ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শামসুর রাহমানের কবিতা : শিল্পের অধিকারের প্রশ্নে

কুমার দীপ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শামসুর রাহমানের কবিতা : শিল্পের অধিকারের প্রশ্নে

 

আমার কবিতা গণ-অভ্যূত্থানের চূড়ায় নূহের
দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে
চে গুয়েভারার বয়ে যাওয়া
রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে
যারা ডুগডুগি বাজিয়ে
যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর নাচ নাচায়
তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আমার কবিতা, ফুঃ বলে
উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।
আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র
কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আত্মজীবনী।

[শুচি হয়/ মঞ্চের মাঝখানে]

 

নিজের কবিতাকে এভাবে মুক্তির অক্ষরে লেখা আত্মজীবনী বানাতে চেয়েছিলেন শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান শুধু বাংলাদেশের নন, সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসেরই অন্যতম প্রধান কবি। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর ঢাকা শহরের মাহুতটুলি এলাকায় নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতৃপুরুষের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরাস্থ পাড়াতলী গ্রামে। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ শামসুর রাহমান পুরনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৪৭-এ উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন, কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। অবশেষে পাস কোর্সে স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজি সাহিত্যেই এম এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মেধাতালিকার উপরের সারিতে ( দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয়) স্থান করে নিলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। এ-সম্পর্কে আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’য় কবি জানিয়েছেন:

‘আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে অনেক গাফিলাতি করেছি। পরীক্ষা-লাজুক ছিলাম। বেশ কিছুটা খামখেয়ালি করেছি এবং একাধিকবার পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছি কী এক অজানার টানে। আমার এই খামখেয়ালিপনা এবং অস্থিরতার ফলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ডিগ্রি হাসিল করার সৌভাগ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিএ পাস করে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে পার্ট-ওয়ান পরীক্ষায় সফল হই। আমি সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম বইয়ের সঙ্গে সখ্য স্থাপন না করেই। সেবার প্রথম শ্রেণি কেউই অর্জন করেনি। সেকেন্ড পার্ট দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার হলে পা রাখিনি। এভাবেই একটি ছেঁড়াখোঁড়া ছাত্রজীবন শেষ করতে হয়েছে আমাকে।’

পেশাগত জীবনে প্রধানত সাংবাদিকতায় সময় কাটানো কিন্তু প্রায় কোথাও স্থিরতাহীন শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ওই কবিতার নাম ছিলো ‘ঊনিশশ ঊনপঞ্চাশ’। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত পত্রিকা ‘কবিতা’য় ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে রাহমানের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হতে থাকে। তবে কবির প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয় কবি হিসেবে পরিচিত হওয়ার অনেক পরে, ১৯৬০ সালে,  ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ নামে। এই গ্রন্থটিতে পূর্বজ জীবনানন্দের ঈষৎ অনুসৃতি পরিলক্ষিত হলেও মৌলিক কবিপ্রতিভার ছাপ স্পষ্ট। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য ‘রৌদ্র করোটিতে’ প্রকাশিত হলে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। এরপর থেকে দীর্ঘ কবিজীবনে তাঁর প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা ৬৫; যেখানে কবিতাসংখ্যা ২৯৬০টি। এছাড়া ‘শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ও ‘শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা’ নামে দুটো কবিতা সংকলনও আছে। ‘এলাটিং বেলাটিং’ নামে একটি শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থও আছে। কবিতা ছাড়াও ৪টি উপন্যাস ও ১টি আত্মজীবনী তাঁর রচনার উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বেশ কয়েকটি কবিতাসংকলনও তিনি বিভিন্ন লেখকের সাথে সম্পাদনা করেছেন। অগণিত প্রতিবাদী কবিতা লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় কলাম লিখেছেন তিনি । তবে কলামগুলো লিখেছেন সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, মৈনাক, জনান্তিকে ও মজলুম আদিব ছদ্মনামে। পাকিস্তান আমলে কলকাতার একটি পত্রিকায় মজলুম আদিব ছদ্মনামে কলাম লিখেছিলেন তিনি।

শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান বিষয় ছিলো তাঁর সময়, সময়ের প্রবল প্রতিকূলতা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তদানের ব্যাপকতা যেমন তাঁর কবিতায় এসেছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশেরও নানা গ্লানির চিত্র। তরঙ্গসঙ্কুল বিশ্বচিত্রও অনুপস্থিত থাকেনি। এবং এই বিষয়গুলো অনেক সময়ই সরাসরি বক্তব্যের ঢঙে ধরা দিয়েছে কবির পঙ্‌ক্তিগুচ্ছে। ফলে তাঁর কবিতার শিল্পসংযম বা নান্দনিকতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেও হয়তো চেয়েছেন। কিন্তু সেই প্রশ্ন কতখানি যুক্তিযুক্ত- তা যাচাইয়ের মানসতা থেকেই এই গদ্য- শিল্পের অধিকারের প্রশ্নে।

 

দুই.

