ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিত্রভূমির অন্ত-ধ্বনিতে জেলেজীবন

কামালুদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২২ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিত্রভূমির অন্ত-ধ্বনিতে জেলেজীবন

ফিশার বোটস অ্যান্ড লাইফ

|| কামালুদ্দিন || 

আমাদের খেলার মাঠের শেষ হুইসেল কে দেয় জানিস? খোদ কাণ্ডজ্ঞানহীন জলওয়ালা জোয়ার। আচমকা কোত্থেকে সময়মতো চলে আসে আর ফিরতি পথে মাঠ কাদা করে দিব্যি সরে যায়। যখন ভাটার সময় আমরা খেলি, তখন একটু ঝামেলা পোহাতে হয়; আমাদের প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে নিজেদের মনে করে বল পাস দিয়ে পেটপুরে গোল খেয়ে নিতাম। কারণ হচ্ছে, গায়ে কাদা মেখে গেলে সবাইকে দেখতে একই রকম লাগে! সবই কাদাজলের কারসাজি। শিল্পী মং মং সো নতুন বন্ধুর সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন।

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের আড়ৎ বললে অত্যুক্তি হবে না। এই দ্বীপকে ঘিরে রেখেছে জল। বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রাজ্য বাঁচানোর জন্য কোনো সম্রাট পরিখা সৃষ্টি করেছেন এমন নয়। সবই প্রকৃতিদেবীর মর্জি। ভূখণ্ড থেকে একটুকরো মাটি আলাদা করে দিয়ে বলে উঠলেন এটি এখন থেকে দ্বীপ। পরে অবশ্যই গায়ের উপর কিছু মাটির ঢেলা বসিয়ে দিয়ে বললো- এটি পাহাড়। তখন থেকে বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। পাহাড়টির নাম আদিনাথ পাহাড়, কারণ এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সুবিখ্যাত আদিনাথ মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরের নামানুসারে পাহাড়টির নাম। এখানে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের অনেক তীর্থযাত্রী পূণ্যলাভের আশায় ছুটে আসেন। এ উপলক্ষ্যে মেলা বসে। সেই তীর্থস্থান থেকে কয়েকগজ দূরে শিল্পী মং-এর জেলেপাড়া, যে পাড়ায় বেড়ে উঠেছেন শিল্পী মং। যেখানে আছে ছোট-বড় নানা জাতের মাছ ধরার নৌকা, রয়েছে কালো অতিকায় দানবাকৃতির কার্গো। একদিকে কিছু নৌকা সাগর থেকে ঢেউয়ের নখাঘাতে পরিশ্রান্ত হয়ে এসে আলকাতরা মাখা কালো শরীরটাকে আরাম দিচ্ছে। আবার কিছু নৌকা যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো চিকিৎসা নিচ্ছে, মিস্ত্রীরা কষে যাওয়া বা বিদীর্ণ হওয়া তক্তায় জোড়া তালি লাগাচ্ছেন। অন্যদিকে নতুন নৌকা নির্মাণের জন্য হাতুড়ি-বাটালের দাঙ্গা বা রাগ ঢাকে পুরো জেলেপল্লীর লোকেদের কর্ণপাত বন্ধ হওয়ার উপক্রম।  
এদিকে নৌকার বহদ্দাররা (মহাজন) মহেশখালীর মিষ্টি পান খেয়ে গালটাকে রক্তলাল করে বিপ্লবের সুরে গালাগাল দিচ্ছে অসহায় জেলেদের। পাশেই মাছ ধরার জালের ক্ষত সারিয়ে তোলায় ব্যস্ত অন্য জেলেরা। যেসব নৌকা ভেসে থাকে সেখান থেকে এক্রোবেটের ভঙ্গিতে লাফ ঝাপ এবং নোঙরের রশি ধরে এমনভাবে জলে নেমে আসে, যেনো বনের রাজা টারজান। এসব শিল্পী মং-এর শৈশবের নিত্যকর্ম ছিল। 
সেই জেলেপাড়ার যাপিত জীবন জলের উপর ভেসে থাকা পদ্মফুলের মতো। পদ্মফুল যেমন জলের নিচে নোঙর দিয়ে ভেসে থাকে তেমনি তারাও ভেসে থাকে ঐ পাড়ায়। তাদের সাতারু জলময় জীবনে জলই তাদের প্রতিবেশী, সে হিসেবে জলের সঙ্গে সদ্ভাব থাকাটা স্বাভাবিক। চিত্রকলার মাধ্যম হিসেবে তাই জলকে পেয়েই নিখাঁদ জলরঙের শিল্পী হয়েছেন মং।

