নটিংহ্যাম থেকে ইয়াসিন হাসান: শর্ট ফাইন লেগ থেকে রুবেলের থ্রোতে ভাঙল স্টাম্প। ১০ বলে ৩২ রানের ঝড় তুলে ম্যাক্সওয়েল তখন মাঝ ক্রিজে। অস্ট্রেলিয়ার রান ৩৫২, হাতে আছে আরো ৭ উইকেট ও ২২ বল। আঙুল গুনে ২২ বলে ২২ রান করলেও রান হয় ৩৭৪। অসিরা করল ৩৮১। রুবেলের সঙ্গে হাত মেলাতে দলের প্রত্যেক ক্রিকেটার এলেও সাকিব দাঁড়িয়ে ডিপ কাভারে, নিজের ফিল্ডিং পজিশনে। এক চুলও সেখান থেকে নড়েননি। হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন তখনই হাত থেকে বেরিয়ে গেছে ম্যাচ! কারণ মাথার ওপর তো রানের বোঝা। তবুও চেষ্টা করে যান মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ। তামিম ও সাকিব সঙ্গ দেন। সবার সম্মিলিত পুঁজিতে বাংলাদেশ করতে পারে ৩৩৩ রান। ৪৮ রানের হারের আক্ষেপ করবে নাকি শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ওয়নাডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ রান তুলে সন্তুষ্ট থাকবে দল! অনফিল্ডে ছোট ছোট ভুলগুলো একেকটা বড় ক্ষতির কারণ। মাশরাফির বলে ওয়ার্নারকে ১০ রানে পয়েন্টে জীবন দেওয়া কিংবা ৭০ রানে তারই রান আউট মিস করা, এগুলো বড় মঞ্চে বড় ভুল। দুবারই খলনায়ক সাব্বির রহমান। চার ম্যাচ দলের জন্য পানি টেনে আর প্রয়োজনে ফিল্ডিং করে যখন মোসাদ্দেকের চোটে তার সুযোগ হলো, তখন দলকে বড় বিপদেই না ফেললেন তিনি! পরবর্তীতে ব্যাট হাতে গোল্ডেন ডাক। বড় খেলোয়াড় সুযোগ পেলে হাতছাড়া করেন না। ওয়ার্নারও করেননি। ১৪৭ বলে ১৪ চার ও ৫ ছক্কায় খেলেন ১৬৬ রানের মারদাঙ্গা ইনিংস। তাকে সমর্থন দেওয়া উসমান খাজা ৭২ বলে করেন ৮৯ রান। বাংলাদেশকে ভুগিয়েছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ১০ বলে ৩২ রানের ঝড় যেন এলোমেলো করে দেয় পুরো দলকে। তাও ভাগ্য ভালো বাংলাদেশের। একজন পার্ট-টাইমার সৌম্য সরকার এদিন ছিলেন। নয়তো এ মাঠে নিজেদের বিপক্ষে করা লজ্জার রেকর্ড ভাঙত অসিরা। গত বছর ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪৮১ রান করেছিল। সৌম্য সুসময়ে, গুরুত্বপূর্ণ উইকেট না নিলে হয়তো আজ কলঙ্কমুক্ত হতেন ফিঞ্চ, ওয়ার্নাররা। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তোলেন ফিঞ্চ-ওয়ার্নার। দুজনের উদ্বোধনী জুটিতে ২০.৫ ওভারে আসে ১২১ রান। দুজনই ফিফটি তুলে মারমুখী হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ওয়ার্নার পারেন, পারেন না ফিঞ্চ। সৌম্য বোলিংয়ে এসে প্রথম ওভারে অসি অধিনায়ককে ফেরান ৫৩ রানে। পরের চিত্রনাট্য ওয়ার্নার, উসমান খাজার। ১৯২ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন দুই বাঁহাতি। মাঝের ওভারগুলোতে বোলাররা লড়াই করলেও শেষ দিকে তারা ছিলেন বেহিসেবী। বিশেষ করে ৩৮ থেকে ৪৬, এ ৯ ওভারে ১১৬ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া বাউন্ডারি ছিল হাতের মোয়া। দুই ব্যাটসম্যান স্ট্রাইক রোটেট করেছেন হরহামেশা। তাতে রানের চাকা সচল ছিল পুরোটা ইনিংস জুড়ে। ওয়ার্নার, খাজাদের থামানোর উত্তর যখন কারো জানা ছিল না তখন আবার এগিয়ে আসেন সৌম্য। নিজের দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে শুরুতে ওয়ার্নারকে থামান। এক ওভার পর তার শিকার উসমান। ১০ চারে ৭২ বলে ৮৯ রান তুলে দলের প্রয়োজন ভালোভাবে মেটান এ টপ অর্ডার। ম্যাক্সওয়েলকে হাত খুলে মারার সুযোগ দেন রুবেল। ৪৬তম ওভারের প্রথম বল নো। ফ্রি হিট লং অফ দিয় উড়ান ম্যাক্সি। পরের দুই বলে চার, ছয়। ওভারের শেষ বলে উসমানের চার।