ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আয়না ভাঙার পর || মাসউদ আহমাদ

মাসউদ আহমাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আয়না ভাঙার পর || মাসউদ আহমাদ

ল্যান্সডাউন রোডে জীবনানন্দের বাড়িটা যখন খুঁজে পায় রাসেল চৌধুরী তখন দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে।

মেট্রো ট্রেনে কালিঘাট স্টেশনে নেমে সে রাসবিহারী এভিনিউতে এসে দাঁড়ায়। দুই লেনের প্রশস্ত এই রাস্তাটি সোজা গড়িয়াহাট ব্রিজের দিকে চলে গেছে। পায়ে হেঁটে খানিক এগুলেই দেশপ্রিয় পার্ক ও রাসবিহারী মোড়; মোড়ের বাঁ দিকে টার্ন করলে দুটো বাড়ি পরেই ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন রোড। এই ঠিকানায় থাকতেন পরিবারসহ, জীবনানন্দ দাশ।

দিনকয়েক আগেই এক দুপুরে, এখানে ঘুরে গেছে রাসেল। যা-কিছু দেখার ও জানার ছিল, মানুষকে জিজ্ঞেস করে, ছবি তুলে, পুরনো বাড়ির গলি, গন্ধ ও দেয়াল স্পর্শ করে অনেকটাই ক্যাপচার হয়েছে। কিন্তু ষাট বছর আগে, জীবনানন্দ যখন এই বাড়িতে থাকতেন, কলকাতার পথ থেকে পথে ও ফুটপাতে হেঁটে সন্ধ্যায় বা সন্ধ্যা পেরিয়ে অনেক রাতে ঘরে ফিরতেন- কেমন ছিল অচেনা সেই সন্ধ্যাগুলো; কিংবা রাসবিহারী মোড়ের আলো-অন্ধকারের ছবিটুকু? দেখা তো কেবল দেখা নয়, মনের ফ্রেমে স্ন্যাপশট ও ইঙ্গিতবাহী ক্যাপশন জমা রাখাও। সে-রকমই ধারণা করে সে।

রাসবিহারী এভিনিউয়ের বাম পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নানারকম বিপণি বিতান চোখে পড়ে। গোছানো ও পরিপাটি পরিবেশ। ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, মিষ্টির দোকান, চা-স্টল। এই পথ হয়ে বহুদিন হেঁটে বাড়ি ফিরতেন জীবনানন্দ। কথাটুকু ভেবে পায়ের গতি শ্লথ হয়ে আসে রাসেলের। মাটির ভাঁড়ে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়। জীবন মানুষকে কখন কোথায় বয়ে নিয়ে চলে অজানা ইশারায়, বলা কঠিন।

রাসবিহারী মোড়ে গোধূলি নামছে। রাস্তার নিয়নবাতি জ্বলে উঠেছে, নিঃশব্দে। সন্ধ্যা জানান দেয়, দিন ফুরিয়েছে। একসময় ধীর পায়ে কাঙ্ক্ষিত বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। বাড়ির সামনের ফুটপাত থেকে সরে এসে সরু ও নির্জন গলিতে ঢুকে পড়ে, সংকোচে। প্রায় সবুজ রঙের কাঠের বন্ধ দরজার সামনে থেমে যায়। দরজার মরচে পড়া কড়াটি স্পর্শ করে। বুকের ভেতর সামান্য তোলপাড় হয় তার- এই সেই দরজা, বাড়িতে প্রবেশের একমাত্র গলিমুখ, জীবনানন্দ কলকাতা শহরের বহু পথ হেঁটে, ট্রামলাইন মাড়িয়ে গভীর রাতে ঘরে ফিরতেন। বন্ধ দরজার সামনে হয়তো তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন কিছুক্ষণ। নিচু গলায় মেয়েকে ডাকতেন, লাবণ্য যাতে শুনতে না পায়। বউ বিরক্ত হবে বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে; কত কী ভাবতেন তিনি। আহা, বেচারা। জীবন-জীবিকা-দাম্পত্য-স্বপ্ন-বাস্তবতা ও লেখালেখি নিয়ে অচেনা অন্ধকারে ডানা ঝাপটে ফিরেছেন সারাটা জীবন।

দরজা খুলে যায়, হাট করে। রাসেল কিছুটা থতমত খায়।

সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, মধ্যবয়স কিংবা নব্বুই পেরুনো মানুষটি, শাড়িপরা- রাসেল একবার তাকিয়ে কেমন বিব্রত বোধ করে। পেছনে সঙ্গীকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছে, এমন ভঙিতে একবার আড়চোখে তাকায় সে।

মহিলাটি স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, ‘কাকে চাই?’

রাসেল কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তাই তো, কাকে চায় সে? কার কাছে এসেছে এ বাড়িতে? কিন্তু বৃষ্টিঘন রাতে, অন্ধকারে হঠাৎ বিজলি চমকালে যেমন পথঘাট ফর্সা ও পরিষ্কার দেখে ওঠা যায়, মাথার ভেতর তেমন দ্রুত কিছু একটা কাজ করে চলে রাসেলের। দরজায় দাঁড়ানো মহিলাকে দেখে তার কিছুটা সন্দেহ ও দ্বিধা হয়। সে চোখ সরু করে তাকায়, এমন কৌশলে যে, তাঁকে চিনে ফেলেছে। তখন তার বুকের স্পন্দন দ্রিম দ্রিম ওঠানামা করে। সংকোচে সে বলেই ফেলে-‘আচ্ছা, আপনি কি সেই...’

