ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ছোটগল্প || মায়ার মিছিল

ম্যারিনা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ২৪ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || মায়ার মিছিল

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

লায়লা বলেছিল, লোকাল এনেস্থেশিয়া করা হবে, কিস্যু টের পাবি না। কিন্তু রুম্পা টের পায়। মোটা কোনকিছু তার ভেতরে প্রবেশ করছে। বেশ কয়েকবার এমন হলো। এরপরের কথা কিছু মনে নেই। ধোঁয়াশা ঘেরা একটা ঘরে যখন নিজেকে আবিষ্কার করে তখন রুম্পা আধো ঘুম আধো জাগরণে। আসলে ধোঁয়াশা নয়, সেটি ছিল কাঁচের ঘর। পুরোটা সবুজ পর্দায় ঘেরা। রংটা বিবর্ণ। বা এমন হতে পারে রুম্পার কাছে সবকিছুর রং বদলে গিয়েছিল। পাশের বেডে একজন ভদ্র মহিলা শুয়ে আছেন। সাড় আছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। তাঁর মুখ হাত গলা থেকে অনেকগুলো টিউব ঝুলছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। রুম্পা কার্ডিয়াক মনিটরের চলন্ত জিগজ্যাগ রশ্মির দিকে তাকিয়ে থাকে। কী হয়েছে ভদ্র মহিলার? রুমের কোণার দিকে একজন নার্স মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছে। রুম্পা তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। একটু নড়াচড়া করতে গিয়ে শরীরটাকে পাথর মনে হলো। যেন রাস্তায় পড়ে থাকা জড়বস্তু। জড়বস্তু অনুভূতি বিবর্জিত, অথচ রুম্পার ক্ষেত্রে সেটি প্রবল। চোখের কোণা বেয়ে অবিরত নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে। মানুষের ভেতরটা যেমনই থাকুক ইন্দ্রিয়ের কাজ তার অনুভূতি প্রকাশ করা। সে জন্যই হয়তো অনেক সময় শুনতে না চাইলেও শুনতে হয়, কাঁদতে না চাইলেও কাঁদতে হয়। রুম্পা এই মুহূর্তে একদম কাঁদতে চায়নি।

পিরিয়ড মিস করার দুই সপ্তাহ পার হবার পর রুম্পা প্রেগন্যান্সি টেস্ট স্ট্রিপ কিনে এনেছিল। ড্রপারে করে স্ট্রিপের নির্দিষ্ট জায়গায় ইউরিন স্যাম্পল দেবার সময় হাত কাঁপছিল ওর। টেনশনে শ্বাস আঁটকে আসছিল, কী হবে? ধীরে ধীরে একটি থেকে স্ট্রিপটির দুটি বারই লাল বর্ণ ধারণ করল। একদিকে শঙ্কা অন্যদিকে আনন্দের মিশ্র অনুভূতি ওকে বিবশ করে ফেলে। নিশ্চিত হতে পরের দিন আবারো একটা স্ট্রিপ এনে পরীক্ষা করেছিল। একই রেজাল্ট। উফ! কেমন এক অনুরণন ওকে প্রকম্পিত করছিল রুম্পা জানে না। যেন জনম জনম ভর এই জন্য অপেক্ষা করে ছিল সে। দুপাক খেয়ে রুম্পা আয়নায় নিজেকে পরখ করে। প্রচণ্ড ফ্যাকাসে আর রক্তশূন্য চেহারায় অজানা আলোর দ্যুতি। দুচোখের নিচে বোধ হয় একটু কালি পড়েছে। বুক দুটো আগের থেকে যথেষ্ট ভারী নয় কি? কদিন পর পায়ে পানি চলে আসবে হয়তো। সে সময় হাঁটতে কি কষ্ট হবে? হোক। স্ফীত পেট, পানিতে ফুলে যাওয়া পা নিয়ে কোনো পান্ডুর বর্ণের নারী যখন খুব সাবধানে হেঁটে যায় তখন রুম্পা সেদিকে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকে। এটা তার চোখে সব চেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ঈষৎ স্ফীত তলপেটে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় ডাকে মাম্মা! পর মুহূর্তে খিলখিল করে হেসে ভেঙে পড়ে রুম্পা। ধুর, মাত্র তো দু সপ্তাহ পেরিয়েছে এখনই এসব কী ভাবছে পাগলের মত!