‘কবিতার কথা’য় জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন: ‘চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভেতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন।’ তাঁর মতে চিন্তা, ধারণা, মতবাদ বা মীমাংসার মতো বিষয়গুলি যদি কবিতার কঙ্কালকে দেহ দিতে চায় কিংবা দেহকে যদি দিতে চায় আভা, তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না, পদ্য লিখিত হয় মাত্র, ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় শামসুর রাহমানের অসংখ্য কবিতায় চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ আছে। এবং অনেকক্ষেত্রেই তা সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা-উপশিরা বা রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকেনি; বরং কবিতার কঙ্কালকে দেহ দিয়েছে, কখনও কখনও দেহকে দিয়েছে আভা। রাহমানের কবিতার সমুদ্রে অবগাহন করলে একথার সত্যতা মিলবে। পঞ্চাশের দশকে আবির্ভাবের পর থেকে একুশ শতকের প্রথম পাঁচ বৎসর পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছোট-বড় ঘটনা-অনুঘটনারাজিকে কবিতায় ধারণ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত চিন্তা বা ধারণা কিংবা মতবাদকে সামনে এনেছেন অনেক সময়। অনিবার্যভাবেই তা এসেছে বলা যায়। ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ থেকে ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ পর্যন্ত প্রথম কাব্যচতুষ্টয় বাদ দিলে নিজ বাসভূমের থেকে একেবারে ‘না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন’ পর্যন্ত, পয়ষট্টিতম কাব্য অবধি প্রায় প্রত্যেকটি গ্রন্থের একাধিক কবিতায় অন্যায় শাসন ও শোষণের সমালোচনা ; ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ; মুক্তির সংগ্রাম ও মুক্তবুদ্ধির প্রতি ব্যাপক সমর্থন করতে গিয়ে; ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সত্যোচ্চারণ করতে গিয়ে আপন কবিতার শরীরে সিদ্ধান্ত বা মতবাদের আবহ এবং আবহমানতার আভা প্রদান করেছেন। বিশেষত বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কিংবা দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’র মতো গ্রন্থগুলির পাতায় পাতায় রয়েছে স্বাধীনতার পূর্বাপর স্বৈরশাসনের তীব্র প্রতিবাদ, যুদ্ধাপরাধিদের বিরুদ্ধে প্রবল বিষোদ্গার এবং নিজস্ব শিল্প চেতানায় এক ধরণের সিদ্ধান্ত পরায়ণতা।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা, দুঃসময়ে মুখোমুখি, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, গুড মর্নিং বাংলাদেশ, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, একটি মোনাজাতের খসড়া, কেন মানুষের মুখ, গর্জে ওঠো স্বাধীনতা, রাজনীতি, মিহিরের উদ্দেশ্যে, কিংবা কবন্ধ তাণ্ডব-এর মতো কবিতাগুলোতে কখনও কখনও উচ্চকণ্ঠেই ঘোষিত হযেছে কবির ব্যক্তিগত মত ও পথের কথা। তাহলে রাহমানের এইসব কবিতা কি কবিতার আকারে পদ্য? না কি পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত বা মতবাদ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কবি নিজে তাঁর কবিতা সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করতেন সেই বিষয়টা অনুধাবন করা জরুরি হয়ে ওঠে। নিজের কবিতা বিষয়ে বিনয় থাকলেও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি যে ছিল না, তা একাধিক কবিতায় বা কথকতায় জানিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। বলেছিলেন, তাঁর কবিতায় কখনও এরকম কোনো ভঙ্গি থাকবে না, যা ভড়কে দেবে পাঠককে; যার ধাক্কায় কবি যশঃপ্রার্থীরা পা হড়কে পড়বে; কিংবা সমালোচকগণ যার মর্মোদ্ধার করতে প্রাণপাত করবেন, চুলকিয়ে মাথায় ঘা করবেন, অতঃপর জগাখিচুড়ি মার্কা অবোধ্য থিসিস দাঁড় করাবেন এমন কবিতাও তাঁর কাম্য ছিলো না। কবিতাকে তিনি বিজ্ঞাপনের ন্যাকা বুলিও করতে চান নি, রাখতে চাননি এমন শব্দাবলী যার জন্যে বার বার স্ফীতোদর অভিধান দরকার হয়। স্বৈরাচারী শাসক, নষ্টমন্ত্রী, ভ্রষ্টরাজনীতিবিদ, কোনো কালোবাজারি কিংবা চোরাচালানীর সঙ্গে ফুলের তোড়া সাজানো টেবিলে ডিনার খাওয়া নয়, গরিবের ঘরে চিড়ে গুড় ভাগ করে খাওয়াতেই কবির অধিক আগ্রহ। পুলিশের লাঠি কিংবা বন্দুকের নল, কিছুই কবির কবিতাকে ভয় দেখাতে সক্ষম নয়। বরং বাঙালির সংস্কৃতি আর শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করাই ছিলো কবির কবিতা লিখবার উদ্দেশ্য।

