ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাসসুন্দরী: বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীকার

ড. মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৭, ৬ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাসসুন্দরী: বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীকার

ড. মাহফুজা হিলালী : আনন্দ দেয়া বা পাওয়া বা কোনো কিছু প্রচার করা- এই মানসিকতা থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিল সাহিত্য রচনা। প্রথমে মুখে মুখে চলতো। মুখে মুখেই মানুষ কবিতা বা গান আকারে সাহিত্য বাঁচিয়ে রেখেছিল। তারপর লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। আমরা পেলাম ‘চর্যাপদ’। এভাবেই আমরা লিখিত সাহিত্য পাই। এবং সাহিত্যের এক ধরনের রূপ আমাদের চোখে ধরা পড়ে। একেক আঙ্গিকে তারা নিজেদের নাম ধারণ করে- কোনোটি কবিতা, কোনোটি গল্প, কোনোটি উপন্যাস। এমনি করে জীবনী সাহিত্যও আসে।

শ্রীচৈতন্যের জীবনী নিয়ে মধ্যযুগেই কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। তবে বাংলা সাহিত্য-আসরে আত্মজীবনী সাহিত্য এসেছিল বেশ চমক দিয়ে। চমক এ জন্য যে, আধুনিক যুগ ইংরেজ এবং ইংরেজি সাহিত্যনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতিতে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু বাংলায় ‘আত্মজীবনী’ লেখার ইতিহাস একেবারেই ভিন্নভাবে এসেছে। কোনো ইংরেজ প্রভাবিত বা কোনো শিক্ষিত লোক আত্মজীবনী লেখেননি। লিখেছেন অজপাড়াগাঁয়ের প্রায় অশিক্ষিত এক মেয়ে। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কেউ তাঁকে পড়তে বা লিখতে শেখাননি। লেখাপড়া অর্জন করেছিলেন তিনি নিজে, সম্পূর্ণ একাকী। তাই সাহিত্যের আঙ্গিনায় তিনি একটি বিস্ময়। তাঁর নাম রাসসুন্দরী। তাঁর বইয়ের নাম ‘আমার জীবন’।

রাসসুন্দরীর জন্ম হয়েছিল সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোঁতাজিয়া গ্রামে। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যান তিন দিনের পথ রামদিয়া শ্বশুরালয়ে। ঊনষাট বছর বয়সে লেখেন আত্মজীবনী। ততদিনে রাষ্ট্রে-সমাজে সর্বোপরি তাঁর জীবনে কত ঘটনা ঘটে গেছে। তাঁর লেখার প্রথম দিকে তিনি লিখেছিলে, ‘আমার এই শরীর, এই মন, এই জীবনই কয়েক প্রকার হইল। আমার শরীরের অবস্থা, মনের ভাব, কোন্ সময়ে কি প্রকার ছিল, এবং কোন্ অবস্থায় কত দিবস গত হইয়াছে, সে সমুদয় আমার স্মরণ নাই। যৎকিঞ্চিৎ যাহা আমার মনে আছে, তাহাই লিখিতেছি।’ (আ.জী.-পৃ. ৫)

এই লেখাটুকু প্রমাণ করে তিনি চিন্তায় ছিলেন অসাধারণ। সাধারণের মতো সাধারণ চিন্তা তিনি করতেন না। যদিও তিনি কয়েকটি ধর্মগ্রন্থ ছাড়া আর কোনো বই পড়েননি। কিন্তু তাঁর বইয়ের লাইনে লাইনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা পড়ে অবাক হতে হয়। যারা সাধারণ ঘরকন্না করে জীবন অতিক্রম করেন, তারা বয়সের সাথে মনের যে গতি তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ পান না। কেবলই খেয়েপরে সময় অতিবাহিত করেন। কিন্তু রাসসুন্দরী দেবী কাজের ফাঁকে ফাঁকে চিন্তা করেছেন নিজের মতো করে।