মহিলা একমুহূর্ত দেরি করেন না মুখ খুলতে- ‘আমি লাবণ্য দাশ। আপনি?’

রাসেলের মাথার উপর ভ্রমর উড়তে থাকে বোঁ বোঁ আওয়াজে। কিন্তু মহিলাকে কিছু বলে ওঠার অবকাশে একটা হিসাব মেলাতে থাকে সে। শহর বা গ্রামে মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যেমন চিহ্ন ও গন্ধ রেখে যায়, সামনে দাঁড়ানো এই নারী, তরুণ বয়সে যে অত্যন্ত সুন্দরী ও মায়াবতী ছিলেন, বোঝা যায়। বোঝে রাসেলও। ছবিতে দেখা চেহারার সঙ্গে বাস্তবে চোখের সামনে দাঁড়ানো মানুষটির মিলও খুঁজে পায়। তফাৎ এই যে, বয়সের ভারে মহিলাটির মুখ ও শরীরের চামড়া কুঁচকে এসেছে। চুলও পাতলা। কিন্তু দেহটা এতটুকু ন্যুব্জ নয়।

দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় রাসেল। বলে, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এই বাড়িতেই তো কবি তাঁর জীবনের শেষ ক বছর কাটিয়েছেন, না?’

তিনি কৈফিয়ত দেবার মতো করে বলেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু তিনি তো নেই। সেই কবেই-’

‘তা জানি। সে-কথা কে না জানে। আমি আসলে বাড়িটা দেখার অভিপ্রায়ে এখানে এসেছি। এসে ভালো হলো। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।’

‘কিন্তু আমি যে একটু বেরুচ্ছি ভাই!’

‘হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।’

‘আমি তো কোনো ফোন ব্যবহার করি না। আমার ভাইপোকে একটা খবর দিতে হবে।’

রাসেল নিঃশব্দে হাসে।

‘হেঁটেই যাব। আপনি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন।’

গলি ছেড়ে ল্যান্সডাউন রোড পেরিয়ে তারা রাসবিহারী মোড়ে এসে দাঁড়ায়। চার রাস্তার মোড়। রাস্তায় নিয়নবাতি জ্বলে উঠেছে। আলো ঝলমলে পথ। সিগন্যালে আটকা পড়েছে একপাশের গাড়ি। অন্যপাশের গাড়িগুলো ছুটে চলেছে। ধীর গতিতে একটা পুরনো ট্রাম চলে যায় গমগম শব্দ তুলে। আর মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা।

লাবণ্য বললেন, ‘একটু দাঁড়াও ভাই। আমি লন্ড্রির ছেলেটাকে বলে আসি, কাপড়গুলো এখন নিচ্ছি না।’

রাসেল মাথা দোলায়, ‘আচ্ছা।’

এই রাস্তার ঠিক কোন্ জায়গায় জীবনানন্দ ট্রামের নিচে চাপা পড়েছিলেন? চুনিলালের ‘জলখাবার’ দোকানটা কোথায়?

পাশেই একটা ইয়া মোটা মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করবে রাসেল, তখনই লাবণ্য এলেন-‘চলো, রাস্তাটা পেরোই।’

রাস্তা পেরিয়ে ওরা দেশপ্রিয় পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। লাবণ্য বলেন, ‘চা খাবে একটু?’

‘তা খাওয়া যায়।’

‘দেশপ্রিয় হকার্স কল্যাণ সমিতি। স্থাপিত : ১৯৪৮’ - সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল রাসেল। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে লাবণ্য বললেন, ‘একসময় মাস্টারি করতাম। ছেলেমেয়ে, সংসার ও স্কুল- সময়টা যাহোক কেটে যেত। এখন বড় একঘেয়েমি  লাগে। সময় কাটতে চায় না।’

চা খেতে দারুণ হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা, কলকাতায় এসে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা রাসেলের-মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়া।

লাবণ্যর কথা শুনে রাসেল মৃদুচোখে তাকায়। হাসে।

লাবণ্য বলেন, ‘তুমি কলকাতায় কেন এসেছ বলছিলে?’

চা শেষ করে ভাঁড়টা ছুঁড়ে দেয় রাসেল। সে, জীবনানন্দের খোঁজে কলকাতায় এসেছে শোনার পর, প্রথমে গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে ওঠেন লাবণ্য দাশ।

কিন্তু খানিক বাদেই তাঁর ভেজা চোখ দেখতে পায় রাসেল।

অত্যন্ত বয়স্ক এক ভদ্রলোক, খাটো পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা, এগিয়ে এলেন- ‘দিদি, কেমন আচো? বহুদিন পর তোমাকে দেখলুম।’

লাবণ্য হেসে বললেন, ‘আপনার শরীর ভালো?’

লোকটি মুখ পানসে করে বলে, ‘আর শরীর। মরলে বেঁচে যাই দিদি।’

নমস্কারের ভঙিতে হাত উঁচিয়ে মিষ্টি করে হেসে দিলেন লাবণ্য। তারপর পাশে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো ভাই।’

লোকটি চলে যায়।

রাসেল বলে, ‘অমিতানন্দর বাড়িতে কি হেঁটেই যাবেন? পথ তো কম নয়।’

‘তুমি চেনো বুঝি?’