সংস অফ ফিশারম্যান

চিত্রের বিষয় হিসেবেও জেলে পাড়াকে বিধৃত করেছে যা ইতিহাসের পাতায় ভাগ বসাবে অদূর ভবিষ্যতে। মং-এর মহেশখালী সিরিজের ছবি গবেষণাধর্মী। তাঁর প্রতিটি ছবিতে কর্ষণ আছে, বপন আছে সেইসঙ্গে ফলনও আছে। মং অদ্বৈত মল্লবর্মণ, হরিশংকর জলদাসের কেউ নন। তাদের বেড়ে ওঠা জেলে পাড়ায়, তাইতো তারা জেলে পাড়া নিয়ে যুগপৎ সাহিত্য রচনা করেছেন। লিও টলস্টয় যেমন দাস প্রথা নিয়ে লিখতে গিয়ে দাসদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন এবং দাসদের জুতা পরে অনেকদিন হাঁটেন, তারপর লেখার তাগিদ অনুভব করেন। সঙ্গীতশিল্পী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো বুড়ো বয়সে রোমান্টিক গান গাওয়ার জন্য মাথাজোড়া টাকমাথায় পরচুলা পরা শুরু করেন। এসব হচ্ছে বিষয়কে ছুঁয়ে থাকা, বিষয়ের ভিতর নিজেকে ডুবিয়ে নেয়া। যেমন করেছেন শিল্পী মং মং শো নিজেও।

তাঁর শৈশব কেটেছে আঁকিবুকি করে, কাদা দিয়ে নৌকা বানিয়ে। পরে সেই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পাঠগ্রহণ এবং পরবর্তী সময়ে চীন গমন। শিল্পী মং মং সো গত সাত বছর ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটিতে চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে চারুকলার ছাত্র হিসেবে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ করেন কৃতিত্বের সঙ্গে। বর্তমানে শিল্পী হিসেবে তিনি চীনেই অবস্থান করছেন। ছবিওয়ালা শিল্পী মং বিদেশে ছবিপাড়ায় থাকলেও তাঁর ছবি আঁকার বিষয় বিন্যাসে মহেশখালীর ব্রাত্যজনের জেলে পাড়া বা তাঁর ফেলে আসা আঁকাবাঁকা শিকড়।

উপরন্তু তাঁর একক "The songs of fishermen " শিরোনামের প্রদর্শনীটি সম্প্রতি চীনের কুনমিংয়ের ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। যেখানে জেলে পাড়ার অনুক্ত সুর স্বচ্ছন্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁর ছবিতে দেশমাতৃকা আছে, কাদাজল আছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রক্ষেপণ আছে, সুদখোরদের টাকা লগ্নি আছে, দুঃখগাথা জেলেজীবন আছে।
যারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জীবন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জাল নিয়ে মাছ ধরে আনেন, তাদেরই জং ধরা গল্পগুলোর ছবি লিখছেন রং দিয়ে। মাথায় টুকে নেয়া স্মৃতির রোমান্থন করছেন তিনি বাস্তবানুগ ধারার ছবি এঁকে। এই ধারার চিত্রে তিনি পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন অসাধারণভাবে। চিত্রের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে প্রতিটি জিনিসের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। 
তাঁর নির্মিত প্রতিটি নৌকার জেলেরা বঙ্গোপসাগর থেকে ভয়ানক ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে আনেন। এমনকি সেসব জেলেরা আদমশুমারিতে নাম লিখিয়েছেন কিনা তাও সন্দেহ। আদমশুমারির নাম গণনা করতে এলে বলে ‘আমরা আজ আছি কাল নেই’। অথচ আমরা যারা ডাঙ্গায় বসে সুস্বাদু মাছের কাটা বাছতে গিয়ে বলি- কী কাটা! আসলে আমরা জানতে চাই না। সত্যিকারের সে মাছগুলো কোত্থেকে আসে।