কিন্তু কৌশিক? ও কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে? অফিসে যাবার আগে ভাগে কৌশিককে ফোন করে রুম্পা। কৌশিক বিশ্বাস করে না। ‘অসম্ভব, হতেই পারে না। স্ট্রিপে বিশ্বাস নেই, ল্যাবে টেস্ট করাও।’ রুম্পা তাই করল। কৌশিকই ল্যাব থেকে রিপোর্ট নিয়ে রুম্পার অফিসে গিয়েছিল। কৌশিকের চেহারায় কুরবানির পশুর মতো আতঙ্ক। সেদিকে চেয়ে রুম্পা ভয় পেয়ে যায়, ‘কী হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?’

কৌশিক হাঁসের মতো ফ্যাসফেঁসে গলায় বলে, ‘রিপোর্ট পজেটিভ।’

রুম্পা হা হা হা করে হেসে ওঠে। ‘এতে ভয়ের কী আছে?’

‘ভয়ের কী আছে মানে? তোমার ভয় করছে না?’

‘মোটেই না। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম।’

‘তার মানে? তুমি আমাকে বলেছিলে যে, কনট্রাসেফটিভ পিল খাচ্ছ?’

‘মিথ্যে বলেছিলাম।’

‘কেন?’

‘আমি মা হতে চেয়েছি কৌশিক।’

‘কিন্তু আমি তো তোমার সন্তানকে স্বীকৃতি দিতে পারব না।’

‘তোমাকে স্বীকৃতি দিতে বলিনি তো আমি।’

‘তার মানে সিঙ্গেল মাদার?’

‘ইয়েস।’

‘পরিণতি জানো? তোমার কথা বাদ দাও। যাকে পৃথিবীতে আনছ তার কথা ভেবে দেখেছ? কী পরিচয় হবে তার?’

‘কেন আমার পরিচয়? মা কি পরিচয় হতে পারে না?’

‘সিনেমা? এটা ইউরোপ-আমেরিকা নয় রুম্পা। একজন ইলিগ্যাল সন্তানকে মেনে নেবার জন্য এই সমাজ এখনো প্রস্তুত নয় সেটা তুমি খুব ভালো করে জান।’

‘ইলিগ্যাল’ শব্দে রুম্পার ভেতরে কী যেন হয়ে যায়। ধারালো কোনো ছুরি ফালা ফালা করে অসংখ্য খণ্ডে ভেতরটা বিভক্ত করে ফেলে।’

‘ওহ! সন্তান জন্ম দেওয়া ইলিগ্যাল, আর আমার সাথে চার দেয়ালের মাঝে যা করেছিলে সেটা ইলিগ্যাল নয়, তাই না?’

অকস্মাৎ দুজনের মাঝের নির্জন দুপুরগুলো এমন নগ্নভাবে উন্মুক্ত হয় যে কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারে না। কৌশিক প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে যায়।

সেই স্ট্রিপ টেস্ট থেকে শুরু করে এ কয়টা দিন যেন ডানায় ভর করে হাওয়ায় উড়ছিল রুম্পা। সোনালি রোদের চাঁদরে মুড়িয়ে নিয়ে ছিল নিজেকে। অপেক্ষার নিশিদিন তাকে জাগিয়ে রেখেছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুটো পায়ের ধ্বনি। ছাদের এই ঘর দুটোয় বড্ড বেশি হাওয়া। শীত আসছে। বাসা বদলাতে হবে। নইলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। অফিসের পাশে হলে ভালো হয়। একজন মেইডও দরকার। রুম্পা যখন অফিসে থাকবে ওকে দেখবে কে? আহ, মা কেন অকালে চলে গেল? এই শহরে আপন বলতে দূর সম্পর্কের এক খালা। তাঁকেই না হয় সেই বিশেষ কদিনের জন্য নিয়ে আসবে। এসব পরিকল্পনার মিহি সুতো দিয়ে যখন রুম্পা আলোর চাঁদর তৈরি করছিল তখনই কৌশিকের ‘ইলিগ্যাল’ শব্দটি চাদরটিকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে। নিউরনে প্রচণ্ড ঝড় তুলে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়।

সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরে ফোন করে কৌশিককে। কৌশিক ফোন রিসিভ করে না। মেসেজ পাঠায় রুম্পা। ‘প্লিজ কৌশিক, একবার অফিসে এস। জরুরি আলাপ আছে।’

কৌশিক আসে। ভীষণ গম্ভীর।

কৌশিকের হাত চেপে ধরে রুম্পা, ‘প্লিজ, কৌশিক আমাকে বিয়ে কর।’

‘কী বলছ পাগলের মতো? আমার সংসারের কী হবে? আমার বউ বাচ্চারা এই শক মেনে নিতে পারবে? বাচ্চারা এখনো যথেষ্ট বড় নয়।’

