ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রজনীগন্ধাপুর : দ্বিতীয় পর্ব

ইমদাদুল হক মিলন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪০, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রজনীগন্ধাপুর : দ্বিতীয় পর্ব

আমার যুদ্ধটা শুরু হয়।

আমি নিজের কথা ভাবি না, মিলিয়ার কথা ভাবি। মিতুয়া আর অপুর কথা ভাবি। পুত্র হারিয়ে আমি হয়েছি এক রকমের ধ্বংস, স্বামী হারিয়ে মিলিয়া হয়েছে আরেক রকম। পিতা হারিয়ে মিতুয়া আর অপু হয়েছে আরেক রকম। আমার সুন্দর সাজানো বাগান এক সকালে যেন শুকিয়ে খড়কুটো হয়ে গেছে। এই বাগানে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হবে কেমন করে?

জুলেখার মা ওই অবস্থাতেও ঠিকই ধরে আছে সংসারের হাল। সব সামলাচ্ছে একা হাতে। ড্রয়ার থেকে নিজের মতো করে টাকা নিচ্ছে। বাজারঘাট, রান্নাবান্না, ড্রাইভারের বেতন, ফ্ল্যাট মেনটেইনেন্সের টাকা, যেখানে যা লাগে, করে যাচ্ছে।

 

আমার খুব অবসাদ লাগছিল তখন। ওষুধ খেলেও ঘুম হয় না রাতে। গলাটা শুকিয়ে আসে। বসে থাকলে শুধু বসেই থাকতে ইচ্ছে করে। শুয়ে থাকলে ঘুম আসে না ঠিকই কিন্তু উঠতেও ইচ্ছে করে না। ডানহাতের কনুইতে মাস দু’তিনেক ধরে কেমন একটা ব্যথা। আঙুলগুলো আরষ্ঠ। আগের মতো স্বচ্ছন্দে মুঠো করতে পারি না।

আমার রুমের সঙ্গে দক্ষিণ মুখি বারান্দা। একটা চেয়ার পাতা সেই বারান্দায়। এক রাতে বসে আছি বারান্দায়। রাত কত হয়েছে কে জানে। কখন থেকে কাঁদছি, টের পাইনি। চোখের জলে গাল ভাসছে।

হঠাৎ কাঁধে হাত। মিলিয়া। কখন সে এসে আমার রুমে ঢুকেছে, রুমে না পেয়ে বারান্দায় এসেছে, কিছুই টের পাইনি। এখন তার হাতের ছোঁয়া টের পেলাম। কান্নাটা বেড়ে গেল। শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমার সব শেষ হয়ে গেছে মা, আমার সব শেষ হয়ে গেছে।

মিলিয়া ধীর শান্ত গলায় বলল, কিছুই শেষ হয়নি বাবা। আপনার ছেলে চলে গেছে, আমি তো আছি। আপনার নাতি নাতনি আছে। আপনি কিছুতেই ভাববেন না এই জীবন আমি বদলাবো। আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আমার এই সংসার ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আমার এখন একমাত্র কাজ আমার ছেলেমেয়ে মানুষ করা, আপনাকে আগলে রাখা। আপনি শক্ত হন, উঠে দাঁড়ান। আমি দাঁড়িয়েছি, আমার ছেলেমেয়েকেও দাঁড়াতে বলছি। এই জীবন মেনে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। কালই আপনি ডাক্তারের কাছে যাবেন।

 

আমার সব চিন্তা সেই রাতেই শেষ হলো। মিলিয়াকে নিয়ে, মিতুয়া অপুকে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম।

আমার অনেকদিনের পুরনো বন্ধু আজিজ। খুবই বিখ্যাত ডাক্তার। সলিমুল্লাহ মেডিক্যালের মেডিসিনের হেড, হার্ট স্পেশালিস্ট। আমার জীবনের সবকিছুই সে জানে। মায়া চলে যাওয়ার সময়, দিপুর সময় সে আমার পাশাপাশি ছায়ার মতো ছিল। আমার অন্য বন্ধুরাও ছিল। ব্যস্ত মানুষ। সেভাবে দেখা করতে আসতে পারে না। তবে ফোনে খোঁজ খবরটা রেগুলার নেয়। আমি আজিজকে শরীরের কথা বলতাম না। জানতে চাইলেই বলতাম, আমার শরীর নিয়ে তুই ভাবিস না। ওদিক দিয়ে ভালো আছি।

