বিশ্ব বাতায়ন

সবার ভালোবাসাই আমার জীবনের সম্পদ

দেশ থেকে কেউ ফোন করলে এখন আর জানতে চাই না- কেমন আছেন? সে বেঁচে আছে এটাই আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।

গত ৭ মে আমার ৬২তম জন্মদিন ছিলো। শুভেচ্ছা, শুভ কামনা ও ভালোবাসার বন্যায় ভেসেছি। এবারের জন্মদিনে আমি আমার জীবনের সর্বোচ্চ পুরস্কারগুলো পেয়েছি। করোনা আক্রান্ত আমার ভাগ্নী ও ভাগ্নীর স্বামী খোকন-লীজার কুয়েত মৈত্রী থেকে ফিরে আসা; এর আগে আমার বড় মেয়ে শমি আর নাতিন জারার সুস্থ হয়ে ওঠা আমার সবচেয়ে সেরা উপহার।

মার্চের ১০ তারিখে যখন আমেরিকা পৌঁছলাম, তখনো শমির কলেজে ক্লাশ চলছে। করোনার কারণে কলেজ যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখনো সে বিশেষ প্রয়োজনে নোট নিতে কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়েছে, সেখানকার কমন কম্পিউটার ব্যবহার করেছে। ওর গ্র্যাজুয়েশনের শেষ সেমিস্টার চলছিল। সম্পূর্ণ লকডাউনের পরে কলেজে যাওয়া বন্ধ হলো, কিন্তু বাসায় অনলাইনে পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। জ্বর, খুশখুশে কাশি, গলা ব্যথা। ভাবলাম, সামান্য জ্বর, ঠান্ডা, সিজন চেঞ্জের কারণে হয়েছে। দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।

এভাবে সপ্তাহ কেটে গেল। ওষুধের মধ্যে শুধু অফারষ প্যারাসিটামল জাতীয় সুগার কোটেট ট্যাবলেট। লেবু চা, আদা চা, সব রকমের গরম মসলা, রসুন, সরিষার তেল, কালিজিরা, লেবু মিশিয়ে সিদ্ধ করে চা এমনকি ভাপও নিয়েছে সে। ভিনেগার, লবণ পানির গার্গল কোনোটাই বাদ দেইনি। ওকে খাওয়াচ্ছি, আমরাও খাচ্ছি, নিচ্ছি। এরপরও ওর শরীরটা আরো খারাপ হলো। এবার ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট নেওয়া হলো। আগে ভিডিও কলে রোগীর সঙ্গে কথা বলবে তারপর প্রেসক্রিপশন। ডাক্তার দীর্ঘ সময় শমির সঙ্গে কথা বলে, ওর উপসর্গ জেনে এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ট্যাবলেট আরো ৭ দিন খেতে বললো। তারপরেও ভালো না হলে অুরঃযৎড়সুপরহ ৫ দিনের কোর্স দিয়ে দিলো।

তাতেও কিন্তু কমলো না। এরপর শুরু হলো নতুন উপসর্গ ডায়েরিয়া, বুক ব্যথা। কবির সরকারি রেলওয়েতে কাজ করে, তার অফিস বন্ধ হয়নি। প্রতিদিনই বিকাল ৩টা থেকে গভীর রাত অবধি অফিস করতে হয়। একদিন হঠাৎ দেখি বিকেলেই কবির অফিস থেকে বাসায় চলে এসেছে। আমি অবাক, কারণ ওর এ সময় আসার কথা নয়। শমি বললো সে নিজেই ফোন করে আসতে বলেছে। কারণ তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ইমারজেন্সিতে যেতে হবে।

শমি হাসপাতালে চলে গেল, কেয়ার মুখ থমথমে। আমি বড় অসহায় বোধ করছিলাম। মনে মনে শধু একটি কথাই বললাম, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও। রাতে শমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলো। শুনলাম যাবতীয় টেস্ট করে ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত জানিয়ে চিকিৎসকরা তাকে আশ্বস্ত করেছে। যেহেতু ৩ সপ্তাহ অতিক্রম হয়েছে এখন আর ভয়ের কারণ নেই। শ্বাস কষ্টের জন্য ইনহেলার দিয়েছে। ধীরে ধীরে শমি সুস্থ হলো। এরপর জারা অসুস্থ হলো। আল্লাহর রহমতে জারা তিনদিনেই সুস্থ হয়ে গেল।

এবার আমার পালা। আমিও প্রায় দুই সপ্তাহ লড়াই করলাম। এর মধ্যে খোকন আক্রান্ত হলো। এর দশদিন পর লিজাও হাসপাতালে গেল। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে আমাদের পুরো পরিবারটাই তখন একটা মহা বিপর্যয়ের মধ্যে। তবে সাহস হারাইনি। ভেবেছি, নিউইয়র্কের সেই পরিবারগুলোর কথা, যারা স্বজনদের লাশ নিয়ে অপেক্ষা করছে পৌরসভার লাশ দাফনকারি বিভাগ থেকে লোক কখন আসবে সেজন্য।

সবার দোয়া আর ভালোবাসাতেই বেঁচে আছি। সবার ভালোবাসা নিয়েই যেতে চাই। এই ভালোবাসা ও আস্থা আমার একমাত্র প্রাণশক্তি। আমার জীবন চলার পথের দিশা। বাবা-মাকে আমি আজীবন জ্বালিয়েছি। আমার স্ত্রী সারাটা জীবন আমার জন্য কষ্ট করেছে। কারো জন্য কিছুই করতে পারিনি। জীবনে অজান্তে ভুল করেছি। আমার কোনো আচরণে ও ব্যবহারে কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন সে জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

আজ এই ৬২ বছরে এসে জীবনের খাতায় শুধুই প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি। কারো জন্য কিছুই করতে পারলাম না। না দেশ, না সমাজ ও পরিবার। এই অতৃপ্তি নিয়েই হয়তো একদিন চলে যেতে হবে। ভালো থাকুন সবাই। করোনার কালো অন্ধকার কেটে যাক। নিরাপদ হোক আমাদের ভালোবাসার পৃথিবী। একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশায়।

১১ মে ২০২০, ম্যারিল্যান্ড, আমেরিকা। ঢাকা/তারা