ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মধ্য বয়সের প্রেম || মনি হায়দার

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৫, ৩১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধ্য বয়সের প্রেম || মনি হায়দার

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

হাফিজুর রহমান প্রেমে পড়লেন অফিস কলিগ মণিকার। মণিকা দেখতে খুব আহামরি না হলেও হালকা গড়নের দেহসৌষ্ঠব চোখে লাগার মতো। শ্যামা রঙের শরীরে যে মাদকতা আছে, মণিকার সঙ্গে দু’একবার গোপনে বসার পরই টের পেলেন হাফিজ। আরো দেখলেন, মণিকার চোখ দুটো দারুণ সুন্দর! গোলাকার, কালো আর গভীর। রিকশায় যখন মনিকার শরীর ছুঁয়ে তিনি বসেন, মানবজনম সার্থক মনে হয়। রিকশা থেকে নামার সময়ে আলতো করে যখন হাত ধরেন, শরীরে পৌরুষের তীব্র ঢেউ খেলে যায়। পার্কে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যখন হাত ধরে বসে থাকেন, নিজেকে সম্রাটের মতো বিশাল আর মহান মনে হয়।

ব্যাপারটা কেমন করে ঘটল, বুঝতেই পরালেন না তিনি। কিন্তু প্রেমে পড়ছেন। রাত বিরাতে, দিনে দুপুরে, অবসরে, স্ত্রীর পাশে বসেও মণিকাকে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। বিয়ের আগে অল্পবিস্তর প্রেমে পড়েননি, এমন নয়। কিন্তু সেসব অঙ্কুরেই হারিয়ে গেছে কালের সীমানায়।

অফিসে হাফিজুর রহমান মাঝারি মানের কর্মকর্তা। সরকারি অফিস। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর। ঢাকা শহরের হার্ট পয়েন্টে অফিস। একাই একটা রুমে বসেন। একজন বয়স্ক পিয়নও আছে। দুটি মেয়ে দুলকি আর ফুলকি, আর ওদের মা জাহানারা বেগমকে নিয়ে সুখ দুঃখের সংসার। দুলকি এ বছর এসএসসি দেবে। আর ছোট মেয়ে ফুলকি পড়ে ক্লাস এইটে। জাহানারার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, পারিবারিকভাবে। উজানগাঁও গ্রামের মেয়ে জাহানারা। একই গ্রামের মানুষ হাফিজুর রহমান। এসএসসি পাশ করার এক বছর পরে ভানডারিয়া উপজেলার সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিল জাহানারা। কয়েকদিন কলেজে যেতে যেতেই বিয়ে হয়ে যায় গ্রামের ছেলে হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। হাফিজুরের তখন চাকরির বয়স তিন বছর। সরকারি কলোনি জুটিয়ে বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় সংসার পাতেন তিনি। সবই চলছিল নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যাবতীয় সুখ-দুঃখ, টানাপোড়েন নিয়ে। জাহানারার তেমন কোনো চাহিদা নেই। সুন্দরী না হলেও চলন সই। সংসারঅন্ত প্রাণ। বলা যায়, জাহানারা বেগমের ওপর সংসার ছেড়ে দিয়ে হাফিজুর বেশ আরামেই দিন কাটাচ্ছিলেন। মাঝখানে করাতের মতো ঢুকে গেলো মণিকা মনজুরী। মণিকার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটল হঠাৎ, এক বৃষ্টির দিনে।
আটতলা বিশাল বিল্ডিংয়ের দোতলায় বসেন হাফিজুর রহমান। শৈশব থেকে বৃষ্টির জন্য তার আকুলতা আছে। যখনই বৃষ্টি হয়, হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া নেন। হালকা বৃষ্টিতে রিকশায় উঠে হুড না তুলে ঘুরতে পছন্দ করেন। মাঝরাতে বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙ্গলে উঠে এক চিলতে বারান্দায় যান। ঘুম ঘুম চোখে বৃষ্টিতে জানালা গলে হাতটা বাড়িয়ে ধরেন। বৃষ্টির ছোঁয়া মনে হয়, প্রেমিকার মতো। এই আছে এই নেই। বৃষ্টির দিনে, বিকেলের দিকে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হাফিজুর।

 

আরে আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো?