সেই রাতের পর, মিলিয়া আমার বুকের পাথর নামিয়ে দেওয়ার পরদিন সকালবেলাটা আমার খুব ভালো লাগল। বারান্দায় একটুখানি রোদ পড়েছে। সেই রোদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আলো আসছে। আমার অন্ধকার জীবনে আলো আসছে। আলো চাই, আরও আলো।

 

সন্ধ্যাবেলা গেলাম আজিজের কাছে। ওর চেম্বার ধানমন্ডিতে। সব শুনে প্রেশার দেখল। দু’য়েকটা ওষুধ দিল। ব্লাডের অনেকগুলো টেস্ট দিল।

রিপোর্ট সবই প্রায় ভালো এলো। শুধু সুগার। সুগারের অবস্থা ভালো না। বলল, বারডেমে যা। তোর ডায়াবেটিস হয়েছে। অতিরিক্ত টেনশান, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে তোর ওপর দিয়ে যা গেছে...

ফেরার সময় গেলাম মাহবুবের ওখানে। ওরা চার বন্ধু মিলে বড় হাসপাতাল করেছে ধানমন্ডিতেই। আজিজের কথা শুনে বলল, বারডেমে যেতে হবে না। আমিই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কাল সকালে তোর ফ্ল্যাটে লোক যাবে। ফাস্টিং অবস্থায় ব্লাড নেবে। তারপর নেবে নাশতার ঠিক দু’ঘণ্টা পর। তুই সেভাবে তৈরি থাকবি।

সেভাবেই হলো সব।

হ্যাঁ ডায়াবেটিস। ফাস্টিং অবস্থায় পাওয়া গেল তেরো। খাওয়ার দু’ঘণ্টা পর ঊনিশ।

আজিজকে ফোনে জানালাম, মাহবুব তো জানলোই।

আজিজ বলল, ঘাবড়াবার কিছু নেই। প্রথম দিকে এরকমই হয়। এখনই ইনসুলিন নেওয়ার দরকার নেই। ওষুধ শুরু কর আর নিয়ম কানুন মেনে চল।

 

শুরু হলো আমার অন্যজীবন।

ওষুধ আর নিয়ম মেনে চলা, দু’বেলা হাঁটা আর চার্ট অনুযায়ী খাওয়া। কদিন পর পর ব্লাড টেস্ট। দেখি ভালো রকম কন্ট্রোলে এসে গেছে।

তারপর এতগুলো বছর, এখন বয়স একাত্তোর, ইনসুলিন ধরতে হয়নি।

টাকা পয়সার অভাব কোনোদিনও তেমন ছিল না আমার। বিক্রমপুরের কোরহাটি গ্রামে বাড়ি ছিল। আমরা দু’ভাই দুবোন। বাবা লৌহজং বাজারে কাঠের ব্যবসা করতেন। একটা করাতকলও ছিল আমাদের। আর জমিজমা ছিল অনেক। বাবা তেমন লেখাপড়া জানতেন না। তবে আমাদের চার ভাইবোনকেই লেখাপড়া করিয়েছিলেন। প্রথমে বড়বোন, তারপর বড়ভাই, তারপর আমি। সব শেষে একটা বোন।

বাবা আমাদের সবাইকেই মোটামুটি স্টাবলিস্ট করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পর কোরহাটি গ্রামের ওদিকটায় বর্ষাকালে পদ্মা ব্যাপক ভাঙন শুরু করল। দু’তিন বছরের মধ্যে পুরো গ্রাম বিলীন হয়ে গেল। ততোদিনে শুরু হয়ে গেছে আমাদের ঢাকার জীবন। বাবা মারা যাওয়ার পর মা বেঁচে ছিলেন বছর আটেক। বড়ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। বড়ভাই কনসট্রাকসনের বিজনেস করে বড়লোক হয়ে উঠছেন। মা মারা গেলেন। বড়বোনের বিয়ে হয়েছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে। স্বামী বিশাল কাপড়ের ব্যবসায়ি। ছোটবোন চলে গেছে আমেরিকায়। ওরও ভালো অবস্থা। ফ্লোরিডায় তিনটা গ্রোসারি শপ।