প্রাচীন সাপের মতো পড়ে থাকা লাইন ধরে আর একটা ট্রাম চলে যায় গড়িয়াহাটার দিকে। রাসেল সেদিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। ট্রামের গতি এত স্লো?

‘দেশপ্রিয় পার্কের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। কবি এই মাঠে হেঁটে ঘরে ফিরতেন। এসো।’

লাবণ্যকে অনুসরণ করে রাসেল।

ঘাস এমন সবুজও হয়! সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মাঠের চারপাশে আলো জ্বলছে। সবুজ ঘাসের পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নারী-পুরুষ বসে গল্প করছে নিজের মতোন। কপোত-কপোতি বেশি। মুখ দেখেই বোঝা যায়।

তারা মুখোমুখি বসে, মাঠের সবুজ ঘাসের পরে।

কী একটা কথা শুধানোর ছলে লাবণ্য আকাশের দিকে মুখ তোলেন। একবার রাসেলকে দেখেন। চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। রাসেলের একবার মনে হয়, সন্ধ্যায় দেখা হলো বটে, কিন্তু কথা বলা ও চুপ থাকার ছলে আড়চোখে বা সরাসরি সে খেয়াল করে তাঁকে। সন্ধ্যা যেন লেগে আছে সারাক্ষণ লাবণ্যর দুচোখের কোলে। এমন নয় যে, লাবণ্যর চোখের শোভা সুন্দর বা মায়াবী নয়। তিনি, একসময় অভিনয়ে নাম লিখিয়েছিলেন, সে-কথা মনে রেখেও রাসেলের মনে হয়, তাঁর চোখে সকালের নরম রোদ ওঠা নেই, দুপুরের গনগনে তাপ নেই- সারাদিন কেবলই তাতে সূর্যাস্ত শুধু।

‘কবিতায় বলেছিলে, চন্দ্ররাতে তুমি আসবে কাছে...’

মাঠের কিনারে কেউ একজন তারস্বরে গান গেয়ে ওঠে। লাবণ্য একবার সেদিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কোথায় উঠেছ তুমি?’

‘কলেজস্ট্রিটে, একটা গেস্ট হাউজে। ডাবল বেডে একা।’

লাবণ্য চোখ সরু করে বললেন, ‘সেটা কেমন?’

‘দুই বেডের ঘর। কিন্তু আমি থাকি একা। সিঙ্গেল ঘর পাওয়া যায়নি।’

লাবণ্য মিষ্টি করে হাসেন-‘জগতে কিছু মানুষ একাই থাকেন, সারাজীবন। নিয়তি।’ একটু বিরতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কোথায় বাড়ি তোমার? বরিশালে গিয়েছ কখনো? বগুড়া রোড? আমার জীবনের একটা বড় সময় ওখানে কেটেছে, শশুরবাড়িতে।’

‘হ্যাঁ, কয়েকবারই গিয়েছি। শান্ত, স্নিগ্ধ এক ছোট্ট শহর।’

লাবণ্য কি একটু স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন? ঠোঁট ও চিবুক জড়ো করে দূরে তাকান তিনি। চোখে জল চিকচিক করে।

বউদি, বলছিলাম কী- কবি আলোক সরকারের স্ত্রী মিনু, তিনি বলছিলেন যে, ‘বনলতা সেন অন্য কেউ নয়, আমি, আমিই তো। আমাকে নিয়েই জীবনানন্দ এই কবিতা লিখেছেন। অন্য কাউকে ভেবে তিনি এই কবিতা লিখেছেন? একদম নয়’; গল্পচ্ছলে প্রায়ই এমনটি বলতেন আপনি। আর সেই কথাটুকু বলার সময় আপনার চোখে কোনো ভান বা দ্বিধা ছিল না, একধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সারল্য ছিল। আত্মবিশ্বাসও। এটা কি সত্য?’

হঠাৎ আলো চলে গেলে বা শেষরাতের চাঁদ ডুবে গেলে যেমন অন্ধকারে ছেয়ে যায় চরাচর, লাবণ্যর মুখেও তেমন অন্ধকার নেমে এলো। কিন্তু একমুহূর্ত পরেই ঠোঁট প্রসারিত করে দীর্ঘ করে তিনি হেসে ওঠেন। এই বয়সেও, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চামড়া কুঁচকে যাওয়া গালেও টোল পড়ে। সরুচোখে তাকিয়েও রাসেল ভালোমতো দেখতে পায়।

শোনো বাপু, ‘কবি হিসেবে মিলু যতটা অন্তঃপ্রাণ ছিল, সংসারে তার মন একেবারেই ছিল না। তবে জানো,  ছেলেমেয়েকে সে খুব ভালোবাসতো। আর মানুষ হিসেবে সে এতটা নিরেট ও হাবলুশ ছিল, বলার মতো নয়। বিয়ের বহু বছর পর জেনেছি, তার বাইপোলার ডিজঅর্ডার রোগ ছিল। কবিতা নিয়ে থেকেও অনেকে ভালো চাকরি করেছেন। করেননি? কবি বুদ্ধদেব বসু বা তাঁর বন্ধু প্রেমেন্দ্র, কিংবা অচিন্ত্যকুমার। কত টাকা তারা কামিয়েছেন। মিলুর সেদিকে বলতে গেলে কোনো খেয়ালই ছিল না।’