‘আমি তোমাকে সংসার ত্যাগ করতে বলছি না, কৌশিক। আমার সন্তানের পিতার পরিচয়টুকু শুধু চাচ্ছি। ভরণ পোষণ, কোনো দায় দায়িত্ব নিতে হবে না।’

‘না রুম্পা সেটা সম্ভব নয়। জানাজানি হলে আমার সংসার টিকবে না।’

রুম্পা দাঁত দিয়ে অধর চেপে ধরে। চোখ গলে পানি পড়ছে। হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে বলে, ‘যাও, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কিন্তু আমি আমার সন্তানকে মারতে পারব না।’

‘দুমাসের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারবে। তোমার ডিভোর্স হয়েছে ‘দু’বছর পার হয়ে গিয়েছে। কী বলবে? কার সন্তান?’

‘আর যাই বলি তোমার কথা কাউকে বলব না। সুতরাং ভয় নেই। তুমি যাও। শান্তিতে সংসার কর। আমি যদি কিছুই না করতে পারি, মরতে তো পারব।’

‘পাগলামি করো না। এখনো সময় আছে রুম্পা। স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে বাস্তবে এস।’

কৌশিক চলে গেলে নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করতে থাকে রুম্পা। যুক্তির ছুরি দিয়ে কুচিকুচি করতে করতে ভাবে, কেন নিজের সত্তায় এই বিভক্তি? কোনো কাগুজে সম্পর্ক ছাড়াই সে তো মা হতে চেয়েছিল। তার সন্তানের একক দাবিদার হতে চেয়েছিল সে। তাহলে কৌশিকের কাছে কেন এই আকুতি? আহ, জল আর জল! মাথার চুল অবধি ডুবে আছে সে জলে। ধর্ম, সমাজ, সংস্কারের ভরা থৈ থৈ গাঙ চারপাশে।

মেয়ে বয়স থেকে অদ্ভুত নেশা ছিল শিশুদের প্রতি। পাড়ায় কোনো শিশু ভূমিষ্ঠ হলে রুম্পার কাছে খবর চলে আসত সবার আগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঁতুড় ঘরে বাচ্চা কোলে বসে থাকত। ওর আদরের অত্যাচারে মায়েরা রুম্পাকে ভয় পেতে শুরু করেছিল। সাজ্জাদের সাথে বিয়ের পাঁচ বছর পরেও সেই রুম্পার কোনো সন্তান হলো না। একটি সন্তানের আশায় কি না করেছে! কোথায় কোথায় না গিয়েছে! পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। সাজ্জাদ বলত সস্তানের জন্য রুম্পার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা সেটা অস্বাভাবিক। এর জন্য বহুদিন মনোচিকিৎসক নার্গিস খানের কাছে কাউন্সিলিং করিয়েছে রুম্পাকে। কিছুতে কিছু হয়নি। এক সময় সাজ্জাদকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসে। কিন্তু পুনরায় বিয়ের ভাবনা ভাবলেই এক ধরনের বিতৃষ্ণায় মন ছেয়ে যেত। অথচ সন্তানের আকাঙ্ক্ষা তখনো এতটুকু কমেনি। ঠিক সেই সময়ে কৌশিক আসে তার জীবনে। বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক।

কিন্তু রুম্পা আইসিইউতে কেন? লায়লা বলেছিল ঘণ্টা দুই রেস্ট নিয়েই ছুটি। তাহলে কি কোন সমস্যা হলো? কৌশিক কি এসেছে? না আসলেও বা কি! রুম্পা ওটিতে ঢোকার আগে কৌশিককে একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছিল। নার্সটি এখনো তার লেখায় মগ্ন। রুম্পা দুর্বল গলায় তাঁকে ডাকে। এবার নার্স খেয়াল করে। এরও বেশখানেক বাদে রুম্পা আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আসে। লায়লা কিছুতেই আজ রিলিজ দিতে রাজি হচ্ছিল না। বারবার বলছিল, কোনো কারণে ব্লিডিং হলে সমস্যা হবে। কিন্তু রুম্পা প্রায় জবরদস্তি করে বেরিয়ে আসে। ওর ভাবনা ছিল কলেজ জীবনের বন্ধু বলেই হয়তো লায়লা অধিক সাবধানতার জন্য এভাবে আইসিইউতে রাখতে চাচ্ছে।

কৌশিক প্রায় দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে। ‘তুমি ঠিক আছ তো রুম্পা?’