চাকরিজীবী হলাম একমাত্র আমি।

জগন্নাথ কলেজ থেকে বি.কম. পাস করে যে কোম্পানিতে ঢুকেছিলাম, তাঁরা তখন মাত্র বিজনেস শুরু করেছেন। ল্যান্ড ডেভলাপের বিজনেস। তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছরে এতবড় হলো কোম্পানি, এত রকমের মিল কারখানা, শিপিং বিজনেস! মালিকের সঙ্গে শুরু থেকেই ঘনিষ্ঠতা। তিনি আমাকে কখনও ছাড়ার কথা ভাবেননি। আমিও ভাবিনি। চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর তাঁর সঙ্গেই কাটিয়ে দিলাম।

ভালো বেতন দিতেন। আর অন্যান্য সুবিধা তো ছিলই। একটা ফ্ল্যাট দিয়েছেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। আর দিপু করেছিল এই ফ্ল্যাট। বসুন্ধরার ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া আছে। তিরিশ হাজার টাকা ভাড়া পাই।

দিপু চলে যাওয়ার পর ওই যে উঠে দাড়ালাম, আবার গেলাম মালিকের কাছে। তিনি বললেন, আপনার চাকরি আছে। কাল থেকে শুরু করুন।

শুরু করলাম।

ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল জীবন।

জামি ভালো ছেলে। সে মিলিয়াকে বলল, অফিসে গিয়ে বসতে। জামির সঙ্গে মিলেমিশে বিজনেসটা দেখতে।

 

ছেলেমেয়ের স্কুল ইত্যাদি মেনটেইন করেও মিলিয়া অফিসে গিয়ে কিছুদিন বসেছে। তারপর দেখি যায় না। জিজ্ঞেস করেছি। বলল, আমি বিজনেসটা তেমন বুঝতে পারছিলাম না বাবা। তাছাড়া আমার ছেলেমেয়ের পড়ালেখার অসুবিধা হয়। ওরা যে স্কুলে পড়ে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, প্রিন্সিপ্যাল আপা আমার পরিচিত। আমাদের ডিপার্টম্যান্টের সিনিয়র আপা। তিনি চাইছেন আমি ওই স্কুলে জয়েন করি। ভেবে দেখলাম, সেটা আমার জন্য খুব ভালো হয়। ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্কুলে চলে গেলাম, ওদের সঙ্গে ফিরে এলাম।

খুব ভালো হয়। তাই করো।

আমি আব্বু আম্মুর সঙ্গে আলাপ করেছি, দপর্ণের সঙ্গে আলাপ করেছি। ওরাও স্কুলে জয়েন করতে বলল।

পরে বাই দা বাই আমার কানে এসেছে, মিলিয়া অফিসে বসুক এটা জামির বউ চাইছিল না। ওদের সংসারে মিলিয়াকে নিয়ে অশান্তি হচ্ছিল।

কথাটা যে আমার কানে এসেছে মিলিয়াকে আজও আমি তা বুঝতে দেইনি। ও যখন বলেনি, আমি বলতে যাবো কেন?

তবে জামি দিপুর পাওনা টাকাটা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল। প্রায় সত্তর লাখ টাকা।

যেদিন চেকটা আমার হাতে দিতে এল সেদিন আমি আবার কাঁদলাম। তার মানে আমার ছেলে গভীর স্বপ্ন নিয়ে যে ফার্ম শুরু করেছিল সেই ফার্মের সঙ্গেও আজ থেকে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।

তবে জামির সঙ্গে যোগাযোগ আমাদের থাকলো। জামি মাঝে মাঝে ফোনে আমার খবর নেয়। মিলিয়ার সঙ্গেও কথাবার্তা হয়। মাস দু’মাসে কখনও কখনও জামি এই ফ্ল্যাটে আসে।