রাসেল বলল, ‘মানুষের বুকের ভেতর অনুভব ও মায়া কিংবা প্রেরণার পিণ্ড আলো থাকে। বেশিরভাগ সময় ওটা চাপা থাকে। কখনো কখনো অপর কাউকে তা জাগিয়ে বা জ্বেলে দিতে হয়।’

‘হুম। কীসের আলো টালো? তোমার দাদার কোনো মনই ছিল না সংসারে। খালি ওই কবিতা।’

রাসেল হাত কচলে একবার তাকায় লাবণ্যর মুখে। কিছু বলতে গিয়েও বলে না। লাবণ্যও নীরব থাকেন।

এরপর কথায় খানিকটা পজ এসে যায়। কথা মুখ বাড়ায়। কথা উঁকি দেয়, কিন্তু ভাষা পায় না। কয়েকটা মুহূর্ত তাই নৈঃশব্দে ভরে ওঠে।

লাবণ্য বলেন, ‘তুমি বিয়ে করেছ?’

রাসেল লজ্জিতভাবে হাসে, ‘না। এখনো করিনি। বিয়ে করলে কী হয়?’

‘শোনো বাবু, প্রেমে ও সংসারে মেয়েরা যতটা বৈষয়িক জিনিসকে গুরুত্ব দেয়, তারচেয়ে ঢেরগুণ প্রিয় মানুষটির মন ও মনোযোগ আশা করে। কেমন?’

রাসেল বলে, ‘জীবনানন্দর মাথা ও গলাটা দিনের পর দিন ঘাড়ের ওপরে দেবে যাওয়া, এমনকি ভর সন্ধ্যায় ট্রাম দুর্ঘটনা- এটা কোনো সরল এক্সিডেন্ট নয়। তাই না?’

‘তাহলে?’

‘স্রেফ আত্মহত্যা।’

লাবণ্য প্রায় চাপা স্বরে বলেন, ‘কী বলছ তুমি?’

‘হ্যাঁ; এবং সংসারের চাপ ও বেদনাভার তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে। এ সবের মূলে আপনি। নিজের বাড়িতে তিনি নাকি থাকতেন অপরিচিত মানুষের মতো, একা ও অসহায়। কবির পরিচিত ও ঘনিষ্ঠদের অনেকেই তো তাই বলেন।’

রাসেলের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, না-জানি কী প্রতিক্রিয়া দেখান তিনি।

কিন্তু লাবণ্য নিঃশব্দে কথাগুলো শুনে আনমনে বসেই থাকেন।

‘কিন্তু আজ এতদিন পর’... রাসেল আবার কথা বলে ওঠে।

ক্যামেরা প্যান করার মতো কেমন করে যেন তাকান লাবণ্য। রাসেলকে দেখেন। তাঁর সেই দৃষ্টিতে প্রশ্রয় ও আত্মসমর্পণ ছিল কি? বোঝা যায় না।

‘...আমার মনে হয় কী বৌদি, কিছু মানুষ, বা একজীবনে প্রতিটি মানুষকেই হয়তো প্রতিকূল বা আগুনের পথ ধরে হাঁটতে হয়। জীবনানন্দের পথটা ছিল খানিক ধূসর। একা বয়ে বেড়ানোর। কলকাতা শহরে উদ্বাস্তু একটা মানুষ কবিতা নিয়ে ঘুরছে। ভালো লিখেও একটা কিছু করে উঠতে পারছে না। ফলে বাইরে এমন অজনপ্রিয়তা, কখনো কবিতার অন্যায়-অপবাদমূলক সমালোচনার ভার; আবার ঘরে বউয়ের নিত্য ঠেঙ্গানি। এই যে অসহায় মানুষটি, স্বপ্নময় প্রত্যাশার ভেতর দিয়ে কেটে গেছে তাঁর সকাল, বিকেল এমনকি সন্ধ্যাটুকুও। সংসারে প্রতিদিন লাবণ্যময় সময় ও সুখী জীবন উপহার দেবার যে প্রেরণা, অভিপ্রায় এবং সামর্থ, সেটা মার খেয়েছে। সময় ও জীবনের সমীকরণ আসলে সবাই মেলাতে পারে না। জীবনানন্দ তেমনই এক চরিত্র।’ এক চিঠি পরিমাণ কথা বলে থামে রাসেল।

অনেকটা সময় পর লাবণ্য কথা বলেন, ‘ইদানিং একটা কথা খুব মনে আসে, জানো। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দ্বিধাবিভক্ত ব্যাপার কাজ করে চলে। ’

রাসেল বলে, ‘সেটা কেমন?’

