বিশ্ব বাতায়ন

করোনায় স্পষ্ট হলো সরকারি-বেসরকারি চাকরির ব্যবধান

ভারতীয় বিখ্যাত সংগীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘সরকারি কর্মচারী’ শিরোনামের গানটি অনেকেই শুনেছেন। উপমহাদেশে সরকারি কর্মচারীদের চরিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় এই গানে। যদিও এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা থাকতে পারে। আমরা সেদিকে যাবো না। করোনাকালীন এই দুর্যোগে সরকারি কর্মচারীরা কেমন আছেন? দেশের বেসরকারি কর্মচারীরা যেখানে অনেক ক্ষেত্রে বেতন না-পাওয়ার অনিশ্চয়তায় ভুগছেন, সেই তুলনায় সরকারি কর্মচারীরা এখনও কেমন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন- এই নিবন্ধের এটিই হলো উপজীব্য।

দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে কয়েক দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষিত হওয়ার পর এটি গত ৩০ মে শেষ হয়। সময়টি কম নয়। যাদের দৈনিক আয় বা যারা বেসরকারি কর্মচারী তাদের জন্য দীর্ঘ সময়। কারণ এই সময়ে তাদের অর্থনৈতিক চাকা অচল ছিল। পড়ুয়াদের জন্য ঢাকার নীলক্ষেত জনপ্রিয় একটা জায়গা। অল্পমূল্যে ফটোকপি, বইকেনা, অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি, প্রিন্ট করানো, পুরানো বই ফেরত দিয়ে নতুন বই আদান-প্রদানসহ যাবতীয় অনেক কাজ সুবিধামতো করার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো নীলক্ষেত। এখানে অনেক স্থায়ী বা অস্থায়ী দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকানের মূল আয় হয় দৈনিক। অর্থাৎ তারা দৈনিক যা আয় করে তা দিয়েই সংসার, দোকানভাড়া, বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনা, খাবারসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ সমাধা হয়। ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে এসব দোকানীরা আর কোনো আয় করতে পারেনি। তাদের দিন কেমন যাচ্ছে, সেভাবে কেউই আসলে উপলব্ধি করতে পারবেন না।

নীলক্ষেতের প্রায় চারশ বইয়ের দোকান ছাড়াও ফুটপাতে অনেক ব্যবসায়ীর দোকান আছে যেগুলো সব বন্ধ। কেউ কেউ গোপনে দোকান খুলতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, এখানকার চারশ ব্যবসায়ীর মধ্যে প্রায় দেড়শ ব্যবসায়ীর সংসার চলে প্রতিদিনের আয় দিয়ে। লভ্যাংশের কোনো অর্থই জমা থাকে না। বছরের প্রথম চার থেকে পাঁচ মাসের আয় দিয়েই চলতে হয় সারা বছর।

একবার ভাবুন, যার প্রতিদিনের আয় দিয়ে একটা সংসার চলে, তার এখন কী অবস্থা? এপ্রিল  থেকে মে। এই দুই মাস সে কীভাবে চলেছে? তার জন্য কি আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল? কোনো প্রণোদনা ছিল? না। এটি আসলে এই দুর্যোগে বেসরকারি চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীরা কেমন দিন কাটাচ্ছেন তার একটা উদাহরণমাত্র।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেনের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন সরকারি চাকরিজীবী আছেন (১৯/১/২০২০, যুগান্তর)। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে দুই হাজার চিকিৎসককে পদায়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার (১০/৫/২০২০, বণিকবার্তা)। নতুন নিয়োগকৃত চিকিৎসকদের সংখ্যা বাদ দিয়ে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন সরকারি চাকরিজীবীর বেতন কি মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বন্ধ ছিল? না। তারা যে অর্থনৈতিক কষ্টে ছিলেন না এটুকু নিশ্চিত। শুধু কি বেতন! মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে পহেলা বৈশাখ এবং ঈদের মতো দুটো বড় উৎসব পড়েছে। এই দুই উৎসবেই সরকারি চাকরিজীবীরা উৎসবভাতা পেয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের। এই আনন্দ শুধু সেই সরকারি চাকরিজীবীরা উপভোগ করেছেন, বাকিরা নন। পহেলা বৈশাখ বা ঈদ সরকারি চাকরিজীবীর জন্য এসেছে নীলক্ষেতের সেইসব দোকানীদের জন্য আসেনি।

শুধু কি নীলক্ষেতের দোকানী? পরিবহনখাতে কাজ করা প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক, প্রায় ৩৫ লাখ নির্মাণ শ্রমিক, অসংখ্য কুলি, মজুর, দুধ বিক্রেতা, নিরাপত্তাকর্মী, প্লাম্বার, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী, কাঠের কারিগর, নাপিত, মুচি, বাদামওয়ালা, ফুটপাতের হকার, গৃহকর্মীসহ অনেক মানুষের পহেলা বৈশাখ বা ঈদ এবার আসেনি। তাদের কাছে বেঁচে থাকাই ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ।

৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে পোশাক খাতে। এই খাতের শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী ৫০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেন। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।

ঈদের আগে বোনাস হয়নি ১২৫৮ কারখানার, এপ্রিলের বেতন বাকি ৯২০টি কারখানার (২৪/৫/২০২০, বণিকবার্তা)। শুধু কি বেতন আর বোনাস? দুর্দিনে এই খাতে ৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছে মালিকপক্ষ (১১/৫/২০২০, বণিকবার্তা)। এই ৮ হাজার শ্রমিক যদি সরকারি চাকরিজীবী হতেন তবে কি তারা ছাঁটাই হতেন- প্রশ্নটা আপনাদের কাছে রেখে গেলাম।

এই দুর্যোগে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে দাঁড়ায়নি। অথচ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই এ সময় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসা উচিত ছিল। কেউ কেউ অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে তাদের কোনো উদ্যোগ চেখে পড়েনি। তারা অনেকটা নিশ্চিন্তে ছুটির দুই মাস বাসায় শুয়ে-বসে কাটিয়েছেন। অথচ এর ঠিক উল্টোটা হয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে।

২০১৮ সালে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এক যুব-জরিপ চালায়। জরিপের তথ্যানুযায়ী, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ সরকারি চাকরি করতে চান। এই জরিপটিকে শুধু জরিপ হিসেবে দেখলে ভুল ভাবা হবে। এটি ভয়ানক একটা শঙ্কার বার্তাও দিচ্ছে। শিক্ষিত যুবকরা কেন সরকারি চাকরিতে বেশি ঝুঁকছে? তার বড় কারণ হলো, চাকরির নিরাপত্তা, বেতন-ভাতা, পেনশনসহ সকল সুযোগ-সুবিধা। ২০১৫ সালে সরকারি বেতন কাঠামো পুনর্গঠন করার পর এই চাহিদা আরো বেড়ে গিয়েছে। তার মানে হলো, যুবকরা নতুনভাবে সবকিছু দেখার আগেই সরকারি চাকরির লোভনীয় বেতন-ভাতার জন্য তার পেছনে ছুটছে। এতে করে আগামী দিনে সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল বা মননশীল জাতি উঠে আসবে না। নিরাপদ, নিশ্চিত জীবনের লোভে কেউ আর শিল্পী, কবি, নাট্যকার, অভিনেতা, কথাসাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা হবে না। সবাই সরকারি চাকরিজীবী হবে। আর বিভিন্ন দুর্যোগে অনিশ্চিত জীবন কাটাতে হবে বেসরকারি চাকরিজীবীদের!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ঢাকা/তারা