ইন্সটলেশন

মং-এর প্রদর্শনীর ছবিগুলো দৃশ্যতঃ বর্ষাকালের। চিত্রে দেখা যাচ্ছে, গোমরামুখো আকাশ, ঘন মেঘ নেমে আসছে, কোথাও আকাশ ছোঁয়া লম্বা লাঠি নিয়ে মেঘ তাড়িয়ে দিয়েছে মনে হয়। আবার সব আকাশ একই নয়, কতিপয় আকাশ বুড়িয়ে গিয়ে সন্ধ্যার সোনালী রং বিবর্ণ করে দিয়েছে। ছবিজুড়ে শ্যাওলা জমানো স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। নৌকাগুলো দেখলে মনে হয় সত্যিকারের কর্দমাক্ত নোনা জল আলতো করে ঢেলে দিয়েছে তাঁর চিত্রপরিসরে। 
আর একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তাঁর ছবিতে রয়েছে আলকাতরার গন্ধ, এটাই শিল্পীর সার্থক গন্তব্য। এমনকি নৌকাগুলো গাদাগাদি করে যেখানে সারবাঁধা আছে কাদাজলে, সেখানে হাঁটু জলে ডিজেল, আলকাতরা পরে এক ধরনের চকচকে ভাব। যেনো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে জলের উপর। সেটিকেও শিল্পী ছাড় দেয়নি। এটি শিল্পীর চিরুনি অভিযান- তাঁর তুলিতে সবই ধরা পড়ছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি উপাদানের আলাদা আলাদা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বিধৃত করেছেন। যেমন: কাঠ, নানারকম ধাতু, প্লাস্টিক, শোলা, ফোম কাপড় ইত্যাদি। সাধারণত রক্ষণশীল জলরঙ চিত্রে আমরা যেটি দেখি প্রতিটি উপাদান ওয়াশ টেকনিকে আঁকেন শিল্পীরা। গরমকাল আঁকতে গেলেও শীতকালের কুয়াশার একটি ওয়াশ দিয়ে দেন। প্লাস্টিকের পাত্র, টিনের পাত্র, মাটির পাত্র সব একই ওয়াশ। সেক্ষেতে শিল্পী মং কোনো বস্তুকে চরিত্রহীন করেন নি। জলরঙের পুরোধা শিল্পী এন্ড্রু উইত ও উপাদানের প্রভূত চরিত্র নির্ণয়ে স্বচেষ্ট থাকতেন। 
উপরন্তু ‘Songs of Fisherman 28’ এই চিত্রে একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন- কিছু কাপড় শুকাতে দিয়েছেন শিল্পী মং। লক্ষ্য করলে উপলব্ধি করতে পারবেন- কোন কাপড় কতটুকু শুকিয়েছে, কোন কাপড়টি এখনো ভেজা, কোন কাপড়ের কতটুকু পুরুত্ব? এসবই শিল্পীর সার্থক প্রয়োগ।
অন্যদিকে সব ছবিতে একটু শীতলভাব লক্ষণীয়, উষ্ণ রং নিভিয়ে দিয়েছে শীতল নানা ধরনের নীল রঙের ব্যবহার করে। কারণ আমরা যারা উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়ে উঠেছি এসব প্রত্যক্ষভাবে আমাদের চেনা জগত। বৃষ্টির আগে-পরে বা বৈরি আবহাওয়া থাকলে রংগুলো কেমন হয়ে যায় তা আমরা জানি। এখানে শিল্পী মংও প্রজ্ঞার আলো বসিয়ে দিয়েছেন।
উল্লেখ্য তাঁর এই প্রদর্শনীর আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে- দ্বিমাত্রিক চিত্রতলের পাশাপাশি ত্রিমাত্রিক মডেলের সরব উপস্থিতি বা বিভিন্নবস্তুর সমন্বিত শিল্পরূপ; যেটাকে আমরা বলতে পারি ইনস্টলেশন আর্ট। ইনস্টলেশন আর্ট সত্তরের দশকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও এর যাত্রা শুরু হয় বিশের দশকে মার্শাল দুশাম্পের ‘রেডিমেট শিল্পকর্মের প্রদর্শনী এবং কুর্ট সোয়াইটারস্ মার্জ-এর শিল্পকর্ম দিয়ে। এখানে তাঁর এই ইন্সটলেশন আর্টে মৎস্যজীবী জেলে সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় রূপ নির্মাণে শিল্পীর অনুবৃত্তি অসামান্য। তার এই শিল্পকর্মগুলি মিশ্র মাধ্যমের আত্মীয়করণ। এখানে আছে মাছ ধরার নৌকা, জাল, জল, জীবন্ত সমুদ্রের মাছ, রশি, সুতা, বড়শি, মাটি, নোঙর, বালি এবং বাংলাদেশ-চীনের ফোক মোটিফ ইত্যাদি।