‘একভাবে বাঁচতে চায়। কিন্তু অন্যভাবে বাঁচে, অন্য কোথাও।’

হঠাৎ একটা লম্বা মতো তরুণী ওদের দুজনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল-‘দিদি, তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে খুঁজে মরছি। বাসায় গিয়ে দেখি, তুমি নেই। ’

‘ওহ, নবনী তুই। পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।’

নবনী হেসে হাই জানায়। বলে, ‘তুমি কি আজ আমাদের বাসায় যাবে একটু? মা বলছিল।’

‘দেখি, যাব মনে হয়।’

‘তুমি একটা ফোন ব্যবহার করলে কত সুবিধে হয়। আমিই কিনে দেব তোমাকে।’

লাবণ্য নরম করে হাসেন।

‘আচ্ছা, আমি চলি। তুমি এসো কেমন।’

‘মেয়েটি চলে যাওয়ার পর রাসেল বলল, ‘সৃষ্টিশীল মানুষের স্বভাবে একধরনের বৈপরীত্য থেকে যায়। সেও একধরনের সৌন্দর্য।’

‘তার মানে কি এই যে, লেখা লেখা করে পাগল হয়ে যাওয়া আর সারাক্ষণ বই মুখে করে বসে থাকা?’ গম্ভীর হয়ে ওঠে লাবণ্যর গলা।

সুরেলা শব্দ করে রাসেলের মুঠোফোনটা বেজে ওঠে। বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছে একজন। সে কল কেটে দেয়।  ফোনটা পাশে রাখে। বলে, ‘বৌদি, একটা কথা বিশেষভাবে জানার ছিল আমার...’

‘কত কথাই তো তুমি জানলে হে।’

‘কথা নয়, বরং একটা শব্দ নিয়ে জানার খুব কৌতূহল-’

‘বলে ফেলো।’

মাঠের ওপাশে মেয়েদের ভলিবল খেলার গ্যালারি। হঠাৎ সশব্দে দীর্ঘলয়ে ওয়াও আওয়াজ ভেসে আসে। প্রতিপক্ষকে হয়তো গোল দিয়েছে। একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় রাসেল। বলে, ‘জীবনানন্দ যে-রাতে মারা গেলেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত হসপিটালে, ভোরবেলায় লাশ এনে রাখা হলো ছোটভাই অশোকের ত্রিকোণ পার্কের ওপাশের বাসায়। কবিকে দেখার জন্য সকালবেলায় ফুল হাতে এলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব বসু, সজনীকান্ত, অচিন্ত্যসহ অজস্র নামি ও অনামি কবি-সাহিত্যিকরা। আপনি এলেন খানিকটা দেরিতে, বেলা বেড়ে যাওয়ার পর। শোনা যায়, আপনি আসতে চাননি। স্নান সেরে চুল ছেড়ে ঝকঝকে শরীরে এলেন বেলা সাড়ে নটায়। মৃত কবিকে দেখতে এত মানুষ যে আসতে পারে, আপনার ধারণাও ছিল না। আপনি বিস্মিত। সেই সময় হঠাৎই আপনি, তরুণ কবি-মেডিক্যাল ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহকে দোতলা সেই বাড়ির ঝুলবারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলেন। ভূমেনকে মনে আছে তো? পরে যিনি ভারতবর্ষের বড় ডাক্তার হয়েছিলেন; তরুণ বয়সে ‘ময়ূখ’ নামের ছোটকাগজ বের করতেন। সেই সুবাদে আপনাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন।’

লাবণ্য মাথা দোলান।

‘হুম। খুব মনে আছে। তোমার দাদার জন্য খুব খেটেছেন ছেলেটা।’

রাসেল বলল, ‘কিন্তু জানেন, এতকিছুর পরেও লোকে তাঁকে ‘ভূমিকা গুহ’ বলে ব্যঙ্গ করে?’

লাবণ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’

‘বাঙ্গালির যা স্বভাব আর কি! অথচ এই গুণী মানুষটি, জীবনানন্দকে নিয়ে অনেক গবেষক তো কাজ করেছেন; কিন্তু তিনি তো গবেষকের গবেষক। এবং জীবনানন্দ-বিষয়ে প্রধান পাণ্ডুলিপি ভাণ্ডারি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথকে মানুষ কতোভাবেই না অপমান ও অবমূল্যায়ন করেছে। যাহোক, কিন্তু অনেক মানুষের মাঝ থেকে বিশেষ একজনকে ডেকে নিলে কেউ দেখছে কিনা বা আড়ি পেতে শুনছে কিনা, এমন দ্বিধা হয়। আপনি সেসব ভ্রুক্ষেপই করলেন না। ভূমেনকে সরাসরি বললেন, অচিন্ত্যবাবু এসেছেন, বুদ্ধদেব এসেছেন, সজনীকান্ত এসেছেন, তাহলে তোমোদের দাদা নিশ্চয়ই বড়মাপের সাহিত্যিক ছিলেন; তাই না? বাংলা সাহিত্যের জন্য অনেককিছু রেখে গেলেন হয়তো। কিন্তু আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো!’

লাবণ্য কি রাগ করলেন? তাঁর সারামুখে বিষাদের আল্পনা ফুটে উঠলো। কিন্তু তবুও, এবার বেশ জোরেসোরেই তিনি মাথা দোলান। ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে।’

রাসেল বলল, ‘তখন, ভূমেন নিশ্চুপ; কথাহীন। আপনিও খানিক থামলেন। পরে, আপনি প্রায় মুখ ভেঙচে বললেন, ছাই রেখে গেলেন!’