রুবেলের নবম ওভার থেকে আসে ২৫। মাশরাফি শাসন করেননি রুবেলের ওভার শেষ করতে। নয়তো রান খরচায় সেঞ্চুরিও হয়ে যেতে পারত! শেষ পর্যন্ত ম্যাক্সওয়েল থামেন ৩২ রানে। মুস্তাফিজ টিকতে দেননি স্মিথকে (১)। মার্কস স্টনিসের ১৭ ও ক্যারির ১১ রানে বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৮১ রান পায় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। নির্বিষ বোলিংয়ের দিনে রুবেল খরচ করেন ৮৩ রান। মাশরাফি ৫৬, মুস্তাফিজ ৬৯, সাকিব ৫০। সেরাদের হটিয়ে সৌম্য ৮ ওভার ৫৮ রানে নেন ৩ উইকেট। ব্যাটিংয়ে পাওয়া প্লে’ কাজে লাগানোর দরকার ছিল। পারেনি বাংলাদেশ। প্রথম ১০ ওভারে ৫৩ রান তোল ১ উইকেট খরচায়। তামিমের সঙ্গে উইকেটের মাঝপথে ভুলবোঝাবুঝিতে সৌম্য রান আউট হন ১০ রানে। তামিম ও সাকিব ৭৯ রানের জুটি গড়েছিলেন ঠিকই। সাকিব আগ্রাসন দেখালেও তামিম ছিলেন স্লো। উইকেটে সেট হয়ে দুজনই আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে ফেরেন সাজঘরে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব আরেকটি হাফ সেঞ্চুরির পথে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে আটকে দেন স্টয়নিস। ৪১ বলে ৪১ তুলে সাকিব বিশ্বকাপে নিজের ৪২৫ রান তুলে আউট হন। ডানহাতি পেসারের স্লোয়ারে আগে ব্যাট চালিয়ে ওয়ার্নারের হাতে ক্যাচ দেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তামিম এবারের বিশ্বকাপে নিজের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি তুলে বিদায় নেন স্টার্কের বলে বোল্ড হয়ে। অফ স্টাম্পের বাইরের বল খোঁচা মেরে উইকেটে টেনে আনেন এ ওপেনার। স্টার্ক লিটনকে স্বাগত জানান ভয়ানক বাউন্সারে। মাথা নামাতে চেয়েও পারেননি লিটন। শেষ ম্যাচের মতো ব্যাটিংয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে ৩ বাউন্ডারিতে ২০ রান তুলেছিলেন। এরপর জামপার বলে এলবিডব্লিউ হন। দ্রুত ৩ উইকেট তুলে বাংলাদেশকে চেপে ধরতে চেয়েছিল অসিরা। দেয়াল হয়ে দাঁড়ান মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ। ১২৭ রানের জুটি গড়ে দুজন লক্ষ্য নাগালে আনতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতরে একটু একটু করে আশা তৈরি করছিলেন। মাহমুদউল্লাহর ৫০ বলে ৫ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ৬৯ রানের ইনিংসটি সময়ের দাবি মেটায়। শেষ ম্যাচে রান না পাওয়া মুশফিক শেষ পর্যন্ত টিকে থেকে তোলেন সেঞ্চুরি। ৯৭ বলে ৯ চার ও ১ ছক্কায় করেন ১০২। বিশ্বকাপে তার প্রথম ও সপ্তম সেঞ্চুরি। কোথায় ম্যাচ হারল বাংলাদেশ? শেষ ১০ ওভারে অস্ট্রেলিয়া তোলে ১১০। বাংলাদেশ পারে ৮৮। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে ডট বল ১১১, বাংলাদেশের ইনিংসে ১১৬। তামিমের ৭৪ বলের ইনিংসে ডট বল ৩৬, ওয়ার্নারের ১৪৭ বলের ইনিংসে ৬১। ওয়ার্নার ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে পুষিয়ে দিতে পারলেও তামিম পারেন না! তাতে ম্যাচের ভাগ্যও বদলায় না। রানের পাহাড় টপকে চূড়ায় উঠতে শেষ ওভারে দরকার ছিল ৫৬ রান। পরাজয় তখন নিশ্চিত। তবুও গ্যালারি থেকে ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ চিৎকার। এমন সমর্থনের জন্য করতালি পেতেই পারেন নটিংহ্যামে উপস্থিত হওয়া লাল-সবুজ পতাকাধারীরা।
রাইজিংবিডি/নটিংহ্যাম/২১ জুন ২০১৯/ইয়াসিন/পরাগ