 

পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেন তিনতলার কম্পিউটার অপারেটর মণিকা দাঁড়িয়ে। মণিকার সঙ্গে টুকটাক কথা হয়। ওর স্বামী থাকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে। একটা মেয়ে আছে। আসা যাওয়ার পথে কিংবা অফিসের কোনো কাজ একসঙ্গে করলে অনেক কথা হয় ব্যক্তিগত। হাফিজুরের মাথায় একটা বিষয়ে ঢোকে না, বিয়ে করে বৌ রেখে বিদেশে স্বামী বছরের পর বছর থাকে কি করে? আর স্বামী একটা না একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে নিতে পারে কিন্তু বাংলাদেশে বিবাহিতা মেয়েটি থাকে আত্মনরকের মধ্যে। সেই বোধ থেকে মণিকার প্রতি এক ধরনের মমতাও ছিল।

বৃষ্টিতে ভিজতে আমার ভালো লাগে।

আমারও লাগে। কিন্তু একটু ভিজলেই আমার জ্বর আসে। আরে আপনি তো একেবারে ভিজে গেছেন। জ্বর হবে তো- মণিকার কণ্ঠে এক ধরনের অনুরাগ।

হাসেন হাফিজুর রহমান, বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর হয় না।

বারান্দা থেকে একটু সরে আসেন মণিকার কাছে, এই জীবনে কতো ভিজেছি বৃষ্টিতে, কখনো জ্বর বা কাশি হয়নি আমার।

জামাকাপড় শুকাবোন কি করে?

শরীরে শুকিয়ে যাবে।

বলেন কি! অবাক মণিকা মনজুরী।

অজস্রবার আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি, কাপড় শরীরেই শুকিয়েছে। কোথায় গিয়েছিলেন?

ডিরেক্টর স্যার একটা ফাইল দিয়েছিলেন কম্পোজের জন্য। শেষ করে পৌঁছে দিলাম। যাই, চারটা বাজে।

যাবার আগে এককাপ চা খেয়ে যান। আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান হাফিজুর। আদা দিয়ে রং-চা একেবারে বিদেশি মদের মতো রং-

দেরি হবে নাতো?

হবে, মাত্র পাঁচ মিনিট।

হাসে মণিকা মনজুরী। কথা বলতে বলতে হাফিজ ঢোকে নিজের রুমে। সঙ্গে মণিকা। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাফিজ চায়ের পানি দিয়েছিল ইলেক্ট্রিক হিটারে। নিজের হাতে দুটো কাপ ধুয়ে টেবিলের ওপর রাখলে, মণিকা হাত বাড়ায়-আপনি বসুন আমি চা বানাচ্ছি।

কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রতিদিনই আমার চা বানিয়ে খাই।

সমস্যা যে নেই সেটা আমিও জানি। কিন্তু আমি চা বানাই, আপনি বসুন। হাত বাড়ায় মণিকা। মণিকার ডান হাতটা আটকা পরে হাফিজুরের ডান হাতে। নরম হাতটা কয়েক মুহূর্ত আটকে থাকে হাফিজুরের হাতের ভেতরে। একটা শিহরণ, বৃষ্টি, আদা-চা, ভেজা গন্ধ, ছোট্ট কিন্তু গোছানো রুমটা অপার্থিবতায় ভরে যায়।

হাতটা সরিয়ে বসে নিজের চেয়ারে, ওকে ম্যাডাম। বানান। ঐ টেবিলের ওপর সব সাজানো।


মণিকা দ্রুত হাতে চা বানিয়ে এক কাপ বাড়িয়ে দেয় হাফিজুরের দিকে, আর এক কাপ নেয় নিজে। দু’জনে মুখোমুখি। সামনে ধুমায়তি দু’কাপ চা। ধরে আসা বৃষ্টিটা আবার ঝরতে শুরু করেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকায় হাফিজুর, দারুণ চা বানিয়েছেন।

তাই? একটু প্রশয়ের হাসি মণিকার চওড়া মখমলে ঠোঁটে।

আরো টুকটাক কথা, কথার মধ্যে চা-পান শেষে চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়ায় মণিকা, আসি?