‘আমার জীবন’-এর একটি সূচিপত্র রয়েছে। সেখানে প্রথম এবং দ্বিতীয় দুইভাগ। প্রথম ভাগে ষোলোটি রচনা এবং দ্বিতীয় ভাগে ষোলোটি রচনা রয়েছে। প্রথম ভাগে আমরা পাই মঙ্গলাচরণ, কবিতা স্তব, বালিকা কাল, ছেলেধরার ভয়, গঙ্গাস্নানে গমন, স্কুলের কথা, আমার ভয় ও দয়ামাধব ঠাকুর, আমি মায়ের মেয়ে, বাড়িতে আগুন ধরা, আমরা তিন ভাই বোন নিরাশ্রয়, দয়ামাধবকে ডাক, পোড়া ভিটায় পরমান্ন, মানুষ না ঠাকুর?, ঠাকুর কে?, মহামন্ত্র পরমেশ্বরের নাম, আমার ছেলে, খুড়ী মার কথা, আমার প্রথম শোক, বিবাহের কথা, মা তুমি কি আমায় পর করে দিবে?, বিবাহের আয়োজন, আমি মায়ের কোলছাড়া হইলাম আজ, নৌকার মধ্যে, আমার ক্রন্দন ও লোকের সান্ত্বনা, আমার আর এক মা, নূতন বধূ, শ্বশুর বাটী, মাটীর সাপের গল্প, আমার সংসারের কাজ, সেকালের বৌদের নিয়ম, আমার লেখাপড়া শিখিবার সাধ, সেকালের লোকের আলোচনা, পরমেশ্বর তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখাও, রামদিয়া গ্রামের কথা, আমার পুত্র ও কন্যা, সংসারের বিবরণ, আমার লেখাপড়া শিখিবার প্রবল বাসনা, স্বপ্নে চৈতন্য ভাগবত, চৈতন্য ভাগবতের একখানি পাতা, লেখাপড়ায় লোক নিন্দার ভয়, সেকালের লোকাচার, গৃহিণী কর্ম্মের ভার, আমার তিনটি ননদ, জয়হরি ঘোড়ার কথা, আমার সন্তান ও সংসারের সুখ, সংসার লহরী, আমার পুত্রবধূ, পুরাণ শুনিবার সাধ, চৈতন্য ভাগবত, পুস্তক পড়িবার কথা, পুত্রশোকের যন্ত্রণা, সপ্তকা- রামায়ণ, ছাপার লেখা ও আমার ক্রন্দন, লিখিতে শিখিলাম, শরীর তরণী, ২৯ শে মাঘ শিব চতুর্দশী, স্বপ্নবিবরণ, মনের অলৌকিকতা, অন্তরে স্পষ্টদর্শন, মৃত্যু কল্পনা, প্রকাশ্যে ভূতদৃষ্টি, কর্ত্তার কথা, রামদিয়ার সন ১২৮০ সালের জ্বর বর্ণন। এছাড়া প্রতিটি রচনা কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগ লেখা হয়েছে তাঁর অষ্টআশি বছর বয়সের সময় যখন এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ মুদ্রিত হয়। এখানেও প্রতিটি রচনা শুরু হয়েছে কবিতা দিয়ে। আর গদ্যে লেখা রয়েছে তাঁর জীবনের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি। তাঁর এই বিষয় বিভাগ খুব সুন্দর এবং পাঠকের পড়ার অনুকূল। রাসসুন্দরীর কবিতা এবং গদ্য দুইই পরিচ্ছন্ন এবং শিল্পগুণ সমৃদ্ধ। কোথাও কোনো অসঙ্গতি নেই, নেই কোনো অতিরঞ্জন। পুরো গ্রন্থটি সহজ-সরল ভাষায় লিখিত হয়েছে। কোনো পাণ্ডিত্য বা কোনো কৃত্রিমতা এখানে স্থান পায়নি। এ একেবারে গ্রামের একজন সরল মেয়ের আত্মকথন।

সে সময় গ্রামে মেয়েদের লেখাপড়ার কথা কেউ কল্পনাও করতেন না। কয়েক গ্রামের বালকেরা কোনো একটি নির্দিষ্ট বাড়ির কাছাড়ি ঘরে মিলিত হতো, সেখানে একজন মেম তাদের পড়াতেন। বালকদের এ রকম একটি পড়ার স্কুল ছিল রাসসুন্দরী দেবীর বাড়িতে। সেই যুগে রাসসুন্দরীর পড়া শেখা বিস্ময়কর ঘটনা। এবং তাঁর পড়া শেখবার ঘটনাও কম বিস্ময়কর নয়। বলা যায় যতটা বিস্ময়কর তাঁর আত্মজীবনী লেখবার বিষয়, ততটাই বিস্মকর তাঁর পড়তে এবং লিখতে শেখা। এখানে বলে রাখি, তিনি সারাজীবন খুব ভীতু স্বভাবের ছিলেন। এই ভীতু মেয়েটি হয়েছেন ইতিহাস। ছোটবেলা তাঁকে খেলার সাথিরা মারতো, তাঁকে কাঁদাতো। এ কথা জানার পর তাঁর অভিভাবকরা তাঁকে বালিকাদের সাথে খেলতে যেতে দিতেন না। তখন তাকে বাড়ির স্কুলে মেম-এর কাছে বসিয়ে রাখা হতো। পড়ার কথা চিন্তা করে তাঁকে সেখানে রাখা হয়নি। দুষ্ট বালিকাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রাখা হয়েছিল। মেমও তাঁকে পড়া শেখানোর কথা চিন্তা করেননি। রাসসুন্দরী কেবল চুপচাপ বসে থাকতেন। কারো সাথে কথা বলতেন না, আবার কেউ তাঁর সাথে কথা বলতো না। কিন্তু নীরবে অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো যে ঘটনা ঘটে গেলো তা হলো, তিনি পড়তে শিখে গেলেন। আবার তিনি যে পড়তে শিখলেন সে খবরও কেউ জানেনি, রাখেনি। তাঁর দশ বছরের সময় বাড়িতে আগুন লেগে স্কুলটি পুড়ে যায়। তাই আর স্কুলে বসা হয় না তাঁর। এরপর বিয়ের পর চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর মনে আবার উঁকি দেয় পড়ার কথা। তিনি লিখেছেন: ‘তখন আমার মনে নিতান্ত চেষ্টা হইল যে, আমি লেখাপড়া শিখিয়া পুঁথি পড়িব।’ (পৃষ্ঠা-২৮)

