হতে পারবেন। গভর্নররা বিদ্যালয় এবং বৃহৎ আকারের সমাবেশ বন্ধের জন্যও অনুরোধ করতে পারবেন।

মাসব্যাপী এ ইমার্জেন্সিতে বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাসের পাশাপাশি সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান, ব্যাংক, পোস্ট অফিস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ইমার্জেন্সির আওতামুক্ত থাকবে। তবে মজার বিষয় হলো, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ থাকার কোনো ঘোষণা নেই। মানুষ বাহিরে বের হলেও কোনো শাস্তির ব্যবস্থা হবে না। এই দেশের সাংবিধানিক অগ্রাধিকার বলে- জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখাই হলো মূল কাজ। কিন্তু সরকার প্রধানের জনগণের প্রতি আস্থা আছে। তারা সরকারের চেয়ে সচেতন। এখানকার প্রত্যেক নাগরিক সরকারের ভাষা বোঝে। সরকার নাগরিকদের কেবল অনুরোধ করলেই তারা বুঝতে পারে- সরকার কি চাইছে। নির্দেশ দিতে হয় না।

তাই এদেশে পুলিশ লাঠি চালায় না। কোনো অফিসার চাইলেই জনগণের কান ধরতে পারেন না। জরিমানা আদায় করতে পারেন না।

সরকার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বলছে, তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নাও। প্রতিষ্ঠানগুলোও কোনো কঠিন আইন দিচ্ছে না। বলছে, নাগরিকদের আচরণেই করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব। এমনভাবে অনুরোধ করছে- অফিসে যেতে বলছে নাকি নিষেধ করছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। বলছে, খুব যদি দরকার না হয় তাহলে ঘর থেকে বের না হওয়াই উত্তম। হ্যাঁও বলবে না, নাও বলবে না। এই জাতির প্রত্যেকে এই ভাষা বোঝে। কখন ‘হ্যাঁ’, আর কখনও ‘না’।

প্রয়োজনের বাইরে একজন মানুষকেও বাইরে যেতে দেখা যায় না। জাপানে চলছে এখন বসন্ত। সাকুরা বা চেরি ফুলের সমারোহ চারদিকে। যে ফুলের মৌসুমে মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে পার্কগুলো। সেখানে এখন সুনশান নীরবতা। জাপানের মানুষ এমনিতেই সবসবময় পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকে। বাসা-বাড়ি, কর্মস্থল নিজেরাই পরিষ্কার করে। যার জন্য এখানে আলাদা কোনো কাজের লোকের প্রয়োজন হয় না। এখানে রাস্তায় ধুলা-বালি না থাকলেও অন্য সময়গুলোতে মাস্ক ব্যবহার করতে হতো। এখন তো প্রত্যেক নাগরিক মাস্ক ব্যবহার করছেন। বাসা-বাড়ি, দোকান, সুপারশপ এবং অফিসের প্রবেশপথে জীবাণুমুক্ত স্যানিটাইজার রাখা আছে, যাতে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের ভাইরাস ছড়াতে না পারে।

এদিকে জাপানে করোনার ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলে দেখা গেছে, যাদের বয়স কম তাদের জন্য আভিগান প্রয়োগে রোগী ৭ দিনে সুস্থ হয়ে যায় এবং পিসিআর ফলাফল নেগেটিভ। এটা জাপানের ১২০ জন রোগীর উপর প্রয়োগের ফল। যারা মধ্যম বয়সী তাদের জন্য আভিগান এবং ওরভেসকো দুটোর মিলিত ফলাফল হলো তারা ৯ দিনে সুস্থ হয়েছে। আভিগান প্রেগন্যান্ট মহিলাদের জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে বলে সংবাদে উল্লেখ আছে। চীন অবশ্য আভিগান নিয়ে পজিটিভ ফলাফল আগেই ঘোষণা করেছে। জাপান বর্তমান আরও ২০টি দেশে আভিগান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে। আশার কথা খুব শীঘ্রই হয়ত আভিগান-এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে। যদিও এখনও কিছু স্টেপ বাকি আছে। এখন কথা হচ্ছে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো চারশ টাকা মূল্যে একই ওষুধ বিক্রির কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছে। জাপানে সামান্য কূটনৈতিক অনুরোধে যে ওষুধটি বাংলাদেশে বিনামূল্যে পাওয়ার সম্ভব, সেখানে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার কোনো মানে হয় না।

জাপান তথা জাপানের জনগণ নিয়ে অনেক কিছুই লেখা যায়। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং আদর্শের দিক দিয়ে জাপানের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে, জানার আছে।

লেখক: সাংবাদিক, টোকিও, জাপান থেকে ঢাকা/তারা