আসবেন তো বটেই কিন্তু মাঝে মাঝে খেতে আসতে ভুলবেন না।

আসবো, চলে যায় মণিকা। রেখে যায় নিঃশব্দ ঘ্রাণ।

পরের দিন দুপরের দিকে মণিকা প্রায় দৌড়ে আসে রুমে, একটা উপকার করতে পারবেন?

আগে তো বসুন। কি উপকার?

আমার হাজার পাঁচেক টাকা দরকার। কাল দিয়ে দেবো। আমার ছোট ভাই এসেছে, ও চাইছে।

পাঁচ হবে না, চার বা সাড়ে চার হবে। দেবো?

দিন। এতক্ষণ কথা বলছিল দরজায় দাঁড়িয়ে। মানিব্যাগ বের করলে ভেতরে ঢুকে গতকালের চেয়ারে বসে মণিকা, মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে গুনতে গুনতে দেখে সাড়ে চার নয়, প্রায় ছয় হাজার টাকা আছে। হাসে মণিকা, নিজের মানিব্যাগে কতো টাকা আছে, সেটাও জানেন না?

আমি হিসাব টিশাব বুঝি কম। আপনাকে পাঁচ হাজার দিতে পারলাম, ভালো লাগছে। নিন।


টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় মণিকা, কালই দিয়ে দেবো। অনেক উপকার করলেন।

অতো তাড়া কিসের, কাল না পারেন পরশু দিয়েন। নো টেনশন।

কিন্তু পরের দিন, তার পরের দিন এবং তার পরের দিনই মণিকা টাকাটা নিয়ে আসে না। এমকি দেখাও হয় না। ঘটনা কি? মেয়েটা কি আমার সঙ্গে...। হাফিজুর রহমান কোনো বিকল্প ভাবতে চান না। মানুষের কত বিচিত্র সমস্যা থাকে, থাকতে পারে। হয়তো বেতন পেয়ে দেবে। টাকাটা নিয়ে একদমই ভাবতে চান না। পরের দিন মণিকা প্রায় দৌড়ে ঢোকে, হাফিজুর বের হচ্ছিলেন রুম থেকে। হাফিজুরের ওপর পরতে পরতে নিজেকে সামলে নেয় মণিকা, আমি সরি।

কিসের সরি? হাসেন হাফিজুর রহমান।

তিনদিন আগে টাকাটা দিয়ে যাবার কথা ছিল। টাকাটা আমার ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কাজের চাপে একদম ভুলে ছিলাম। হাত বাড়ায়, নিন টাকাটা। কিছু মনে করেননি তো?

আমি লাঞ্চে যাচ্ছি। যাবেন আমার সঙ্গে?

আমি যে লাঞ্চ নিয়ে এসেছি।

নিয়ে এসেছেন তাতে কি! পিওন কাউকে দিন, আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চাইনিজ খাওয়াবো।

একটু ভাবে মণিকা মনজুরী, আজ না কাল।

কাল তো অফিস বন্ধ।

পরের দিন।

কথা পাক্কা?

একদম পাক্কা।

সেদিন লাঞ্চ খেতে খেতে দু’জনার মধ্যে টুকটাক ব্যক্তিগত কথা হয়। খাওয়ার শেষে কফি পান করতে করতে হাফিজুর রহমান বলেন, একটা প্রশ্ন করতে চাই?

করুন।

ছোট টেবিল দু’জনার মাঝখানে। টেবিলে হাত রাখলেই ছুঁয়ে দেয়া যায়। মণিকার দিকে একটু ঝুঁকে, আস্তে করে বলেন- এই যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস স্বামী ছেড়ে থাকো, কষ্ট হয় না?