মিলিয়া ওর বাবার বাড়ির দিক থেকেও ভালো প্রপার্টি পেয়েছে। গুলশানে জমি ছিল ওদের। ডেভেলাপারকে দিয়ে আমার বেয়াই ক্যাশ টাকা পেয়েছেন অনেক। ছ’তলা বিল্ডিংয়ের বেইজম্যান্টে পার্কিং আর একেক ফ্লোরে দুটো করে মোট বারোটা ফ্ল্যাট। ছ’টাই পেয়েছেন বেয়াই। দুটো মাত্র ছেলেমেয়ে। সমান ভাগ করেছেন তিনি। তিনটা ফ্ল্যাট মিলিয়ার, তিনটা দর্পণের। লাখ দেড়েক টাকা মিলিয়া ভাড়াই পায়।

দর্পণ নর্থ সাউথ থেকে এমবিএ করে বনানীতে রেস্টুরেন্ট খুলেছিল। তিন বছরের মাথায় রেস্টুরেন্ট হয়ে গেছে দুটো। জমজমাট ব্যবসা। আমার নাতি নাতনিকে খুবই ভালবাসে। ওরাও মামা বলতে অজ্ঞান।

 

এভাবেই চলছিল।

বছর তিনেক আগে আমি আমার কোম্পানির চেয়ারম্যানকে বললাম, এবার বিদায় নিতে চাই স্যার। আর কাজ করতে ভালো লাগে না। নাতি নাতনিকে সময় দেই। নিজের মতো থাকি।

তিনি ছাড়তে চাননি। তারপরও আমার অনুরোধে ছাড়লেন। প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্রাচুয়েটি ইত্যাদি মিলিয়ে টাকা পেলাম অনেক। ষাট লাখের মতো। সব পড়ে আছে ব্যাংকে। এফডিআর করেছি, সঞ্চয়পত্র কিনেছি। অভাব আমাদের নেই। এমনকি অফিসের যে গাড়িটা আমি ব্যবহার করতাম সেই গাড়িটাও চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। পুরনো ড্রাইভার মতিনও ছিল।

তারপরও নিজেকে আমার বাতিল মানুষ মনে হয়।

তিন চারদিন আগে এক সন্ধ্যায় মিলিয়া আমাকে বলল, বাবা, এই শুক্রবার আমরা একটু আউটিংয়ে যাবো। আপনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে।

বিকেলবেলার হাঁটা শেষ করে বাড়ি ফিরেছি আমি। নিজের রুমে বসে টিভি দেখছি। মিলিয়া এসে ঢুকলো, ওই কথা বলল।

রিমোট টিপে টিভির সাউন্ড কমিয়ে মিলিয়ার দিকে তাকালাম। কোথায় যাবে?

জামি ভাই নিয়ে যাবেন।

 

জামি নামটা শুনলেই আজকাল আমার একটু অস্বস্তি হয়। জামি আর মিলিয়াকে নিয়ে কিছু কথা আমার কানে এসেছে। দিপু মারা যাওয়ার পর মিলিয়া যখন গিয়ে অফিসে বসতে শুরু করেছিল তখন থেকেই নাকি ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। প্রথমে টের পেয়েছে জামির বউ রুবানা। ওসব নিয়ে কথাবার্তার কারণেই নাকি মিলিয়া ওই অফিসে যাওয়া ছেড়ে দেয়, স্কুলে জয়েন করে।

এসব কথা আমি পরে শুনেছি কিন্তু পাত্তা দেইনি বা ওই নিয়ে তেমন করে ভাবিওনি। অল্প বয়সে স্বামী হারা সুন্দরী মেয়ে। সে যেখানে যাবে সেখানেই তাকে নিয়ে কথা উঠবে। আমাদের সমাজে এসব হবেই। কিছু মানুষ মানুষের সুন্দর সম্পর্কের মধ্যেও নোংড়ামো খুঁজে ফেরে। অকারণে কথা রটায়। আর রুবানার সন্দেহ হতেই পারে। কারণ রুবানার তুলনায় মিলিয়া দেখতে অনেক সুন্দর, অনেক এট্র্যাকটিভ। তেমন সাজগোজ মিলিয়া কখনই করে না। তারপরও যেখানে যাবে, মানুষ ওর দিকে তাকাবেই। খুবই চোখে পড়ার মতো মেয়ে।

