বিশ্ব বাতায়ন

মোবাইলে আসক্তি মননশীলতা বিকাশে অন্তরায়

প্রবাদ আছে ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা’। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাড়া মহল্লায় উঠতি বয়সী কিশোরদের আড্ডাও বেড়েছে। এই আড্ডা থেকেই অপরাধ জগতের বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এর পেছনে অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন বড় ভূমিকা রাখছে। আরেকটু খোলাসা করে বললে ফেইসবুক, ইউটিউব এবং বিভিন্ন অ্যাপ-আসক্তি এর পেছনে অনেকটাই দায়ী।

ইমো, ভাইবার, টুইটার ও হোয়াটস অ্যাপে নতুন নতুন ছবি আপ ও চ্যাটিং চলছে। কিশোরেরা তৈরি করছে টিকটক ভিডিও। এই নেশা থেকে বাদ যাচ্ছে না মেয়েরাও। রাত জেগে ইন্টারনেটে খেলছে ফাইটিং ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো নেশা ধরানো গেমস। অনেকের পর্ন সাইটগুলোর প্রতি রয়েছে প্রবল আসক্তি। ফলে ঘটছে নৈতিক স্খলন। এসবই হচ্ছে প্রযুক্তির উৎকর্ষে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে স্কুল ও কলেজপড়ুয়া যুব-কিশোর কিংবা ছিন্নমূল ভবঘুরে, বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিক, রিকশাচালক এমনকি বাড়ির কাজের বুয়ারাও মোবাইলের মাধ্যমে অন্ধকার জগতের নেশায় এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে যা মাদকের চেয়ে ভয়ঙ্কর।

আশপাশে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, যুবা-কিশোররা ইন্টারনেটে ফাইটিং ফ্রি ফায়ার গেম নিয়ে পড়ে আছে। এদের বেশির ভাগ স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী। মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অলস সময় কাটাতে তারা এই গেমস বেছে নিয়েছে। এমনকি অনেকে সারা রাত জেগে এসব খেলে। অনেক অভিভাবক সন্তানকে এ নেশা থেকে ফেরাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো সংসারে অশান্তি তৈরি হয়েছে।

এখন অধিকাংশ তরুণ-তরুণীকেই কানে স্মার্টফোন গুঁজে রাখতে দেখা যায়। এদের বেশিরভাগই মুঠোফোনে আসক্ত। আসক্তি মাত্রই ক্ষতিকর বিষয়! আর স্মার্টফোনে আসক্তি যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা নতুন করে জানান দিলেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার এবং স্মার্টফোন থেকে নির্গত আলো চোখের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। ধীরে ধীরে ডেকে আনে সর্বনাশ, এমনকি কাছের জিনিস দেখার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে যেতে পারে এর ফলে। ব্রিটিশ চক্ষুরোগ চিকিৎসক অ্যান্ডি হেপওর্থ-এর মতে, মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় চোখের পলক কম পড়ে এবং স্বাভাবিকের তুলনায় স্মার্টফোন চোখের বেশি কাছাকাছি এনে দেখা হয়। তাই দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট ও ফ্ল্যাট স্ক্রিনে টিভি দেখার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন তিনি। তাঁর দাবি, যে যন্ত্রগুলো থেকে আলো নির্গত হয় তা চোখের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয়, বিষাক্তও বটে। এতে ঘাড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন হতে পারে। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার শুক্রানুর সংখ্যাও কমিয়ে দিতে পারে। অধিকাংশ পুরুষই মোবাইল ফোন প্যান্টের পকেটে রাখেন। এ সময় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন পুরুষের প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে।

মুঠোফোন সব সময় ঠিক জায়গায় আছে কিনা তা নিয়ে মন সব সময় সতর্ক থাকে। মোবাইল হারানোর ভয় থেকে মনের মধ্যে জন্ম নেয় এক ধরনের মানসিক সমস্যা। গবেষকরা মুঠোফোন হারানোর এই ভয়জনিত অসুখের নাম দিয়েছেন ‘নোমোফোবিয়া’। যার পুরো নাম ‘নো মোবাইল-ফোন ফোবিয়া’। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৫৩ শতাংশ এবং ২৯ শতাংশ ভারতীয় তরুণরা এ রোগের শিকার। ৫ বছর আগেও এই রোগের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়নি। এই রোগ নিয়ে দেশে-বিদেশে চিন্তিত মনোবিজ্ঞানী-মহল। অতিরিক্ত মুঠোফোন নির্ভরতা কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে তা ব্যবহার করেন। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার। সংবাদপত্র, বই বা কোনো কিছু পড়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চোখ থেকে গড়ে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্ব থাকে। চোখের খুব কাছে রেখে অতিরিক্ত সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া শরীরের অন্য কোষকলা এই ক্ষতিকর তরঙ্গের প্রভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এ সমস্যা মূলত উদ্বিগ্নতা বা বিষণ্নতা থেকে ঘটতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হলে ব্যবহারকারী ফোনের রিং না বাজলেও কিংবা ভাইব্রেশন না হলেও হঠাৎ করেই তা শুনতে পান বা অনুভব করেন। অতিরিক্ত মুঠোফোন ব্যবহারের কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের সমস্যায় ভুগতে শুরু করলে অনেকে বুঝতেও পারেন না।

এখন প্রশ্ন হলো, মুঠোফোনের সবই কি ক্ষতিকর? তা নয়। আমাদের উচিত এর পরিমিত ব্যবহার। মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। যেমন চীনে অনেক চেষ্টা করেও ফেসবুকে লগ ইন করা যায় না। কারণ চীনে ফেসবুক চলে না। চলে না ইউটিউব। তাছাড়া আমরা যেসব ইন্টারনেট অ্যাপ সেবা ব্যবহার করি তার অনেক কিছুই নেই চীনে। আপনি চীনে ঢোকামাত্রই এগুলোর এক্সেস পাবেন না। তাতে কি চীন পিছিয়ে পড়েছে? ফেসবুক কিংবা ইউটিউব না থাকলেও তারা ঠিকই প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগাতে হবে। এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। আপনার সন্তান মোবাইলে আসক্ত কিনা আপনাকেই এর খোঁজ রাখতে হবে। সেটা যেমন পরিবারের স্বার্থে, তেমনি দেশ, সমাজের স্বার্থে।

লেখক: সাংবাদিক