রাহমান নিজেই বলেছেন, আমার কবিতা হবে কামরুল হাসানের সেই/ তন্বীর মতো যে ঢেঁকিতে ধান কোটে, গভীর ইঁদারা থেকে শক্ত হাতে রশি টেনে / বালতি ভরা পানি তোলে গ্রীষ্মের দুপুরে/ হাঁড়-কাপানো শীতের সকালে। লিখেছেন, আমার কবিতা জয়নুল আবেদীনের গুণটানা মাঝি/ যার বেঁকে যাওয়া পিঠে ছড়িয়ে পড়ে/ ঘাম-মুক্তো আর সূর্যাস্তের রঙ। (শুচি হয়/ মঞ্চের মাঝখানে)। শুধু শ্রমজীবী অভাবী মানুষ নয়, এইসব বঞ্চিত মানুষদের পক্ষে যারা সংগ্রাম করেছেন, বিপ্লবের আহবান করেছেন যুগে যুগে, সেইসব মহাত্মাদের হৃদয়ে ধারণ করা ছিলো শামসুর রাহমানের কবিতার অনন্য প্রতিশ্রুতি। এইসব প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়ে আপন কবিতার শরীরে যে মতবাদ বা সিদ্ধান্তসমূহ সংস্থাপিত করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন, সেই জন্যেই কি রাহমানের এই স্বভাবের কবিতাগুলোকে  পদ্য বা পদ্যশরীরী মতবাদ বলবো? নাকি এই প্রতিশ্রুতিভ্রষ্ট ক্ষমতাপিপাসুদের দেশে সময়ের বিষপান করে নীলকণ্ঠী হওয়া শামসুর রাহমানের কবিতারাজিকে আধুনিক মানবতাবাদী শিল্পের দায়বদ্ধতা কলবো?

রাজনৈতিক কবিতা নামক কবিতাসংকলনের ভূমিকায় কবির নিজের বক্তব্য থেকে জানা যায়, কবিতা লেখার শুরুর দিকে তিনি বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবে রাজনীতিকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করতেন কবিতার জন্য। ফলে তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় রাজনীতির ছাপ ছিলো না। এমনকি রাজনীতিহীনতার অজুহাতে নজরুল-সুকান্ত’র কাব্য-সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈরিতায় প্রতিবাদমুখর বাংলাদেশের সমসাময়িক পাটভূমি অনিবার্যভাবেই প্রভাব ফেলে তাঁর কবিতায়। শুরু হয় রাজনৈতিক চেতনামিশ্রিত পথচলা। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কবিতা লেখেন নি। ড. আনিসুজ্জামানের ভাষায়, এ রাজনীতি দলের নয়, দশের; এ কবিতা শ্লোগানের নয়, মর্মঘাতী  ব্যঙ্গের, অব্যক্ত যন্ত্রণার, তীব্র ভালোবাসার। কথাগুলো কতবড়ো সত্য, তার প্রমাণ রাহমানের অবিশ্বাস্য ধারাবহিকতাপ্রসূত বিপুল কবিতারাশি ; যেখানে তিনি দলনের সমালোচনা করলেও দলবাজদের সহযোগী হননি, সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি দিলেও সংগ্রামীদের শ্লোগান লেখেননি। তবু যে ধরণের কবিতার প্রতি অভিযোগের আঙুল উত্থিত হয় বা হতে পারে সে রকম  সংকলনটির ভূমিকায় কবি বলেছেন:

