বিশ্ব বাতায়ন

লকডাউন তুলে দেওয়া উচিত?

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একজন রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার মালিকের কান্নাজড়িত মুখের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে না পেরে নিজের কষ্টের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এই চিত্রটিকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবার সুযোগ নেই।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য লকডাউনের কারণে যে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে তাতে সবাই একটি দুর্যোগময় সময় অতিবাহিত করছেন। সমস্যাগুলো ব্যক্তি সামর্থ্য এবং দায়িত্ব অনুযায়ী কঠিনই হয়ে যাচ্ছে! যার মাথা যত বড়, ব্যথাও তত বেশি। কেউ প্রকাশ করতে পারছেন, কেউ পারছেন না।

করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে আমরা যেন দীর্ঘদিনের মালিক-কর্মীর ভালোবাসার সম্পর্ক ভুলে না যাই। দরিদ্র এই দেশে এত লম্বা সময় ধরে লকডাউন টেনে নেওয়ার ক্ষমতা সরকারি কিংবা বেসরকারি শিল্প-কলকারখানা, প্রতিষ্ঠান মালিকদের আছে কিনা ভাবার সময় এসেছে। সরকার টাকা পাবে কোথায়? প্রাইভেট সেক্টর আর ব্যক্তিগত আয়ের সমষ্টিই যেহেতু দেশের প্রধান আয়।

প্রবাসীরা বলেন, আমরা দেশ চালাই। গার্মেন্টস সেক্টরে যারা আছেন তারাও বলেন, তারা দেশ চালান। আসলে দেশ চলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক শক্তির উপর ভর করে। ক্রমাগত লকডাউনে সেটা একেবারে নুইয়ে পড়ছে। প্রাবাসী আর রপ্তানি আয় সহজেই টাকা দিয়ে হিসাব করা যায়। কিন্তু ৬৪ হাজার গ্রামের বাড়িগুলোর হাঁস-মুরগির ডিম আর উঠান-লাগোয়া সবজি ক্ষেতের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা সহজ নয়। তাই এগুলো হিসাবেও আসে না। এই গৃহস্থালী কৃষি আয়ের সঙ্গে স্বীকৃত কৃষি অর্থনীতির টাকার অঙ্কটা যোগ করলেই বোঝা যাবে এই খাত বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। অথচ লকডাউনের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের কৃষক। যারা করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য অপেক্ষাকৃত কম দায়ী।

শুধু কৃষি নয়, চলমান লকডাউনে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের সঞ্চয় বলে তেমন কিছু নেই, তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সীমিত আকারের লকডাউন তুলে না হচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, না হচ্ছে অর্থনৈতিক গতিবৃদ্ধি। অতএব দেশের মানুষের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ঈদের পর লকডাউন তুলে দেওয়াই ভালো হবে মনে করি। দেখুন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ২ থেকে ৩ শতাংশ মারা যাচ্ছেন। সেই অর্থে দেশের সবাই আক্রান্ত হলেও যে ক্ষতি হবে, দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে দেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ লোক মারা যাবে খাদ্যাভাবে অথবা দুর্ভিক্ষসৃষ্ট সামাজিক বিশৃঙ্ক্ষলায়।

ইতোমধ্যেই কয়েক কোটি লোক স্বল্পমেয়াদে বেকার হয়ে পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে এদের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ দীর্ঘমেয়াদে কিংবা স্থায়ী বেকার হবেন। তখন কী হবে ভেবে দেখেছেন? ছয় মাসের বাজার করে যিনি ঘরে নিরাপদে বাস করছেন, তিনি কি তখন এমন নিরাপদে বাস করতে পারবেন? তখন নিরন্ন মুখগুলো কি আপনার দরজায় এসে দাঁড়াবে না? কিংবা ক্ষুধার তাড়নায় তারা যদি বেপরোয়া হয়ে আপনার ঘরে রাখা অতিরিক্ত খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তখন তাদের কি সত্যিই দোষ দেওয়া যাবে? তাই নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা না করে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা ভেবে মতামত দিন।

ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া কিছু তথ্য দিয়ে লেখা শেষ করবো। বাংলাদেশ পান, সিগারেট, বিড়ি, গুল, জর্দা ইত্যাদি তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১৩টি দেশের একটি। সে হিসেবে ধূমপানসহ তামাক জাতীয় পণ্যের পেছনে বিশ্বে মোট ব্যয়ের এক শতাংশও যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধরা হয়, তাহলে বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। নষ্ট হওয়া এই টাকায় দেশে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩টি পদ্মা সেতু হতে পারতো। কিংবা হাজার হাজার কিলোমিটার রেলপথ, সড়কপথ নির্মাণ করা যেতো। এতো গেলো শুধু ধূমপান ও তামাকজাত পণ্যের পেছনের ব্যয়। এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যয়ের হিসাবে না গিয়ে শুধু মৃত্যুর হিসাবটা বলি। প্রতি ৬ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন লোক ধূমপানজনিত কারণে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ সরাসরি ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে মারা যায়। এখন বলুন কেন ধূমপান নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না? কারণ কর্মসংস্থান আর রাজস্ব আয়। এই জটিল অর্থনৈতিক হিসাবের কাছে সব সচেতনতাই ম্লান হয়ে যায়। যদি কর্মসংস্থানের দোহাই দিয়ে তামাকের মতো শতভাগ ক্ষতিকর একটা বিষয় চলতে পারে, তবে কেন করোনাভাইরাসের ভয়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি স্থবির হয়ে থাকবে?

প্রথমে মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে হবে। নিরন্নদের খাবার নিশ্চিত করতে হবে। এরপর করোনার চিকিৎসা এবং এ সংক্রান্ত দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় ভাবা যাবে। সুতরাং আসুন মানুষ বাঁচানোর পথ খুঁজি।

 

ঢাকা/তারা