লাবণ্য ভ্রু কুঁচকে একবার রাসেলকে দেখলেন। মৃদু হাসলেন। কোনো কথা বললেন না।

রাসেল উৎসুক হয়ে বলে, ‘আপনি ওই শব্দটি সত্যিই বলেছিলেন?’

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো কি লাবণ্যর বুক চিরে? বোঝা গেল না। মাঠ ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিনি বললেন, ‘মনে নেই রে।’

কথায় একটু স্পেস দিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘আর যে-সময়ের কথা তুমি বলছ, ভুল কিছু বলিনি। সংসারে মন নেই এমন একটা মানুষ, অভাবের সংসার, ঘরে সোমত্ত মেয়ে ও ছেলে, তার চাকরি আছে-নেই, লেখা লেখা করে প্রাণ দিচ্ছে। হঠাৎ ট্রামে চাপা পড়ে বিদেয় হলো। মাথার কি ঠিক থাকে বলো?’

গলাটা হয়তো আরো ধরে এলো লাবণ্যর। বললেন, ‘চলো, ওঠা যাক।’

লাবণ্য দাঁড়াতে গিয়ে একবার হেলে পড়লেন। রাসেল সাবধানে ধরে ফেললো- ‘আপনার কি শরীর খারাপ?’

লাবণ্য দুর্বল চোখে হাসলেন- ‘ও কিছু নয়। বয়েস হয়েছে তো।’

‘যদি কিছু মনে না-করেন, আপনাকে এগিয়ে দেই!’

‘যাবে আমার সঙ্গে?’

‘দিনকয়েক আগে ত্রিকোণ পার্কের ওই বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম।’

লাবণ্য বললেন, ‘গিয়েছিলে বুঝি?’

‘হ্যাঁ। অমিতানন্দর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হলো। ওঁর মেয়ে আমাদের ছবি তুলে দিয়েছে। একটাই মেয়ে বোধহয়, কলেজে পড়ছে। না?’

পথে যেতে যেতে আরও কথা হয় দুজনের।

রাসেল বলে, ‘জীবনানন্দ মরে গিয়ে ছাই রেখে যাননি, এতদিনে নিশ্চয়ই তা পরিষ্কার হয়ে গেছে সারা পৃথিবীর কাছে।’

লাবণ্য একবার পাশ ফিরে তাকালেন। কিন্তু মুখ খুললেন না।

রাসেল বলল, ‘পৃথিবীর কথা এই কারণে যে, রবীন্দ্রনাথের পর কেবল বাংলা ভাষায়ই নয়, পৃথিবীর নানা ভাষায় জীবনানন্দ আজও সজীব, মনোরম ও প্রাসঙ্গিক; কবিতাপ্রেমী মানুষ ও গবেষকের কাছে। অনুভূতির এমন এক স্তরে পৌঁছে তিনি কবিতা চর্চা করে গেছেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই আরশিনগর স্পর্শ করে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তিনি সারা পৃথিবীর বাঙালি-হৃদয় অধিকার করে আছেন। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের বিশিষ্ট কবি হিসেবেই চিহ্নিত ছিলেন এতকাল, কিন্তু সময়ের হাওয়ায় পাঠক-গবেষকের বিস্ময়-স্তম্ভিত চোখের সামনেই ক্রমশই ঘটেছে জীবনানন্দের প্রতিভার ভিন্নতর সৃজন-দিগন্তের বিস্তার; যেখানে তিনি গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবেও ছুঁয়ে আছেন দক্ষতার শিখর। মার্কিন মুলুকের এক ভদ্রলোক, কিল্টন বি সিলি একখানা বই লিখে উঠেছেন জীবনানন্দকে নিয়ে। খুব দরকারি বই। যত দিন যাচ্ছে, এমন বই আরো কত বেরুচ্ছে।’

রাস্তা পেরিয়ে ত্রিকোণ পার্কের প্রশস্ত সড়কে উঠে এলো ওরা।

লাবণ্য বললেন, ‘মারা যাওয়ার পরে, তোমাদের দাদা নতুন করে যেন জেগে উঠলেন- কী কবিতায় এবং গল্প-উপন্যাসে। অনেকের মতো আমিও সেসব দেখলুম। অথচ এত কাছে থেকেও এই ব্যাপারগুলো কখনো আঁচ করতে পারিনি জানো। এখন যে তাঁর খুব নাম হয়েছে, তাঁকে নিয়ে মানুষ গবষেণা ও পিএইচডি করে, সেমিনার করে; আমার কানে আসে। কিন্তু সেসব থেকে নিজেকে আড়ালে রাখি আমি। কী হবে বলো। সারাজীবন কী বেদনার জীবন তিনি কাটিয়ে গেলেন। বেঁচে থাকতে স্বীকৃতি ও ভালোবাসা কিংবা সুবিধে- কিছু পেলেন না। আর এখন, তিনি তো দেখতেও আসবেন না।’

একটু থেমে লাবণ্য বললেন, ‘জীবনে কিছু জিনিস এতো দেরিতে আসে যে, তখন আর ছোঁয়ার সাধ্য থাকে না।’

রাসেল বলল, ‘আপনাদের মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ, চঞ্চল ও অভিমানী মেয়েটা-’

মেয়ের কথা শুনে লাবণ্য দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।

‘আমি কিন্তু আপনার সেই ছাই প্রসঙ্গ থেকে সরছি না। আপনাদের মেয়ে মঞ্জু, তার বাবা বড় কবি ছিলেন, কেবল এই পরিচয়েই ভারত সরকারের তরফে ভালো চাকরি পেয়েছিল। যদিও সে চাকরিটা কন্টিনিউ করেনি।’

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হলো।

রাত বেড়ে চলে। ওরা নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে।

‘বউদি, আর একটা কথা খুব জানার ইচ্ছে ছিল...’

