ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ১৬:৪৫, ৮ মে ২০২১
রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক আজকের নয়। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছিল। তখনও তাদের দোসররা রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে নানা রকম মিথ্যে প্রচারণায় মেতে উঠেছিল। পাকিস্তানের সেই প্রেতাত্মারা আজও বাংলাদেশে রয়ে গেছে এবং মিথ্যে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি বিশ্বাস করি- নতুন প্রজন্ম সঠিক তথ্য জেনে বড়ো হোক। তাই কবির মৃত্যু দিনে আমার সত্য অন্বেষণের এই প্রচেষ্টা।

বলা হয়ে থাকে ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী একটি জনসভা হয়েছিলো এবং তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেছিলেন। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। হ্যাঁ, ওই দিন সেখানে একটি জনসভা হয়েছিলো, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেননি। কারণ সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবং জোর দিয়ে এ কথা বলার কারণ হলো, তিনি সেদিন ছিলেন শিলাইদহে। তারচেয়েও বড়ো কথা সেদিন তাঁর থাকবার কথা ছিলো লন্ডন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯ মার্চ কবির ইউরোপ যাওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিলো। এবং কলকাতা বন্দর থেকে ভোরে জাহাজ ছাড়বে। কবির বাক্স-পেটরাও কিছু কিছু কেবিনে উঠে গেছে। কিন্তু কবি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এবং ডাক্তার তাঁকে বিলেত যেতে নিষেধ করেছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর সহযাত্রী ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র (‘রবীন্দ্র-সংস্পর্শে, জয়ন্তী-উৎসর্গ, পৃ. ১৯৩; সূত্র- রবীন্দ্রজীবনী, ১৪১৬, প্রভাতকুমার মুখ্যোপাধ্যায়, পৃ.৩৪২) লিখেছেন: ‘১৯শে মার্চ ভোরে কল্কেতা থেকে জাহাজ ছাড়বে। আমি জাহাজে উঠলাম; কবির বাক্স-পেটরাও কিছু কিছু আমাদের ক্যাবিনে উঠল; সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়! কিন্তু কবি কই? বহুলোক তাঁকে বিদায়ের নমস্কার জানাতে ফুল ও মালা নিয়ে উপস্থিত; তাঁদের মুখ বিষন্ন হ’ল। খবর এলো যে, কবি অসুস্থ; আসতে পারবেন না। ঐ [ চৈত্রমাসের] গরমে উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ-অভ্যর্থনাদির আদর-অত্যাচারে রওনা হবার দিন ভোরে প্রস্তুত হ’তে গিয়ে, মাথা ঘুরে তিনি প্রায় পড়ে যান। ডাক্তাররা বললেন, তাঁর এ-যাত্রা কোনোমতেই সমীচীন হ’তে পারে না। রইলেন তিনি, আর গোটা ক্যাবিনে একা রাজত্ব ক’রে, তাঁর বাক্স-পেটরা নিয়ে চল্লুম আমি একলা।’

এখানে একটি কথা স্পষ্ট যে, তাঁর বিলেত যাওয়া নিশ্চিত ছিলো, তাই গড়ের মাঠের সভায় যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। এরপরের  কথা হলো- তিনি তো শেষ পর্যন্ত বিলেত যাননি। হ্যাঁ যাননি। তবে তিনি কলকাতায়ও ছিলেন না। চলে এসেছিলেন শিলাইদহ। এ সম্পর্কে প্রমাণ হলো ২৫ মার্চ ১৯১২ তারিখে কাদম্বিনী দেবীকে লেখা কবির চিঠি। চিঠি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে। তিনি লিখেছেন: ‘... এখনো মাথার পরিশ্রম নিষেধ। শিলাইদহে নির্জ্জনে পালাইয়া আসিয়াছি।’ ( চিঠিপত্র, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৫৩) সুতরাং তিনি শিলাইদহে গিয়েছিলেন। এবং সেখানে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন। দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন, তার প্রমাণ হলো- এখানে বসে তিনি ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত আঠারোটি কবিতা ও গান লিখেছেন। এবং তাতে তারিখ এবং স্থান হিসেবে শিলাইদহের নাম উল্লেখ রয়েছে। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি রচনার শেষে তারিখ এবং স্থানের নাম লিখতেন! সে জন্য প্রমাণ দিয়ে বলা গেলো যে, তিনি সে সময় শিলাইদহ ছিলেন। এ সময়ে লেখা ‘ভাসান’ কবিতার উল্লেখ করতে পারি। এটা গেলো গড়ের মাঠের জনসভার বিষয়ের কথা। এখানে প্রমাণিত হলো যে তিনি সেই জঘন্যতম সভায় উপস্থিত ছিলেন না, সভাপতিত্ব করা তো দূরের কথা।

এরপর আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা প্রসঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২১ সালে। মাত্র পাঁচ বছর পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার জনগণের আমন্ত্রণে ঢাকা আসেন। এখানে সাধারণ বুদ্ধিতেই আসে যে, যিনি বিরোধীতা করবেন, তাঁকে নিশ্চয়ই মাত্র পাঁচ বছর পর ডাকা হবে না। কারণ মানুষ এতো তাড়াতাড়ি বিরোধীপক্ষকে ভুলে যেতে পারে না। অথচ সে সময় যে ঘটনা ঘটেছিলো, তা হলো- সে সময় ঢাকার নবাবসহ জনগণ চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেয়েছিলেন কবি তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করবেন। রবীন্দ্রনাথ এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সে পরিস্থিতির সমাধান করেছিলেন। তিনি ৬-১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নবাবের আতিথেয়তা নিয়েছিলেন, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এখানে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যদি বিরোধিতা করতেন, তাহলে এমন সংবর্ধনা তিনি পেতেন না। এমনকি ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট উপাধি দেয়। বিরোধিতা করলে এটাও হতো না। কারণ এতো তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকানোর কথা নয়।

এখানে আরেকটি যুক্তি উত্থাপন করতে চাই, সেটা হলো- রবীন্দ্রবিরোধীরা এটাই প্রমাণ করতে চান যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলিমদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাননি। তাই যদি হয় তবে এর অনেক আগেই কেন তিনি মুসলিম কৃষকদের যাতে ভালো হয়, সে চিন্তা করেছিলেন? নিন্দুকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৯০৫ সালে কবি মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করার জন্য পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এমনকি নিজের নোবেল পুরস্কারের ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছিলেন। পতিসরের প্রজারা কিন্তু বেশির ভাগ মুসলিম ছিলেন। আবার  ১৯৩৭ সালে পতিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সব সম্পদ প্রজাদের মধ্যে দান করে দিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু পতিসরেই নয়, শাহজাদপুরেও (সাজাদপুরে) মুসলিম প্রজাদের গরু পালনের জন্য নিজের জায়গা দিয়ে দিয়েছিলেন। এতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় তিনি হিন্দু-মুসলিম নন, মানুষকে ভালোবাসতেন। মানুষের জন্য কাজ করতেন। তাই বলা সঙ্গত যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো অবস্থাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেননি।

লেখক : নাট্যকার এবং গবেষক; সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়