হ্যাঁ, এবারে সত্যি সত্যি পড়ার জন্য তাঁর মনের মধ্যে আকুতি জন্মে। তিনি পুঁথি পড়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠেন। তাঁর আশ্রয়স্থল ছিল দয়ামাধব ঠাকুর। তিনি সারাক্ষণ দয়ামাধবকে ডাকতে থাকেন। সে-সময় লোকে মনে করতো, মেয়েরা লেখাপড়া করলে ভদ্রলোকের জাত যায়। তাই ভয়ে রাসসুন্দরী পড়ার কথা মন থেকে মুখে আনতেন না। একটি কাগজ দেখলে লোকের সামনে সেটা তাকিয়ে দেখতেন না, কিন্তু আড়ালে সেটি পড়ার চেষ্টা করতেন। ছোটবেলায় দেখা অক্ষরের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন। বিশ বছর পরে তাঁর জীবনে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন তিনি চৈতন্যভাগবত পড়ছেন এবং সেদিন দিনের বেলা তার স্বামী বাড়ির ভেতরে চৈতন্যভাগবত নিয়ে আসেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে তাঁর বড় ছেলেকে বইটি তুলে রাখতে বলেন, যেন প্রয়োজনের সময় পাওয়া যায়। রাসসুন্দরী সেই বইয়ের একটি পাতা নিজের জন্য লুকিয়ে রাখেন এবং পড়ে ছেলের লেখার তালপাতার সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে সেই পাতা পড়েন। এ পাতা পড়তে তাঁর খুব বেগ পেতে হয়েছিল; একে তো ঠিকভাবে পড়তে জানেন না, শিখে শিখে পড়তে হয়েছিল, অন্যদিকে কারো সামনে পড়া যেতো না। ফলে লুকিয়ে পড়তে হতো। সে পাতাটাও লুকিয়ে রেখেছিলেন রান্নাঘরের ‘হেঁসেলের মধ্যে খোড়ীর নীচে’। এভাবে তিনি দ্বিতীয় বার পড়া শিখেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। এমন পড়া শেখা বিশ্বে আর কেউ শিখেছিলেন কিনা জানি না, তবে রাসসুন্দরীর এই ইচ্ছা, ধৈর্য, প্রতিভা এবং অর্জন আমার কাছে বিস্ময়। তাঁর পড়ার প্রতি এতো আগ্রহ ছিল যে, ছাপার অক্ষরের সপ্তকাণ্ড রামায়ণ পেয়ে তিনি মহা খুশি হয়েছিলেন, আবার অক্ষর ছোট হওয়ার কারণে তিনি পড়তে না পাড়ায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন।

এরপর তাঁর লেখা শেখার বিষয় আলোচনা জরুরি। কারণ লেখা না শিখলে তো আত্মজীবনী লেখা সম্ভব হয়নি। তাঁর লিখতে শেখারও ঘটনা আছে। তাঁর সপ্তম পুত্র কিশোরীলাল কলকাতা থাকতো। সে মায়ের কাছে আবদার করে তার চিঠির উত্তর দিতেই হবে। এবং মাথার দিব্যি দিয়ে সে কাগজ, কলম, দোয়াত, কালি কিনে দিয়ে কলকাতা চলে যায়। কিন্তু তিনি তো লিখতে পারেন না। আবার ছেলের দিব্যিও ঠেলতে পারেন না। অবশেষে নিজে নিজে বর্ণ দেখে দেখে লেখা শিখে পুত্রকে চিঠির উত্তর লিখতে শুরু করেন। এই হলো তাঁর লিখতে শেখার ইতিহাস।

আমার জীবন আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। রাসসুন্দরী নিজের সমস্ত ভার দয়ামাধবের ওপর অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এই সমর্পণ তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ কথাটি তাঁর জীবনের সাথে মিলে গেছে। তিনি একটি আশ্রয় কল্পনা করে সংসার ধর্ম করেছেন, সন্তানদের সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলেছেন, আবার নীরব সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেছেন। এবং বাংলা আত্মজীবনী সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের নাম প্রথমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশের এই সংগ্রামী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়