রাজনীতি যখন কবির আত্মোপলব্ধির অন্তরঙ্গ অংশ হয়ে ওঠে তখনই রসোত্তীর্ণ রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিগণ যদি অত্যুৎসাহী হয়ে কী বিষয়ে এবং কীভাবে কবিতা লিখতে হবে নিবর্ধারণ করে দেন, তাহলে কবি ও কবিতার পক্ষে সেটি হবে ঘোর অমাবস্যা। অনেকের ধারণা রাজনীতিকে ধারণ করলে কবিতা আর কবিতা থাকে না। এই ধারণার প্রতি আমার সায় নেই। রাজনীতি-নির্ভর কবিতা উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট দু’ ধরনেরই হতে পারে। এটা রাজনীতি বিবর্জিত কবিতার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। কোনো সচেতন কবি তাঁর দেশের রাজনীতি বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন থাকতে পারেন না। দেশীয় রাজনীতিতো বটেই এমনকি বিশ্বরাজনীতিও তাঁকে স্পর্শ করে, কেননা তিনি অন্য কোনো গ্রহের নয় এই গ্রহেরই বাসিন্দা। তাই কোনো কবির পক্ষে রাজনীতিকে বেমালুম ভুলে থাকা সম্ভব নয়। অবশ্য এ কথা ঠিক, রাজনীতি ও কবিতাকে একাত্ম হতে হবে। কবিকে মনে রাখতে হবে যাতে কোনো পাঠকের মনে না হয় যে রাজনীতি আরোপিত কোনো ব্যাপার। কবিতা শেষ পর্যন্ত একটি শিল্প। শিল্পরহিত রচনা কখনো কবিতা বলে গ্রাহ্য হতে পারে না।’

[পূর্বলেখ/ শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা]       

দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে একটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন শামসুর রাহমান। কবি যেহেতু এই পৃথিবীরই একজন, সেহেতু দেশের তো বটেই বিশ্বরাজনীতিও তাঁর কবিতার বিষয় হতে পারে। কিন্তু এই রাজনীতি হতে হবে কবির আত্মোপলব্ধির অনিবার্য অংশ, কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক তা যেন নির্দেশিত না হয়। নির্দেশিত হলেই তা কবিতা ও কবি উভয়ের জন্যেই অমাবস্যার অন্ধকার বয়ে নিয়ে আসে। এই দিকটি বিবেচনা করেই রাহমানের কবিতাকে ব্যবচ্ছেদ করতে হবে। বুঝতে হবে একজন সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে কবি  কখনও রাজনীতির প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে পারেন না। পারেন না বলেই ম্যাক্সিম গোর্কি মা’র মতো রাজনৈতিক কমিটমেন্টনির্ভর অত্যাশ্চর্য রচনা লেখেন; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মানদীর মাঝি’র অন্তরালে মুক্তজীবনের কথা বলেন; পরিবারের দাবি ছেড়ে শরৎচন্দ্র লেখেন পথের দাবি; নজরুল-নাজিম হিকমতরা কারাগারের দিনপঞ্জি লেখেন; সুকান্তরা অঙ্গীকার করেন- এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য  করে যাবো আমি। আর রামায়ণ-মহাভারত কিংবা ইলিয়ড-ওডিসি’র মতো রাজনীতিনির্ভর মহাগ্রন্থগুলোও তো একারণেই বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে।

 

তিন.