তবে পরে যখন এসব কথা আমার কানে এসেছে তখন মনে হয়েছে, সিদ্ধান্তটা মিলিয়া ভালই নিয়েছে। দুর্নাম তেমন করে রটাবার আগেই ওখান থেকে চলে এসেছে। জামিও দিপুর শেয়ারের টাকা পয়সা চুকিয়ে ফার্মটা নিজের একক করে নিয়েছে। এ একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে।

তারপর দিনে দিনে টের পেলাম, না, একটা সম্পর্ক বোধহয় দুজনার মধ্যে তৈরি হয়েছে।

 

 

দিপু চলে যাওয়ার পর হাসতে ভুলে গিয়েছিল মিলিয়া, আনন্দ করতে ভুলে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে তার জীবনে সেসব ফিরে এল। নিজের রুমে বসে মোবাইলে অনেকক্ষণ ধরে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। খিলখিল করে হাসে। আনন্দে ভাসতে থাকে।

বুঝতে পারি তার জীবনে আনন্দের উৎস তৈরি হয়েছে। উৎসটা কী তাও যেন একটু একটু অনুমান করতে পারি। স্বামীর বিবাহিত বন্ধুর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ালো মিলিয়া!

এসব নিয়ে কি কথা বলা যায়? পুত্রবধূর সঙ্গে কোন শিক্ষিত মানুষ পারেন এসব কথা বলতে? কোন রুচিশীল মানুষ পারেন?

কোনো কোনোদিন স্কুল থেকে ফিরে শাড়িটারি বদলে, সামান্য প্রসাধন সেরে দ্রুত বেরিয়ে যায় মিলিয়া। ফেরে বিকেলের দিকে।

কোথায় যায়?

আমাকে অবশ্য বলে যায়। একটু কাজ আছে বাবা। শপিংয়ে যাচ্ছি।

কখনও বলে, অমুক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ওর একটু ক্রাইসিস হয়েছে।

কোনোদিন বলে, আজ আমরা পুরনো বন্ধুরা সব একত্রিত হবো। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো।

স্কুলের কলিগদের কথাও বলে। তাদের সঙ্গে এখানে যাবো, ওখানে যাবো।

মাসে অন্তত তিন চারবার মিলিয়ার এই ব্যস্ততা দেখি। ইদানিং ব্যাপারটা যেন আরও বেড়েছে। আরও ঘন ঘন বাইরে যাচ্ছে মিলিয়া।

বাড়ির গাড়িটা এখন আর নেই। আমার অফিসের গাড়িটাই আছে। দুটো গাড়ি আমাদের লাগে না। এজন্য বাড়ির গাড়িটা মিলিয়া বিক্রি করে দিয়েছে। তবে আমার মতিন ড্রাইভারটা নেই। তার জায়গায় আছে আমাদের পুরনো ড্রাইভার ফরিদ। মিলিয়ার বাপের বাড়ির দিককার লোক। দিপু গাড়ি কেনার পর থেকেই আছে।

 

একটা দিক দিয়ে আমাদের ভাগ্য খুব ভালো। লোক ভাগ্য। বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভার, এইসব লোক আমাদের কাছে একবার এলে আর যেতে চায় না। বছরের পর বছর আছেই। পরিবারের অংশ হয়ে যায়।

জুলেখার মা যেমন হয়েছে, ফরিদও তেমন। মতিনও তেমন ছিল। তবে লোকটা বছর পাঁচেক আগে অসুস্থ হল। কিডনি সমস্যা। গ্রামে অবস্থা ভালো। মাদারিপুরের লোক। দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে। বড় ছেলেও বিয়ে করেছে। ছোট ছেলেটা থাকে মালোশিয়াতে। টাকা পয়সা ভালই কামায়।

মতিন বিনীত ভাবে, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। চাকরি বাকরি আর করে না। গ্রামের বাড়িতে থাকে। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এলে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।