মণিকা কফির কাপ নামিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকায়, তাকিয়েই থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে টপটপ জল পরতে শুরু করে। হাফিজুর অবাক, হাতটা আলতো ধরে, কাঁদছো কেনো?

নিজেকে সামলে নিয়ে মণিকা বলে, কষ্টের কি শেষ আছে? কেউ বোঝে না। আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম ঘর পালিয়ে।

তাই নাকি? টিস্যু এগিয়ে দেয়, চোখ মোছো।

কিন্তু সংসারের জন্য ওকে বিদেশে যেতে হলো। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়, ফোনে কথা হয় প্রায় প্রতি রাতে। কিন্তু তাতে কি আমার মন ভরে?

চলো।

বাইরে এসে রিকশা নিয়ে দু’জনে বসে। হাফিজুরের শরীর ভারী। মণিকা হালকা। দুটো শরীর লেগে গেলে হাফিজুর লক্ষ্য করেন, মণিকা নির্বিকার। সাবলীল বসে আছে পাশে। রিকশা ছুটছে। বাতাসে চুল উড়ছে। হাফিজুর রহমানের মন ও শরীর ফুরফুরে বিশাল একটা গোলাপের বাগানে প্রবেশ করে। চারদিকে গোলাপ আর গোলাপ। লাল গোলাপ। দুপুরের টাটকা রোদে মণিকার পাশে রিকশায় বসে হাফিজুর রহমান প্রবেশ করনে, কল্পনার অলিক রাজ্যে। স্ত্রী জাহানারা বেগমের সঙ্গে রিকশায় বসলে এতো ভালো লাগে না। তাহলে? নিষিদ্ধ নারীর আকর্ষণ এমন?

অনেক দিন এমন করে কেউ আমন্ত্রণ জানায়নি, মৃদু হাসি মণিকার ঠোঁটে, খুব ভালো লেগেছে।


সেই শুরুর পর থেকে মাসে দু’একবার লাঞ্চ খাওয়া। ছোটখাটো উপহার দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দু’জনে অনেকটা কাছে চলে আসে। দু’জনেই চেষ্টা করে, যাতে অফিসের কেউ না জানে বা বুঝতে পারে। এক ছুটির দিনে সারাটা দিন লালবাগ কেল্লায় কাটিয়েছে, দু’জনে হাত ধরে বেসেছে, চুমুও খেয়েছে মণিকাকে। মণিকার সঙ্গে কাটানো সময়টুকু আনন্দসঙ্গমে পরিপূর্ণ সময়। এক বিস্ময়কর ভালোবাসায় আবেগে হাফিজুর ভেতরে ভেতরে টগবগ করে ফুটতে থাকেন। সংসারে, নিজের স্ত্রীর বাইরে পরকীয়ার অনেক ঘটনা জানেন বা শুনেছেন হাফিজুর রহমান। কিন্তু নিজের জীবনেই ঘটনাটা ঘটে যাবে, কোনোদিন চিন্তাও করেনি। রাতে বাসায় যখন উপগত হন, কল্পনায় চলে যান মণিকার কাছে। জাহানারা বেগম নয়, হাফিজুর ঢুকে গেছেন মণিকার মধ্যে। সঙ্গম শেষ হলে, বিছনায় স্ত্রীর পাশে শুয়ে ক্লান্ত হাফিজুর রহমান অসহায় বোধ করেন।

জাহানারা যদি জেনে ফেলে! প্রতিবারই এক ধরনের অপরাধবোধ, এক ধরনের গ্লানি আক্রান্ত করে। কিন্তু এই টানেল থেকে মুক্তির কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। কোথাও গেলে, ভালো কিছু দেখলে মণিকাকে ফোন করেন হাফিজুর। জানান সৌর্ন্দয। মেয়ে দু’টো বড় হচ্ছে। যদি কোনো দিন মণিকার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক প্রকাশিত হয়, এই মুখ নিয়ে কিভাবে দাঁড়াবেন সন্তান আর নিরাপরাধ স্ত্রীর সামনে? অনেক দিন ভেবেছেন, না মণিকা থেকে দূরে থাকবো কিন্তু অফিসে ঢুকেই প্রথম ফোন তিনি মণিকাকে করেন-পৌঁছেছো?