শামসুর রাহমানের কবিতায় রাজনীতি কিংবা রাজনীতিপ্রসূত কোনো মত-পথ যাই থাক, সেখানে শিল্পের দাবি ক্ষুণ্ন হয়নি। বাধাগ্রস্ত হয়নি পাঠকের নান্দনিক তৃষ্ণা। বরং রাহমানের কবিতার কিছু অশ্রুতপূর্ব শব্দঝঙ্কার, অতুলনীয় উপমারাজি, অদৃষ্টপূর্ব চিত্রকল্প নবোদ্ভাসিত কাব্যভাষা একটা জাতিকে যেভাবে অভিভূত করে রেখেছে এতটা কাল, তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যও তো কম নয়। আর কবিতাকেও তো শেষ পর্যন্ত একটি শিল্প হতে হয়, তাতে রাজনীতি-সমাজনীতি যা-ই থাকুক না কেন। শামসুর রাহমানের কবিতা মূল্যয়ানের আগে আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, কেবল উচ্চকণ্ঠী রাজনীতি কিংবা নাগরিক চৈতন্যনির্ভরতা নয়, কবিতাকে বহুগামী করতে শিল্প ও সুন্দরের সন্ধানে জ্যোৎস্নাধোয়া পল্লিকুঠিরে পাঠাতেও কবির সদিচ্ছার কোনো কমতি ছিলো না। শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রথম সংস্করণের ভূমিকায়  তিনি বলেছিলেন: ‘আমিতো জীবনের স্তরে স্তরে প্রবেশ করতে চাই, কুড়িয়ে আনতে চাই পাতালের কালি, তার সকল রহস্যময়তা। যে মানুষ টানেলের বাসিন্দা, যে মানুষ দুঃখিত, একাকী- সে যেমন আমার সহচর, তেমনি আমি হাঁটি সে সব মানুষের ভিড়ে, যারা ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে তৈরি করে মিছিল।

[প্রথম সংস্করণের ভূমিকা/ শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা]

সকলের সহযোগী হতে চাওয়া শামসুর রাহমান কতটুকু সর্বগামী হতে পেরেছিলেন সে বিচার হয়তো বিশ্লেষণসাপেক্ষ, কিন্তু কবির প্রচেষ্টা যে ছিল একথা বলতেই হবে। অবিরল জলভ্রমির একটি কবিতায় নিজের কবিতার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন,

                তোমাকে পাঠাতে চাই শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, ভিড়ে

                কেরানির কলোনিতে, মজুরের ঝুপড়িতে আর

                মাছরাঙাময় বিলে; কৃষকের কুপিজ্বলা রাত্রির কুটিরে,

                তোমাকে পাঠাতে চাই ফ্যাক্টরির চঞ্চল  চাকার

                খুব কাছে, হাটে,

                অজস্র জোনাকি-ঝলসিত ঝোপ-ঝাড়ে,

                কুমোর পাড়ায় আর জেলের ডিঙিতে পুকুরের স্তব্ধ ঘাটে,

                চাঁদের সঙ্কেতে চমকিত ছোট ঘরে, চুপিসারে

                    [তোমাকে পাঠাতে চাই/ অবিরল জলভ্রমি]