‘বলো।’

‘উৎপলার সঙ্গে আপনার কোনো সাদৃশ্য কি সত্যিই ছিল?’

লাবণ্য না-চেনার মতো মুখ করে বললেন, ‘কে উৎপলা?’

‘ওই যে, জীবনানন্দ দাশের ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে চিত্রিত নায়কের ভিলেনসম বউটা।’

অকারণেই লাবণ্য চোখ পিটপিট করলেন।

‘বৌদি, আপনি তো প্রথমে ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটি প্রকাশ করতে দেননি, তাই কথাটা মনে এলো।’

কোমরে হাত রেখে এবার লাবণ্য ঘুরে দাঁড়ালেন এবং এমন ভঙিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, রাসেল ভড়কে যায়।

লাবণ্য যে সুন্দরী ও মায়াবতী ছিলেন, শুনেছে রাসেল; আর এখন তো চোখের সমুখে সে দেখেই উঠলো। কিন্তু এই শেষ প্রশ্নটি শুনে লাবণ্য যেভাবে আগুনচোখে তাকালেন, বাঘিণী ছাড়া আর কিছু কি মনে করা যায়? ভাবে রাসেল। ভেবে কিছুই পায় না। কিন্ত খানিক ভয় সে ঠিকই পেয়ে ওঠে।

কিছুক্ষণ বাদেই লাবণ্য কিশোরী মেয়ের মতো হেসে উঠলেন, মিষ্টি করে। রাসেলের মাথায় হাত রাখলেন আশ্বস্ত করার কৌশলে। এতে সহজ হয়ে রাসেলও হেসে ফেললো।

ট্রেন এসে যাচ্ছে, ছেড়েও দেবে, এমন একটা ভাব করে রাসেল বলল, বৌদি, বলছি যে, ব্যক্তির মুখ বা কলম থেকে একটা কথা যখন প্রকাশ পায়, সেই কথার কিন্তু হাত-পা গজায়। ফলে জীবনানন্দকে নিয়ে সমাজে বিচিত্র কথা ও কথার লেজের গল্প প্রচলিত আছে। তাঁর সাহিত্যকীর্তি দূরে সরিয়ে রেখে একজন স্বামী ও সংসারী মানুষ হিসেবে তিনি আসলে কেমন ছিলেন? একটু বলুন না, প্লিজ!’

হেসে উঠলেন লাবণ্য-‘তুমি কি আমাকে আরও একবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, বলো তো? শোনো, শুধু বলি, ব্যক্তি-মানুষকে কম জানাই ভালো। নিরাপদ। তাঁর কবিতা পড়ে মানুষ মুগ্ধ হয়। আনন্দ পায়। কখনো কবিতা বোঝে মানুষ, হয়তো বোঝে না। তাঁর কবিতায় কিছু ভাবনা ও কথার আড়াল থাকে।’

কথায় একটু বিরতি দিয়ে তিনি কী যেন দেখেন। পরিচিত কোনো মুখ হয়ত দেখে থাকবেন তিনি।

আবার তিনি কথা বলে ওঠেন- ‘আর মানুষ হিসেবে মিলুও আড়ালময় এক চরিত্র। খানিক রহস্যময়। লাজুক। কখনো বেশ গম্ভীর এবং অচেনা। তাকে সবটুকু জানা সম্ভব নয়। এটা তিনি শিল্পী বলেই হয়ত। আর এতসব না-জানাই বরং ভালো। জানো, তিনি আজও তাঁর কবিতার মতো রহস্যময় আমার কাছে। আজ মনে হয়, থাকুক না কিছু আড়ালের গল্প। তিনি তোমাদের অনেকের প্রিয় কবি। প্রিয় মানুষের সব গোপনীয়তা জেনে ফেলার মতো হাতাশা আর কিছুই হতে পারে না। বুঝলে তো?’

রাসেল মুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনে যায়।

তিনি বলেন, ‘আড়াল ও রহস্যময়তাই প্রিয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ভালোলাগাটুকু বাঁচিয়ে রাখে। ছেড়ে দাও। জীবনানন্দ বেঁচে থাকুক এসব আড়াল ও রহস্য নিয়েই...’