মতিন চলে যাওয়ার পরই পুরনো গাড়িটা বিক্রি করে ফেললাম। আমার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো ফরিদ।

কোনো দুষ্টু চরিত্রের শ্বশুর হলে, সুন্দরী ছেলের বউ এভাবে প্রায়ই কোথায় যাওয়া আসা করে সেসব খোঁজ খবর করতো। বাড়ির কাজের বুয়ার কাছ থেকে, ড্রাইভারের কাছ থেকে। টাকা পয়সা দিলেই এই জাতীয় লোকরা হরহর করে সব বলে দেয়। নিয়মিত টাকা দিলে নিয়মিত খবর দেবে। এসব আমি জানি।

আমি সেই রুচির লোক নই। সেই শিক্ষা আমার নেই। থাকুক মিলিয়া তার মতো।

তবে একটু অস্বস্তি লাগে।

আমার অস্বস্তিটা বোধহয় জুলেখার মা টের পায়। সে অতি কম কথা বলা মানুষ। তবে সেও বোধহয় খেয়াল করে সব কিছু। আমার মতো এক ধরনের অস্বস্তি বোধ তারও হয়।

 

এক সন্ধ্যায় ঘটনা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

মিতুয়া বড় হয়েছে। ষোলো বছরে পড়েছে। আমি ঠাট্টা করে মাঝে মাঝে বলি, হ্যালো সুইট সিক্সটিন!

মিতুয়া হাসে।

সে দেখতে ভারি সুন্দর। চোখে লাগার মতো মেয়ে। এই জেনারেশানের মেয়ে। মোবাইল ইন্টারনেট ফেসবুক এসব নিয়ে আছে। কেনাকাটা করে প্রচুর। প্রতি মাসেই জামা কাপড় এটা সেটা গাদা গাদা কিনছে।

এই মোবাইলে কথা বলা নিয়ে সেই সন্ধ্যায় মা মেয়ের লেগেছে। ওদের ঝগড়াঝাটি হচ্ছে শুনলে আমি আমার রুমে গিয়ে বসে থাকি। মা মেয়ের ঝগড়া, নিজেরাই ঠিক করে নেবে। আর ওদের ভদ্রতা জ্ঞান ভালই। ঝগড়া করে দরজা বন্ধ করে। আমার বা জুলেখার মার কানে যেন না আসে।

সেদিন মিতুয়ার ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়েছিল। ওরা বোধহয় খেয়াল করেনি। আমি যাচ্ছিলাম ডাইনিংস্পেসের দিকে। রুমে পানি ছিল না। এক বোতল পানি আনবো। কানে এল মিলিয়া বেশ গলা চড়িয়ে বলছে, বয়ফ্রেন্ড তো বানিয়েছোই, তাও একজন না, তিন চারজন। সারাক্ষণ হয় ওর সঙ্গে নয় তার সঙ্গে ফোনে চালিয়ে যাচ্ছো...

 

আমার কানচাপা দিয়ে দৌড়ে সরে আসতে ইচ্ছা করল। পানির বোতল মাত্র হাতে নিয়েছি, শুনি মিতুয়া চিৎকার করে মিলিয়াকে বলছে, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই যে তুমি জামি আংকেলের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছো! প্রতি সপ্তাহে ডেটিং করছো...

দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে আসতে আসতে দেখি কিচেনের দরজায় পাথর হয়ে আছে জুলেখার মা। সেও সব শুনতে পাচ্ছে।

শুধু একজন মানুষেরই কোনো খবর নেই। অপু। সে হয়েছে অনেকটা আমার মতো। থার্ড জেনারেশান নাকি ফার্স্ট জেনারেশানের গুণাবলী পায়। অপু আমার মতো চুপচাপ ধরনের। স্কুল আর নিজের রুম। সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে আছে, জোকস নিয়ে আছে। কমিকস কার্টুন নিয়ে আছে। একটা ছেলে বাচ্চা যে এই ফ্ল্যাটে বড় হচ্ছে, টেরই পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ মিতুয়া তার মতো চলছে, মিলিয়া তার মতো চলছে।