ইন্সটলেশন আর্ট উইথ আর্টিস্ট মং মং


উপরন্তু শৈশবে চিত্রাভাস পাওয়া এই প্রতিভাবান শিল্পীর ছবিতে কঠোর পরিশ্রম আছে, প্রার্থনা আছে, অনুধ্যান আছে, সাধনা আছে। সত্যিকার্থে এই সাধক শিল্পীর সন্ন্যাস জীবনে রঙের তৈরী একটা নৌকা আঁকতে যে সময় নিয়েছে, তাতে কাঁঠের তৈরী একটি আদ্যন্ত নৌকা বানানো সম্ভব।
মং চীন গিয়ে অধ্যাপক চ্যান লিও ইউনানের মতো বিদগ্ধ শিল্পগুরু পেয়ে তাঁর চিত্রশৈলী নতুন রাস্তার পথিক হয়ে যান। পক্ষান্তরে তাঁর চিত্রের গায়ে এই শিল্পগুরুর লঘু ছায়া পড়ে আছে, যে ছায়ায় গুরুর আশীর্বাদ লুকিয়ে আছে। তবু আমি বলবো- কোনো ছায়ার স্থায়িত্ব নেই, নতুন আলো এসে পূর্বের ছায়া মুছে দেয়। পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী সেজান বলেন, ‘ল্যুভর হলো এমন একটা বই, যা দেখে আমরা পড়তে শিখি। তাই বলে আমরা কখনোই আত্নতুষ্ট হয়ে আটকে থাকবো না আমাদের শ্রদ্ধেয় পূর্বসূরীদের উজ্জ্বল ফরমূলায়’। তবে পৃথিবীর প্রত্যেক তরুণ শিল্পীদের শুরুটা এমনই হয়, পেছনে তাকিয়ে হাঁটার একটু অভ্যাস থাকলেও পরে এ অভ্যাস বিলুপ্ত করে নতুন রাস্তা নির্মাণ করে ফেলেন। আসলে শিল্পকলা গুরুমূখী শিক্ষা।
চীন-জাপানের চিত্রাঙ্কন ঘরানা ইউরোপিয়ান ঘরানা থেকে আলাদা ছিলো এক সময়। যদিওবা এখন শিল্পে কর্মে দেশকাল নেই- পুরো পৃথিবীই একদেশ। প্রাচ্যের চিত্রকর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে বস্তুর আকৃতি নয়, বস্তুর প্রাণধর্মকে স্পর্শ করা, অবিকল উদ্ধার না করে বস্তুর ভাবরূপ নির্মাণ করা। সেসব ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তবে সমকালীন শিল্পকলায় মিশ্রিত ধারা বহমান। সব ধারায় চলছে সবখানে। সে হিসেবে মং-এর শিল্পকর্মে প্রাচীন চীনা শাস্ত্রের ফতোয়া সর্বাগ্রে সিক্ত হয়নি। তাঁর যাদুকরী দক্ষতা, শিল্পিত বৈভবে তাঁর ছবি দেশে-বিদেশের সুবিদিত জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এভাবে সৃষ্টি মানুষকে অমরত্ব এনে দেয়। 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়