কথা শেষ করে তিনি থামেন। জোরে জোরে শ্বাস নেন।

ত্রিকোণ পার্কঘেঁষা এই পথটা বেশ নিরিবিলি।

ওরা নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে পাশাপাশি। সন্ধ্যার আলো-অন্ধকার মেখে হিমেল হাওয়া এসে গায়ে লাগে। শরীল কেমন শিউরে ওঠে। আর তখনই মেয়েটিকে দেখে রাসেল। দেখেই মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে।

ব্যাপারটা খেয়াল করে লাবণ্য বলেন, ‘এই ছেলে, এই। আহ, সুন্দর মেয়ে দেখলে তোমরা গলে যাও বাপু।’

সংবিত ফিরে পায় রাসেল। সে লজ্জিতভাবে বলে, ‘বৌদি, মেয়েটিকে একবার ভালো করে দেখুন। আপনার তরুণ বয়সের ছবির সঙ্গে খুব মিল আছে। মেয়েটিকে দেখে, আপনার পাশেই আছি, তবুও মনটা যেন সঙ্গে ছিল না আমার।’

‘কেমন?’ লাবণ্য সোজা চোখে তাকালেন এবার।

‘আমাদের ঢাকা শহরে, বিশেষ করে নীলক্ষেত বা নিউমার্কেটে কোনো কাজে গেলে কিংবা ইডেন কলেজের দেয়ালঘেঁষে আজিমপুর যেতে যেতে মনে হয়, যখন ইডেন কলেজে পড়তেন আপনি, একদিন ওই পথে হেঁটে যেতেন বন্ধুর সঙ্গে, কিংবা একা। এই মেয়েটিকে দেখে আপনার সেই ছবিটি ভেবে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম।’

রাসেলের কথা শুনে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ওঠেন লাবণ্য দাশ।

‘আচ্ছা। বেশ তো।’ বলেই তিনি মেয়েটিকে দেখেন। একটু পর দেখা গেল, তিনি মৃদুভাবে মাথা দোলাচ্ছেন।

পায়ে পায়ে হেঁটে যখন অমিতানন্দর বাসার সামনে এলো ওরা, রাসেল দেখলো, অদূরে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলছে অরুণাভ। অরুণাভ ঢাকায় থাকে। এখানে এলো কী করে? সে বলল, ‘বৌদি, আপনি বাসায় যান। আমি খানিক পরেই আসছি।’

লাবণ্য বাসার লিফটের দিকে হাঁটতে লাগলেন।

রাসেল একবার তাকায় পাশফিরে।

অমিতানন্দর বাবার পুরনো সেই তিনতলা বাড়িটি এখন নেই। নেই ঝুলবারান্দাও। ছয়তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায় থাকেন অমিতানন্দ। নিচে আরও একটি ফ্ল্যাট আছে তার। তখন, হঠাৎই জীবনানন্দের বিষণ্ন মুখটি কেন যে মনে আসে রাসেলের। কলকাতা শহরে অল্প টাকায় দুটো ঘর-ভাড়া পেতে কী কষ্টটাই না করেছেন তিনি। পাননি। এখন তার ভাইপো নিজের ফ্ল্যাটে থাকে। মানুষ মাত্র তিনজন। ঘর পাঁচখানা। নিচের ফ্ল্যাট খালিই পড়ে থাকে হয়ত।

কথা শেষে অরুণাভ চলে যায়।

লিফটে চেপে রাসেল পাঁচতলায় উঠে এসে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়। সামনে সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন অমিতানন্দ। অশোকানন্দ দাশের একমাত্র সন্তান।

অমিত বললেন, ‘আসুন!’

ঘরে ঢুকে রাসেল এদিক ওদিক আতিপাতি তাকায়। কিছু একটা খোঁজে।

অমিতানন্দ ব্যাপারটা খেয়াল করেন-‘আপনি কিছু খুঁজছেন?’

‘তিনি কোথায়?’

অমিতের কপাল কুঞ্চিত হয়। চোখ ছোট হয়ে আসে। তোতলা স্বরে তিনি বলেন, ‘কার কথা বলছেন?’

‘লাবণ্য দাশ। আপনার জেঠিমা। এই তো আমি ঢোকার মিনিট কয়েক আগেই এলেন।’

ঠা ঠা হাসিতে ফেটে পড়লেন অমিতানন্দ।

রাসেল বিব্রত মুখে তাকায়।

হাসি থামিয়ে অমিত বলেন, ‘আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। জেঠিমা কোথা থেকে আসবেন? তিনি তো নেই।’

‘নেই? ওহ। একটু জল দেবেন, প্লিজ!’ রাসেল বলে।

অমিতানন্দ নিজেই জল আনতে উঠে যান।

রাসেল সোফায় বসে দ্বিধা ও সন্দেহের চোখে তাকায় চারপাশে। বসার ঘরটি ফুটবল মাঠের মতো বিস্তৃত। লাবণ্য দাশ তো দূরের কথা, কোনো মানুষেরই গন্ধ নেই। বাড়িটি কেমন সুনসান ও নৈঃশব্দে ভরে আছে।

বিস্কিট ও জল নিয়ে অমিত ফিরে আসেন। বলেন, ‘এখন বাসায় কেউ নেই। আমার স্ত্রী ও মেয়ে বেড়াতে গেছে।’

জলের গ্লাসটা হাতে নিতেই কেমন চলকে চায়। মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে আসে রাসেলের। একধরনের ভোঁতা অনুভূতি হয়।

আরও কিছুসময় কথা বলে রাসেল নিচে নেমে আসে। ত্রিকোণ পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে রাসবিহারী এভিনিউয়ের দিকে পা বাড়ায়। একটা কথাই কেবল তার মাথায় ঘুরতে থাকে-কোথাও কি ভুল ছিল?

আকাশের সিঁড়ি বেয়ে গাঢ় ভঙিতে রাত নামতে থাকে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়