 

সেই সন্ধ্যায় সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। সেই সন্ধ্যায় নিজেকে আমার বাতিল মানুষ মনে হলো। চোখের সামনে ছেলের বউ এই করে বেড়াচ্ছে, ষোলো বছরের নাতনি বয়ফ্রেন্ড ম্যানটেইন করছে, আমার কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই। আমি সব দেখে যাবো, সব শুনে যাবো। কাউকে শাসন করা, ওপথ থেকে ফেরানো আমার সাধ্যের বাইরে। বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি তো দূরের কথা, এই নিয়ে কথা বলতে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। যদি মিলিয়া আমাকে বলে, দিপু চলে যাওয়ার পর আমি যদি বিয়ে করতাম, তাহলে আপনি কী করতেন? যদি মিতুয়া আর অপু আমার নতুন সংসারে এডজাস্ট করতে না পারতো, যদি স্পয়েল্ড হয়ে যেতো, আপনি কী করতেন? আর আপনার জীবনই বা কাটতো কীভাবে? কোথায় থাকতেন আপনি, কীভাবে থাকতেন? একমাত্র ছেলের বউ পর হয়ে যেতো, নাতি নাতনি পর হয়ে যেতো। তখন কী করতেন আপনি? তারচে’ এ তো আপনার জন্য অনেক ভালো জীবন। আমি আমার সংসার ছেলেমেয়ে এবং আপনাকে ঠিক রেখে যদি কোথাও ইনভলবড হয়ে থাকি, তা তো মানুষ সেভাবে জানছে না। আমাকেও তো আমার জীবনের কথা ভাবতে হয়! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হলে আমার মতো মেয়ে কী করতো? বাড়িতে বয়ফ্রেন্ড বা লাভারকে নিয়ে আসতো। আমি তো সমাজ সংসারের কথা ভেবে, মান সম্মানের কথা ভেবে আপনাকে ফেলে চলে যাইনি! সেই জীবনের দরজাও তো আমার জন্য খোলা ছিল! এখন সবদিক ঠিক রেখে আমি আমার মতো একটা জীবন কাটাচ্ছি, এই জীবন নিয়েও যদি আপনি প্রশ্ন তোলেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। আজকাল আমাদের সমাজের ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে আপনি জানেন? বহু গৃহবধূ স্বামী সন্তান থাকার পরও পরকীয়ায় জড়াচ্ছে। বয়ফ্রেন্ড ম্যানটেইন করছে। দিপু বেঁচে থাকা অবস্থায় তো আমি তেমন কিছুতে জড়াইনি। আর যার সঙ্গে আমার রিলেশান সে দিপুর বন্ধু। এও আমার জীবনকে অনেকটা সহজ করেছে। সবাই জানে আমরা বহুদিনের পরিচিত, ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। কেউ অন্য কিছু সহজে ভাবেও না। আমি তো সবদিক সামলাচ্ছি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে!

 

নিজে নিজে এসব যুক্তি দাঁড় করিয়ে আমি সব দেখেও কিছু দেখি না। সব শুনেও কিছু শুনি না। বাতিল মানুষ। আমার অবস্থা আসলে জুলেখার মার মতো। সংসারের পুরনো আসবাব। এক কোণে পড়ে আছি।

তবে মিতুয়াকে নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা হয়। এই বয়সি ছেলেমেয়েরা আজকাল যা করছে, চিন্তা করা যায় না। শুনি তো সবই। বন্ধুরা আলোচনা করে, পার্কে কথাবার্তা হয়। খবরের কাগজে পড়ি। ড্রাগ এডিক্ট হচ্ছে কত বড় বড় ঘরের ছেলেমেয়েরা। সামান্য সামান্য কারণে সুইসাইড করছে। ড্রাগ এডিক্ট মেয়ে খুন করলো মা বাবাকে। পরকীয়ায় জড়িয়ে শিশুসন্তানকে হত্যা করলো মা। কত ঘটনা। সেই অর্থে আমাদের সংসার তো ভালো আছে। কোনো কেলেঙ্কারি তো হয়নি। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়