বিশ্ব বাতায়ন

আজকের বিকৃত মানসিকতার শিশু আগামীর বিকৃত ভবিষ্যৎ

তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো- আম্মু নাকি আব্বুকে? ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি শোনা প্রশ্ন। বেড়ে ওঠার আগেই জটিল একটা প্রশ্নের মধ্যে জীবন শুরু হয়! কখনো শিশুটি বলে বাবা, আবার কখনো মা! আবার কখনো বলে- দু’জনকেই।

পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে আসক্তির ব্যাপারটি কি সবসময়ই এক থাকে?

কেন কিছু শিশু মায়েদের প্রতি বেশি আসক্ত থাকে, অথবা পিতার প্রতি বেশি আসক্ত হয়? শিশুর সাইকোলজি এখানে কীভাবে কাজ করে? একটা শিশু জন্মের পর থেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে মায়ের কাছে, বাবা হয়ে ওঠে নির্ভরশীলতার জায়গা। শিশু অজান্তেই তার মধ্যে নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরে কিছু অচেতন লক্ষ্য বিকশিত করে যা পরবর্তী সময়ে তার জীবনশৈলীকে আকৃতি দেয়। শিশুর জন্মের পর প্রাথমিক বছরগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় তার মানসিক বিকাশ ঘটে।

যদি শিশুটি এমন একটি পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়, যে-ঘরে পুরুষদের মূল্যায়ন বেশি, তবে নিশ্চিতভাবেই শিশুটি বাবার সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত হবে। মেয়ে শিশু হলেও সে বাবাকেই অনুকরণ করার চেষ্টা করবে। সে পুরুষের মতো অভিনয় করে আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ তার বাবার মতো সে মূল্যায়িত হতে চায়, মা’র মতো অবহেলিত নয়। যখন কোনো শিশু নিজেকে এমন বাড়িতে খুঁজে পায়, যেখানে মা হলেন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, তখন শিশুটি মা’র প্রতি আরও বেশি আসক্ত হয়। শিশুটি যদি ছেলে হয় সেও মাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতে পারে।

শিশু বয়স থেকে কিশোরে পা দিতেই সন্তানদের আসক্তির কারণ বদলে যেতে শুরু করে, স্বার্থপর আসক্তি হয়, আর না হলে জেদ থেকে জন্ম নেওয়া আসক্তি। স্বার্থপর আসক্তি হলো পিতা ও মাতার মধ্যে যে বেশি প্রভাবশালী বা জনপ্রিয় হয়, সন্তান তার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে। জেদ থেকে আসক্তি হলো পরিবারে বাবা বা মা স্বৈরাচারী হলে নির্যাতিত জনের প্রতি আসক্তি ও অপর পক্ষের প্রতি অজানা ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নির্যাতনের কোটায় মাতৃত্বের সত্তাকে বেশি পাওয়া যায়। ফলে সন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পার করার আগেই হয়ে ওঠে চরম মা ভক্ত ও জেদি।

আপনার ছেলে রেপিস্ট হবে নাকি সাধু- এতে আপনার হাত আছে ৫০ শতাংশ। কারণ তার শৈশবের শিক্ষা ও দেখা তার জীবনের মূল ভিত্তি। যে ছেলে ছোটবেলা থেকে দেখবে তার বাসায় মায়ের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে, তখন সে ব্যক্তিজীবনে সেটাকেই স্বাভাবিকভাবে নেবে। যে পরিবারে মেয়ে দেখছে শিক্ষার আলো অপ্রয়োজনীয়, সে তাই ধারণ করে বড় হবে।  বিকৃত মানসিকতা চেইন হিসেবে ঢুকে যায় কয়েক জেনারেশনের মধ্যে। এখন ভাবনার বিষয় হলো, আপনিও সেই জেনারেশনের শুরু না তো?

যদি পিতামাতার সমতা ও একাকীত্ববোধ থাকে; সে পরিবারের সন্তান গড়ে ওঠে একটা আদর্শ আসক্তি নিয়ে। পিতা বা মাতা সংযুক্ত থাকার ফল অনেক ক্ষেত্রেই শিশুর ব্যক্তিত্বের উন্নতি বাড়াতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে বিপরীত হলে সন্তানটিকে পাওয়া যেতে পারে একটি অনিরাপদ মানসিকতায়। সব সময়, সলিড আত্মবিশ্বাসের প্রোগ্রামে বলা হয় যে, আমাদের পিতা-মাতারা জীবনযাত্রার পথ দেখানোর ফলে আমরা প্রাথমিক বছরগুলোতে বিকশিত হই, আর অনিয়মগুলো বাড়ায় জটিলতা। শিশুর এই ছোট্ট আসক্তি যে তার পরবর্তী জীবনে কত জরুরি তা আমরা জানি না এবং ভাবি না। এখন পিতা-মাতা বা আমাদের করণীয় কী?

পারিবারিক জীবনে অশান্তি ও ঝামেলা সবার থাকে, তবে তা শিশুর সামনে কখনই তুলে ধরা যাবে না। পারিবারিক মূল্যবোধ-সম্মান ও সমঅধিকার শিশু দেখেই শেখে; বইয়ের পাতায় নয়। তাই তাকে তা শেখার সুযোগের উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করা উচিত।

ছোটবেলার মানসিক চাপ ও স্মৃতি আমাদের সাবকনশাস মাইন্ড-এ সবসময় জমা থাকে যা আমাদের মনেও থাকে না। কিন্তু আজীবন সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাই শিশুর বেড়ে ওঠার সব পর্যায়গুলোতে তাকে পারিবারিক সমস্যা ও অনিয়ম থেকে দূরে রাখা উচিত। স্বল্পস্থায়ী স্বার্থের জন্য শিশুর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ, আর আজকের বিকৃত মানসিকতার শিশু কালকের বিকৃত ভবিষ্যৎ! সুন্দর দিয়েই অসুন্দরকে জয় করা সম্ভব। আর এর প্রস্তুতি নিতে হবে গোড়া থেকে।