বিশ্ব বাতায়ন

করোনায় প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বাড়ছে ঝুঁকি

করোনাকালে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ অনেকটাই দূষণমুক্ত হয়েছে। যদিও পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। তবে করোনাকালীন যে ক্ষতিকর বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো ওয়ান টাইম ইউজ প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের পরিবেশকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে দেশজুড়ে সম্প্রতি বেড়ে যাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশিরভাগই হচ্ছে সার্জিক্যাল মাস্ক, পলিথিনের হ্যান্ড গ্লাভস, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, পলিথিন ব্যাগ এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার। করোনার কারণে সতর্কতা হিসেবে এগুলোর ব্যবহার বেড়েছে। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য আশপাশে রাস্তায় অথবা পাশের ড্রেন বা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যা আমাদের পরিবেশ ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ওয়ান টাইম ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরুর দিকে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছিল। এখন এটিই মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন আমরা চাইলেও খুব দ্রুত এসবের ব্যবহার রোধ করতে পারছি না। যেমন পারিনি পলিথিনের ব্যবহার ঠেকাতে। আইন করেও এর ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি আমরা। অথচ আমরা ভেবে দেখছি না প্লাস্টিকের একটি স্ট্র ব্যবহার করে আমরা যে ডাবের পানি পান করছি তাও প্রকৃতির জন্য হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়র জন্য যেসব প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিকের বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পঁচে না। এভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। সাগর, নদী, পুকুর কোথাও পলিথিন ও প্লাস্টিকের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাগরের মৃত প্রাণীদের পেটেও প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। আমরা একবারও ভেবে দেখছি না, আমাদের ফেলে দেওয়া এই প্লাস্টিকের পণ্য প্রাণীকুলের জন্য কতটা সংকট তৈরি করছে।

প্লাস্টিক ক্ষতিকর জানা সত্ত্বেও আমরা ব্যবহার করি। কিন্তু কেন? উত্তর হলো বহনযোগ্যতা, দাম কম এবং তুলনামূলক টেকসই হওয়ায় এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন হাটে-বাজারে, দোকানে, মার্কেটে কি পরিমাণ প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার হয় আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এই মুহূর্তে প্লাস্টিকের যোগ্য বিকল্প হতে পারে কাপড়ের ব্যাগ। কিন্তু বারবার বলা হলেও আমরা এ বিষয়ে উদাসীন। তার ওপর এখন আরো বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়ান টাইম ইউজ প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পণ্য।

আমাদের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের একটি বড় অংশ রিসাইকেলের বাইরে থেকে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যখন নদীতে, সমুদ্রে প্লাস্টিকের পণ্য ফেলছি তখন তা রিসাইকেল কে করবে? ঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের আসবাবপত্র দূষণের আপাতত প্রধান কারণ নয়। কারণ এসব পণ্য দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয় এবং এগুলোর একটি বড় অংশ রিসাইকেল করা হয়। কিন্তু আমরা বাজার থেকে যে শ্যাম্পু, প্লাস্টিকের ব্যাগ, স্ট্র, বোতল বা এ ধরনের ছোট ছোট পণ্য কিনছি এবং ব্যবহার করছি এসব পণ্যই পরিবেশকে হুমকির মুখে বেশি ফেলছে। এগুলো ব্যবহারের পর আমরা ছুড়ে ফেলছি রাস্তায়, ড্রেনে, নদীতে, পার্কে, পুকুরে। এক কথায় যে কোনো স্থানে। ছুড়ে ফেলাটাই তো আমাদের অভ্যাস! এগুলো একত্রিত করে পুড়িয়ে ফেলার কার্যক্রমও চোখে পড়ে না। এত কষ্ট কেউ করছেও না। একবার ভাবুন তো, প্রতিদিন কত মানুষ প্রতিদিন ছোট ছোট নিত্য ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছে। এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করার কেউ নেই। ফলে মাটির কোথাও না কোথাও এসব আবর্জনা থেকেই যাচ্ছে।

বিজ্ঞানের অন্যান্য কল্যাণকর আবিষ্কারের মতোই প্লাস্টিকের আবিষ্কার ছিল চমকপ্রদ। কিন্তু অনেক আবিষ্কারের মতোই আজ প্লাস্টিক আমাদের মানব সভ্যতাকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। এ জন্য দায়ী বিজ্ঞান নয়, মানুষ। আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের মতো দেশে জনগণ যেখানে সচেতন নয়, পরিবেশ নিয়ে কম মানুষেরই মাথাব্যথা রয়েছে, সেখানে প্লাস্টিক হুমকি হবেই। এখন এই হুমকি আমরা কীভাবে মোকাবিলা করবো আমাদেরই ভেবে বের করতে হবে। সবচেয়ে বড় হলো আত্মসচেতনতা। শুরু করতে হবে নিজেকে দিয়ে। সচেতনতাই এখন মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: শিক্ষক