হ্যাঁ।

চা খাবে?

কোনো দিন তিনতলা থেকে নেমে আসে, চা বানিয়ে নিজে খায়, হাফিজুরকেও দেয়। মাঝে মাঝে পাশের রুমের কলিগদের এনেও চা খাওয়ায়। একটা ক্যামোফ্লেজ তৈরি করে রাখার চেষ্টা আর কি!

এখন অফিসে বিসিএসদের দারুণ দাপট। হাফিজুর রহমান ঢুকেছিলেন উচ্চমান কেরানী পদে আঠারো বছর আগে। প্রমোশন পেতে পেতে এখন ডেক্স অফিসার। বিসিএসরা আড়ালে বলে, প্রমোটি। অর্থাৎ নিচের দিকের পদ থেকে প্রমোশন পেয়ে পেয়ে এখানে এসে পৌঁছেছেন। এক ধরনের অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যের শব্দ ‘প্রমোটি’। কিন্তু গায়ে মাখেন না তিনি।

এইসব তরুণ অফিসাররা এসে চেয়ার দখল করে সাজিয়ে গুছিয়ে যখন বসেন, মনে হয় একেকজন ছোটখাটো রাজা। চারদিকে তাকানোর মধ্যে এক ধরনের তাচ্ছিল্যে দেখতে পানি তিনি। গালগল্প শুনলে মনে হয়, একেকজন জমিদার পরিবার থেকে এসেছে। কিন্তু হাফিজ একটু জোরে নাক টানলেই ওদের শরীরে গোবরের গন্ধ পান। কারণ, অধিকাংশই এসেছে কৃষক পরিবার থেকে। সেই অসাধারণ পরিচয়টা লুকিয়ে রেখে কেনো আজগুবি ফেনানো সব গল্প বলে, বুঝতে পারেন না হাফিজুর রহমান। ভাবনার মধ্যে মোবাইল বাজে। তাকিয়ে দেখেন মণিকার নাম্বার।

হ্যালো?

কাজ শেষ? জিজ্ঞেস করে মণিকা মনজুরী।

কখন! বসে আছি তোমার ফোনের জন্য। আমি কি বের হবো?

হতে পারেন। আমার বের হতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগবে। কোথায় থাকবেন?

আমি চিংড়ি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দোতলায়, কোণার টেবিলে থাকবো তোমার অপেক্ষায়।

ঠিক আছে। লাইন কেটে দেয় মণিকা।

হাফিজুর রহমান দ্রুত উঠে লাইট ফ্যান বন্ধ করে দরজার তালা লাগান। অফিস ছাড়ার আগে একবার বাথরুমে যান। গেলেন আজও। বাথরুম থেকে বের হয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। তিনি চান না, গোপন অভিসার কেউ জানুক। দ্রুত অফিসের পথটুকু পার হয়ে মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি খালি রিকশা পেয়ে কোনো দাম না করেই উঠে পড়লেন। রিকশাঅলা ফিরে তাকালে বললেন, ঝিলের পারে চাইনিজে চলো।


রিকশা চলতে আরম্ভ করেছে। বিকেল নেমে এসেছে শহরের মধ্যেখানে। গোটা ঢাকা শহর এই সময়ে দৌড়াতে শুরু করে দিকহীন। এক সময় কলাপস হয়ে বসে থাকে শহরের মানুষ বাস, রিকশা আর প্রাইভেট গাড়ির মধ্যে। হাফিজ এসব এড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছুতে চান আগেই। যেতে যেতে পড়ন্ত বিকেলের নরম বাতাস তাকে উন্মাতাল করে তোলে।

অনেকদিন ধরে হাফিজুর রহমান একটা প্রস্তাব দিয়ে আসছেন, ঢাকার আশপাশে কোনো রিসোর্টে একটা দিন কাটানোর।

