বিশ্ব বাতায়ন

করোনা কি তবে প্যাঙ্গোলিনের প্রতিশোধ?

ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে বলছে: করোনাভাইরাসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে প্যাঙ্গোলিনের। কোভিড-১৯-এর সঙ্গে প্যাঙ্গোলিনের শরীরে থাকা ভাইরাসের ৯০ ভাগেরও বেশি সাদৃশ্য রয়েছে। এরপর স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি প্রতিশোধ নিচ্ছে নিরীহ এই প্রাণী? কিন্তু কেন?

‘দ্য গার্ডিয়ান’ দাবি করেছে, চীনারা বিশ্বাস করে প্যাঙ্গোলিনের আঁশে অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তাতে হাঁপানি এমনকি ক্যানসারের মতো অসুখও নাকি আরোগ্য হয়। কিন্তু গবেষণা জানাচ্ছে, এর কোনো ভিত্তি নেই। তারপরও গত কয়েক দশকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে নিরীহ এই প্রাণীটিকে। কোটি টাকার বিনিময়ে পাচারকারীরা প্যাঙ্গোলিনের আঁশ, নখ বিক্রি করেছে। খবরে প্রকাশ, বছরে প্রায় এক লাখ প্যাঙ্গোলিন পাচার হয় চীন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে। আরো জানা যায়, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে প্রায় ৯ টন প্যাঙ্গোলিনের আঁশ আটক করা হয় হংকংয়ে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ওই পরিমাণ আঁশ পেতে গেলে কমপক্ষে ১৪ হাজার প্যাঙ্গোলিন হত্যা করতে হয়েছে। বলা যায়, এভাবেই প্যাঙ্গোলিন বিলুপ্তপ্রায় করে ফেলা হচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই। মানুষের কোনো ক্ষতি না করেও প্রাণীটিকে যেভাবে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ ভাবছেন, হয়তো এ কারণেই প্যাঙ্গোলিনও মানুষকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে! 

প্যাঙ্গোলিন নিতান্ত নিরীহ বিড়াল আকৃতির, তবে দেখতে কুমিরের মতো। বিপদে আত্মরক্ষার জন্য এদের শরীর শক্ত আঁশে ঢাকা থাকে। সরীসৃপের মতো গঠন হলেও আসলে এরা স্তন্যপায়ী। একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৩টি সন্তানের জন্ম দিতে পারে। এদের আবাস চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত ও আফ্রিকার কিছু বিশেষ অংশের জঙ্গলে। এরা একা থাকতেই ভালোবাসে, তাই গাছের কোটরে, মাটির নিচে বা ঘাসজমিতে লুকিয়ে থাকে। প্রজননের সময় ছাড়া কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না। সারারাত ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড় করে। লম্বা জিহ্বার সাহায্যে পিঁপড়া, উইপোকা, লার্ভা, পোকামাকড় দিয়েই পেট পূর্ণ করে।

প্যাঙ্গোলিনের বিলুপ্তির আরেকটি কারণ হলো চীন, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর মাংসের দারুণ চাহিদা। বড়লোকের বাড়িতে অতিথি এলে প্যাঙ্গোলিনের মাংস দিয়েই মেহমানদারী করা হয়। এতে আভিজাত্য প্রকাশ পায়। এ কারণে প্যাঙ্গোলিনের মাংসের দামও ঊর্ধ্বমুখী। ১৯৯০ সালে যেখানে এক পাউন্ড মাংসের দাম ছিল ৭ ডলার, এখন তার দাম ৩০০ ডলার। এছাড়াও রয়েছে আঁশের উচ্চাবাজার মূল্য। প্যাঙ্গোলিনের আঁশ শুকিয়ে গুঁড়ো করে বানানো হয় ট্র্যাডিশনাল চীনা ওষুধ। অধিকাংশ চীনারা বিশ্বাস করে, এই ওষুধের অদ্ভুত গুণ আছে। বাচ্চারা কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হলে যেমন এই ওষুধ কাজ করে, তেমনি কাজ করে ত্বকের রোগে, দীর্ঘ দিনের ঘায়ে। মায়ের বুকে দুধ আসছে না কিংবা বাতের ব্যথায় ঘুম হয় না, তাহলেও এ ওষুধ অব্যর্থ। হাঁপানি, ক্যানসার তো আছেই। যদিও বিজ্ঞানীরা এর সত্যতা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। তারপরও বিশ্বাস বলে কথা। যে কারণে প্যাঙ্গোলিনের ব্যবসায় ভাটা পড়েনি। মালয়ান প্যাঙ্গোলিন কমতে কমতে ২০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফিলিপিনো ও ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন এখন আর নেই বললেই চলে।

একদল মানুষের ধারণা এ সব অপকর্ম আর অন্ধবিশ্বাসের ফলেই আজ গোটা পৃথিবী আক্রান্ত। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টমি ল্যাম ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে জানিয়েছেন, চীনে পাচার হওয়া মালয়ান প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে এমন দুটি করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের বেশ মিল রয়েছে। যদিও এই গবেষণার কিছু অংশের সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে তারা জানিয়েছেন, ভাইরাসের চরিত্রে মিল আছে বলেই যে প্যাঙ্গোলিন থেকেই মানুষের শরীরে রোগ ছড়িয়েছে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা ঠিক হবে না। কারণ, বাদুড়ের ভাইরাসের সঙ্গেও নভেল করোনার মিল আছে। কাজেই এমনও হতে পারে, তৃতীয় কোনো প্রাণীর হাত ধরে বিপদ এসেছে। বা হয়তো তিনে মিলেই অঘটন ঘটিয়েছে। তবে ঠিক কীভাবে ভাইরাসটি একজনের শরীর থেকে অন্যের শরীরে, তারপর মানুষের শরীরে ঢুকলো, তা এখন বিরাট রহস্য।

প্রকৃতি সবসময়ই রহস্যময়। আমরা শরীরের স্বয়ংক্রিয় ইমিউন সিস্টেমের কথা জানতাম কিন্তু এই পৃথিবীরও যে স্বয়ংক্রিয় ইমিউন সিস্টেম আছে তা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলো করোনা। আমরা কেউ ভাবিনি ধরণী আমাদের অত্যাচারে বিদ্রোহ করে বসবে। কে জানে, ঈশ্বর হয়তো প্যাঙ্গোলিনের প্রার্থনা শুনেছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়ে রক্ষা করছেন প্রকৃতির অন্য সন্তানদের।

 

ঢাকা/তারা