অন্যদিকে যে কবিতায় রাহমানের কবিত্বের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়; আধুনিক কবি ও কবিতার প্রধান পুরোহিত বুদ্ধদেব বসু ও তার বিখ্যাত কবিতা পত্রিকার সাথে আত্মপরিচিতি লাভ হয়, সেই রূপালি স্নান-এ বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে সাথে নিয়েই এগোতে চেয়েছিলেন তিনি। হাজার হাজার বছরের ঢের/ পুরনো প্রেমের কবিতার রোদে পিঠ দিয়ে বসে ছন্দে ও মিলে কথা বানানোর আরক্ত কতো তীক্ষ্ম লজ্জা/ দৃষ্টিতে পুষে, মানুষের ধূসর মেলায় হেঁটে, চারপাশের সুনিপুণ অবহেলা কিংবা হিংস্র নেকড়ের পালের আগমনেও সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে গড়তে চেয়েছিলেন উজ্জ্বল কথার মিছিল। এবং প্রেত চাটা সন্ধ্যার আঁধারে থেকেই শান্ত রূপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করতে চেয়েছিলেন। এ যেন জাহান্নামের আগুনে বসেই পুষ্পের হাসি হাসবার বাসনা। এই বাসনাই প্রতিশ্রুতি হয়ে ধরা দিয়েছে রাহমানের জীবনে। এবং এই প্রতিশ্রুতিই তাঁকে দিয়েছে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শিল্পের প্রতি দায়বন্ধ থাকবার প্রেরণা। প্রকৃত কবিতার অনিরুদ্ধ আবেগ। এবং এইটাকেই যদি শামসুর রাহমানের শিল্পচৈতন্য তথা নন্দনভাবনার সূত্র হিসেবে গ্রহণ করি তবে তাঁর অর্ধশতাধিক বছরের কাব্যসাধনাকে প্রাগ্রসর জীবনবাদী নান্দনিকতার অপার উৎস হিসেবে উপভোগ করতে কুণ্ঠিত হতে হয় না। স্মর্তব্য, সোনার বাংলা নামক একটি সাপ্তাহিক-এ প্রথম কবিতা প্রকাশের পর অসন্তুষ্ট কবিপিতা তীব্র শ্লেষোক্তি করে বলেছিলেন, পারবে সে হুমায়ুন কবিরের মতো কবি হতে? এর উত্তরে রাহমান বলেছিলেন, যদি আমি কবি হই, হুমায়ূন কবিরের চেয়ে বড়ো কবি হবো। সেদিনের এই কথাটি যে প্রথম প্রকাশের অহম্ কিংবা তারুণ্যের জোয়ারে ভাসা কোনো কবিযশঃপ্রার্থীর আবেগমাত্র ছিল না, তা বাংলা কবিতার পাঠক সম্প্রদায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছেন। আর হুমায়ুন কবির নন, সমগ্র বাংলা সহিত্যেরই যে অন্যতম প্রধানদের একজনের নাম শামসুর রাহমান, একথা আজ দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। এবং রাহমান পরবর্তী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে  মহীরুহপ্রতীম এমন কোনো কবিপ্রতিভা নেই; আছে কতিপয় কবিকর্মীর কাব্যচর্চার প্রয়াস আর কতক কবি যশঃপ্রার্থী বামনের স্ট্যান্ডবাজির মহড়া। কেউ কেউ আবার বামনত্বকেই ভেবে নিয়েছেন যোগ্যতা প্রকাশের ধ্রূবক। কবি-সমালোচক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কথা ধার নিয়ে বলতে হয়, শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কবিতায় এখন মাঝারিদের বিভাহীন উপস্থিতি; উদ্যমী তরুণরা নানা নিরীক্ষার উদ্বায়ী শ্রমে ক্লান্ত হয়ে এখন কাল যাপন করছেন শুধুই শব্দব্যায়ামে। মনে হচ্ছে শামসুর রাহমানের তিরোধন আধুনিকবাদী বাংলা কবিতার শেষ মাইলফলক হয়ে ঘোষণা করছে একটি মহৎ পরিক্রমণের অবসান বিন্দু।

[শামসুর রাহমান : আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ / কবিতার অন্তর্যামী : আধুনিক উত্তরাধুনিক ও অন্যান্য অনুষঙ্গ]

অবশ্য, এতটা অবসাদগ্রস্থতা কাম্য না-ও হতে পারে। তবু যুগজিজ্ঞাসার পেক্ষাপটে, প্রযুক্তিগত চিন্তা-চৈতন্যের অভিঘাতে নতুন প্রজন্মের কাছে বই বিষয়টাই যখন বাজেয়াপ্ত হতে চলেছে ; বিনোদনের দুনিয়াটা যখন স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, স্মার্টফোনসহ নানারকমের ইলেকট্রনিক স্ক্রিনে বন্দি হয়ে যাচ্ছে; অধিকাংশ মানুষের সৃজনশীলতা যখন বণিক শ্রেণির বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হচ্ছে; মূল্যবোধের কোষাগার শূন্য হয়ে অর্থই যখন সকল ফলের নিয়ন্তা হয়ে উঠছে; শরীরী সুখ-স্বাচ্ছন্দই যখন মনুষ্যপ্রজাতির প্রধান প্রণোদনা হয়ে পড়েছে, তখন প্রকৃত শিল্প-সাহিত্যের সাধনা তো পণ্ডশ্রমের পর্যায়েই পতিত হতে পারে। তাছাড়া সাহিত্যের যে অংশটুকু ক্ষীণপ্রাণে টিকে থাকার স্বীকৃতি পেয়ে চলেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, তা যখন কবিতা নয় (উপন্যাস), তখন শামসুর রাহমানের মতো কবিতার শহিদ সন্তর পুনরাবির্ভাব কিংবা আবির্ভূত হয়ে স্বীকৃতি সহকারে টিকে থাকা শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেও দুরূহ বলেই মনে হয়। এর পরেও কবিতার চর্চা কিংবা কবিতা নিয়ে কতিপয় প্রলেতারিয়েতের কৌতূহল থেকে যাবে হয়তো আরো অনেক অনেক দিন। আর ততদিন বাংলা কবিতার অসীম আকাশে নান্দনিক নক্ষত্ররূপে  যারা প্রজ্জ্বলিত থাকবেন শামসুর রাহমান তাদেরই অনন্য একজন। 

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়