মণিকা যেতেও চায় না, আবার নাও করে না। ঝুলিয়ে রেখেছে। চিংড়ি রেস্টুরেন্টটা আটতলা বিল্ডিংয়ের চারতলায়। হাফিজুর বসেছেন জানালার সঙ্গের টেবিলে। এখানে বসলে পিছনের রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। লোক চলাচল দেখতে ভালোই লাগে। জানালা দিয়ে বাইরের লোক চলাচল দেখতে দেখতে ভাবেন, মণিকা কি আমাকে, আমার মধ্যে বয়সের আবেগ নিয়ে খেলছে? কিন্তু কথায় বা আচরণে তেমন মনে হয় না। আমিই বা কেনো এতটা ডেসপারেট হয়ে গেলাম? একটি সাধারণ মেয়ে, খুব চটকদার নয়। আবার শাড়ি পরলে মণিকাকে অসামান্য সুন্দর লাগে। মণিকা আবেগ বা ভালোবাসার অনুভব থেকে কখনো ফোন করেছে? নিজেই মনে করার চেষ্টা করলেন হাফিজ। না, কোনোদিন এমন ফোন করেনি। কতো বৃষ্টির দিন রাত গেছে, বৃষ্টিপাগল মানুষটা মনে রেখে বা মনে করে একটা ফোন তো করতে পারতো। জিজ্ঞেস করতে পারতো, এই বৃষ্টিবেলায় কোথায় তুমি?

না, তুমিও বলে না। নিজের দিক থেকে একটা দেয়াল নির্মাণ করে রেখেছে খুব গোপনে, জটিল নিয়ন্ত্রণে। অস্বস্তি, বেদনায় হাফিজুর রহমান তড়পায় কাটা কৈ মাছের মতো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর মণিকা ঢোকে, সরি দেরি হয়ে গেল। ভাবনার মধ্যে ঢুকে যায় মণিকা মনজুরী।

হাসেন হাফিজ, তুমি কবে ঠিক সময়ে আসতে পেরেছো? সব সময়ে লেট করেই আসো। বসতে বসতে ম্লান তাকায় মণিকা। হাফিজুর রহমান হাত ধরে, রাগ করলে?

নাহ্, মাথা নাড়ায় মণিকা।


গুড গার্ল। কি খাবে অর্ডার দাও। ওয়েটার এগিয়ে আসলে মেন্যু কার্ড নিয়ে অর্ডার দেয় মণিকা মনজুরী। মণিকার দিকে তাকিয়ে হাসেন হাফিজ। মণিকা প্রশ্ন করে, হাসেন কেনো?

তোমাকে এই মুহূর্তে খুব সুন্দর লাগছে। ইচ্ছে করছে, তোমাকে জড়িয়ে ধরি।

তাই?

মাথা নাড়েন হাফিজুর রহমান, হ্যাঁ। ডান হাতটা টেনে নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে গাঢ় গলায় বলেন, আজকে তারিখটা দেবে বলেছিলে।

কিসের তারিখ?

ভুলে গেলে মণিকা? ওই যে একটা রিসোর্টে যেতে চেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে। গত সপ্তাহে তুমি বলেছিলে, এই সপ্তাহে জানাবে। আমি বড় আশা করে বসে আছি। অনেকটা কাঙ্গালের মতো শোনালো নিজের কানে নিজের কণ্ঠ!

আমিতো যেতে যাই। কিন্তু সংসারের কারণে কিছুই পারি না। আমি জানি, আপনি কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু-থেমে যায় মণিকা মনজুরী।

কিন্তু কী?

আমার মেয়ে আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না এক মুহূর্ত। তার ওপর আমার শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন আমার সঙ্গে। সব সময়ে আমাকে থাকতে হয়...

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একটা দিন, অনুনয় করেন হাফিজুর রহমান-একটু নিবিড় করে সময় কাটাবো তোমার সঙ্গে মণি, মণিকা। আমি জানি, তোমার কাছে আমি একটু বেশীই দাবি করছি। কিন্তু তোমার আমার এই সর্ম্পকের মধ্যে একটা অধিকারও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বলো হয়েছে না?