রুম্পা হাসে। কৌশিকের বুকের মধ্যে মাথা এলিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘জানো আমাদের বাচ্চাটাকে ওরা সিরিঞ্জে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। কৌশিক কথা বলে না।’

‘আচ্ছা তোমার বাচ্চারা কেমন আছে?’

কৌশিক বুঝতে পারছে না রুম্পার আজকের আক্রমণ কোনদিক থেকে আসবে। তবুও শান্ত স্বরে বলে, ‘ওরা ভালো আছে।’

‘ছেলেটার সেদিন জ্বর হয়েছিল তুমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলে, তাই না?’

‘হ্যাঁ, দুদিন খুব কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা। আমিও ঘুমুতে পারিনি।’

‘ওহ, ঘুমুতে পারোনি!’ রুম্পার হাসিতে শ্লেষ। ‘আচ্ছা কৌশিক, আজকে তোমার আর একটা সন্তানকে ওরা মেরে ফেলল। তোমার কিন্তু একদম কষ্ট লাগেনি। রাতে নিশ্চয় ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না? কেন, অবৈধ বলে? তাহলে সন্তানের মায়া কি বৈধ-অবৈধ বিচার করে হয়?’

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে রুম্পা হাফাতে থাকে।

‘রুম্পা প্লিজ থামো।’

রুম্পা থামে না বরং মৃদু হেসে বলে, ‘জানো আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল বাচ্চাটা ছেলে না কি মেয়ে? দুমাসে সেটা জানা সম্ভব ছিল না, তাই না?’

‘কী জানি।’

‘আমি কিন্তু ছেলেমেয়ে দুজনেরই নাম ঠিক করে ফেলেছিলাম, শুনবে?’

রুম্পার চোখ অনির্দিষ্ট। কৌশিক ভয় পায়। ছোট্ট করে বলে, ‘বল।’

‘মেয়ে হলে তোমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে হবে ‘কৃষ্টি’ আর ছেলে হলে আমার নামের প্রথম অক্ষর, ‘রাব্বি’। কিছুই হলো না কৌশিক। ও ডাস্টবিনে আবর্জনার সাথে মিশে গেল পরিত্যক্ত টিস্যুর মতো।’

রুম্পার চেহারায় উন্মাদনার ছাপ। কৌশিক প্রমাদ গোনে। রুম্পা আস্তে কথা বলছে না। লবিতে বসে থাকা লোকজন ওদেরকে চোখ দিয়ে যেন গিলছে। কৌশিক রুম্পাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বলে, ‘রুম্পা, প্লিজ চুপ কর। তোমার শরীর খারাপ করবে।’

‘করুক। আমি মরলেইবা কী? যাও, তোমার বৈধ সন্তানদের কাছে ফিরে যাও। আর কক্ষনো আমার কাছে আসবে না।’

কৌশিককে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় রুম্পা। ও ভুলে যায় লায়লা তাকে খুব সাবধানে থাকতে বলেছে। কৌশিক রুম্পার হাঁটার সাথে তাল রাখতে পারে না।

রুম্পা যখন হাসপাতাল ছেড়ে রাস্তায় নামে তখন শেষ বিকেলের মিহি রোদ। অথচ রুম্পা ভাবল হাজার সূর্যের তাপে তার মগজ ফুটছে। ঘরে ফিরে ঘণ্টা ধরে শাওয়ারের নিচে নিজেকে চুবিয়ে রাখে কিন্তু তাপ কমে না। তলপেটে বিজবিজে ব্যথা হচ্ছে। রুম্পা দুহাতে পেট চেপে ধরে হু হু করে কাঁদে। ব্যথার জন্য নয়, শূন্যতা বোধে। সবাই ছেড়ে চলে যায়। যাবার মিছিলে নতুন নতুন যোগ হয়। বাবার চেহারা মনে পড়ে না। মাকে তবুও অস্পষ্টভাবে মনে আছে। আর আজ যে গেল সে কে ছিল? কেইবা হতে পারত? আত্মজ অথবা আত্মজা? বাস্টার্ড? বিরাট এক জিজ্ঞাসা চিহ্ন রুম্পার সামনে ঝুলে থাকে।

তীব্র ইচ্ছা সত্ত্বেও জরায়ুতে রক্তপিণ্ডটির জায়গা হলো না। ওকে জবরদস্তি বের করে দিতে হলো। হত্যা করা হলো। কেন ওকে দুনিয়ায় আনতে পারল না রুম্পা? কিন্তু কিইবা তা করতে পারত? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরুষ থেকে পুরুষে বয়ে আসা সংস্কার, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা, ফাঁপা সামাজিকতা না জানি কতো নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মধ্যবিত্তের বোধের ভিটেয় শেকড় গেঁড়ে আছে। হাড়মজ্জায় মিশে লীন হয়েছে। সেসব কীভাবে সে অস্বীকার করবে? বসার ঘরের সোফায় বসে নিজের পক্ষে এমন সব যুক্তি খাঁড়া করতে থাকে রুম্পা।