মাথা নাড়ায় মণিকা, আমি বুঝি।

তাহলে? আমাকে একটা দিন দাও। তোমার হাজার দিন রাত্রি থেকে আমাকে মাত্র একটা দিন দাও। সকালে যাবো বিকেলে, পাঁচ থেকে ছয়টার মধ্যে ফিরে আসবো ঢাকায়। তোমাকে পৌঁছে দেবো কাঁঠালবাগানের বাসায়।

ঠিক আছে, কি করা যায় দেখছি...। হাত ছাড়ুন। ওয়েটার আসছে। ফিসফিসিয়ে বলে মণিকা।

হাত ছেড়ে দেন হাফিজুর রহমান কিন্তু বুকের ভেতরে লক্ষ লক্ষ কবুতর ডেকে ওঠে, মণিকা বলেছে, কি করা যায় দেখছি...। মণিকা আমাকে অনুভব করে। মণিকা আমাকে নিয়ে যাবে প্রেমের তীর্থে। মণিকা আমাকে দেবে স্বর্গের সুখ। মণিকা আমার আঁধার রাতের হাজার নক্ষত্র..

কি হলো? খেতে শুরু করুন।


হাফিজুর রহমানের কল্পনার বিস্তারের মধ্যে মণিকা প্লেটে খাবার তুলে দিয়েছে। হাসতে হাসতে খেতে শুরু করেন হাফিজ, হাফিজুর রহমান। দিন, সময় কত সুন্দর। কত  মায়া ছড়িয়ে আছে পথে পথে। অনেকদিন পরে হাফিজুর রহমান একটু বেশিই খেলেন। নিজের পাত থেকে শর্ষে ইলিশের এক টুকরো পাতে দেয় মণিকা।

আরে, আমাকে দিচ্ছো কেনো? অবাক হাফিজুর।

হাসে মণিকা, আপনি শর্ষে ইলিশ খুব পছন্দ করেন। খান।

মণিকার এই আবদারটুকু হাফিজুর রহমানের অসম্ভব ভালো লাগে। ছোট ছোট অনুরাগ থেকেই তো বড় কিছুর জন্ম হয়। তিনি খেলেন। খাওয়ার পর কফি পান করার সময়ে হাফিজ আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারিখটা জানাও।

আগামী সপ্তাহে জানাবো।

দপ করে নিভে গেলেন হাফিজুর রহমান, আবার আগামী সপ্তাহে?

আগামী সপ্তাহে ঠিক জানাবো, এই প্রথম হাফিজুরের হাতের ওপর নিজের হাতটি রাখে মণিকা।

বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়, ঠিক আছে।

পরের সপ্তাহের প্রথমদিন রোববার অফিসে এসেই ফোন দিলেন অভ্যাসবশত, মোবাইলে রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। ভাবলেন, বাথরুমে গেছে মণিকা। চা বানালেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবার ফোন করলেন তিনি। এবার ফোনটা রিসিভ করে মণিকা, কেমন আছেন? কণ্ঠে দারুণ উচ্ছ্বাস!

ভালো। তোমার খবর কি?

খুব ভালো আমার খবর। গত রাতে আমার জামাই এসেছে। এবার এলো প্রায় দেড় বছর পর। আর আমি এক মাসের ছুটি নিয়েছি। ছুটির পর অফিসে আসবো। ততদিন ভালো থাকবেন। আর শুনুন, আমাকে আর যখন-তখন ফোন করবেন না এখন। বুঝতে পারছেন তো, সারাক্ষণ ওর সঙ্গেই থাকতে হচ্ছে। একটা মুহূর্ত কাছ ছাড়া করতে চায় না। ওকে  বাই। ফোনটা কেটে দেয় মণিকা।

বাইরে কটকটে রোদ।

হাফিজুর রহমান শুনতে পাচ্ছেন তীব্র বৃষ্টির শব্দ। আর সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে তিনি হেঁটে চলছেন, একা একজন এবং ন্যাংটো।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ আগস্ট ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়