দিন আর রাতের সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে যায়। বাইরে আঁধারের ফিনফিনে চাঁদরে গভীরতা ভর করে। রুম্পা আলো জ্বালে না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেয়াল স্পর্শ করে। যেখানে হাসিমুখের শিশুগুলো পোস্টার হয়ে ঝুলে আছে। রুম্পার স্পর্শ পেয়ে ওরা যেন জেগে ওঠে। সমস্বরে ডাকে ‘মা’। কিন্তু রুম্পার মনে হলো ওরা হুংকার দিল। ওরা জানতে চাইছে তাকে কোথায় রেখে এলে? কেন রেখে এলে? রুম্পা ভয় পায়। একটার পর একটা পোস্টার টেনে নামিয়ে আনে মেঝেতে।

পেটে রাক্ষসের ক্ষুধা। লায়লা বলেছে বিশ্রাম নিতে, ভালো খেতে। ব্যথাটা বাড়ছে। রুম্পা পাত্তা দেয় না। ব্যথাটা ওকে টেনে বিছানায় নেয়। পাশে রাখা মোবাইলে টুং করে শব্দ হয়। ইচ্ছা হয় না, তবুও মোবাইলটা চোখের সামনে ধরে। মেসেঞ্জারে কৌশিকের দীর্ঘ মেসেজ। রুম্পা পড়তে পারে না বা পড়তে ইচ্ছে হয় না। শরীরটা ভারী হয়ে ক্রমেই কোনো এক খাদে তলিয়ে যেতে থাকে।

জানে না কী কারণে আর কত সময় বাদে আবারো সেই খাদ থেকে উঠে আসে রুম্পা। তলপেট আর কোমর প্রচণ্ড ব্যথায় ছিড়ে পড়ছে। ঘরে লাইট জ্বলছে। বিছানা রক্তে ভিজে সপসপে। রুম্পা পা নাড়াতে গিয়েও পারে না। জগদ্দল পাথর হয়ে রক্তের ভেতর পড়ে থাকে। লাইটের আলো ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসে। জমাট আঁধার যখন রুম্পার চারপাশে জাপটে আসে তখন দূর থেকে মিহি সুরে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। কিন্তু আজানের শেষটা রুম্পা আর শুনতে পায় না। তার জায়গায় আলাদা একটি শব্দ ওকে সচকিত করে। শিশু কণ্ঠে কেউ রুম্পাকে ডাকছে। রুম্পা খুব করে সেদিকে মনোযোগ দেয়। ‘মা’, ‘মম’ বা ‘মাদার’ এমন কোনো অস্পষ্ট শব্দ হবে।

রুম্পার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শিশুটি। নাক মুখ চোখ কিছুই স্পষ্ট নয়। শুধু অবয়ব দেখে ধারণা করা যাচ্ছে যে সেটি মানব শিশু। ও সেখানে বেশি ক্ষণ দাঁড়ায় না। রুম্পার শরীর বেয়ে লকলকিয়ে মাথায় উঠে আসে। ওর পায়ের থপ থপ শব্দ রুম্পার মাথার পাটাতনে দুরমুজ পেটায়। এ কি বিভ্রম, না কি বাস্তব? উফ! রুম্পা মাথা চেপে ধরে। মুহূর্তে একটি শীতল ছোট্ট হাত ওর হাত স্পর্শ করে। ওকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে নেয়।

রুম্পা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিশুটিকে অনুসরণ করে। ওরা একটি রাস্তায় এসে থামে। রাস্তাটি রক্তাক্ত আর পিচ্ছিল। সামনে মানব শিশুর বিশাল মিছিল। প্রত্যেকটি শিশুর শারীরিক গঠন অসম্পূর্ণ। এমন মনে হচ্ছে, ঈশ্বর ওদেরকে তৈরি করতে গিয়ে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছেন। ওরা হামগুঁড়ি দিয়ে তরতর করে রক্তের রাস্তায় এগোচ্ছে। কিন্তু রুম্পা এগোতে পারে না। পা পিছলে পড়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে শিশুটির আর্তচিৎকার রুম্পার কানে ভেসে আসে, ‘মা’।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুন ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়