ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ছোটগল্প || সন্দেহ

আদনান সৈয়দ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৩, ৬ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || সন্দেহ

নিউ ইয়র্কের আকাশ মেঘলা আর সেই সঙ্গে ঝিরঝির বৃষ্টি। অথচ গত রাতেও আবহাওয়া পূর্বাভাস দিয়েছিল, আকাশ পরিষ্কার থাকবে, তাপমাত্রা থাকবে ষাট ডিগ্রি ফারেনহাইট। কিন্তু এখন সব হিসাব উল্টেপাল্টে গেল। কথায় আছে নিউ ইয়র্কের তিন ডব্লিউর নাকি কোন নিশ্চয়তা নেই। ওয়ার্ক, উইমেন এবং ওয়েদার। এমনিতেই সোলায়মানের মেজাজটা খিটমিটে হয়ে আছে। তার উপর আবহাওয়া পূর্বাভাসের উপর ভরসা করে সঙ্গে সে ছাতা নিয়ে আসেনি। তাতেই সব বিপত্তি। কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অর্ধেকটা শরির ভিজে গেল।

‘শালা, মাগিটার রকম-সকম খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না। বিশেষ করে ইদানিং তার ভাবসাব যেন আসমানে উঠে গেছে। ও ভেবেছে আমি কিছুই টের পাই না! আরে, তুই কোথায় যাস,  কার সাথে সময় কাটাস তা কি আর আমি বুঝি না? হাহ! আমি মানুষ চড়িয়ে বেড়াই আর শেষ পর্যন্ত আমার সাথেই কিনা চালাকি?  ঠিক আছে দেখা যাবে। সময়ই সব বলে দিবে। তখন ঠিক দেখে নিব কত ধানে কত চাল।’

কথাগুলো স্ত্রী লতিফা সম্পর্কে বিড়বিড় করে বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করল সোলায়মান। পেশায় নিউ ইয়র্কের ফুড ভেন্ডার। ম্যানহাটনে মিড টাউনের থিয়েটার পাড়ায় একটি জায়রো দোকানে কাজ করেন।  বয়স পঞ্চাশ হলে কি হবে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে গায়ের উজ্জ্বল রং এখন ফিকে হয়ে তামাটে। কপালে চিন্তার ভাঁজ আর গালের চামড়া কুঁচকে গেছে। দেখলে মনে হয় বয়স ষাটের বেশি। তবে চোখের তেজ এখনো প্রখর। গনগনে রৌদ্রে ম্যানহটানের রাস্তায় জায়রো বিক্রি করা সহজ কাজ না। সেই ভোর চারটায় সাত সকালে ঘর থেকে বের হয় আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছয়টা। কঠিন পরিশ্রমের কাজ। প্রতি দিন সব মিলিয়ে বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। তারপরও সংসার চালাতে হিমশিম খায় সোলায়মান। এক হাতের রোজগারের টাকায় সংসার চালানো এই শহরে খুব কঠিন। যদিও লতিফা প্রায় সময়ই আবদার করে- সে একটা পার্ট টাইম কাজ করতে চায়। তাতে ঘরের মাসের বাজারের খরচাটাও যদি উঠে আসে অসুবিধা কী? কিন্তু সোলায়মান স্ত্রীকে কাজ করতে দেয় না। এই না দেয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। সোজা বাংলায় বললে- বলা যায় সন্দেহ। ইদানিং নিউ ইয়র্কের বাঙালি পাড়ায় অনেক রকম কথা কানে আসে। কাজ করতে গিয়ে অনেক বাঙালি নারী নাকি প্রায় সময়ই মালিকের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে, আবার কেউ কেউ নাকি ভেগেও যায়। এভাবে অনেক বাঙালির সুখের সংসার তছনছ হয়ে গেছে। এমন সংবাদ প্রায় সময় নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাঙালি পত্রিকাতেও ফলাও করে ছাপা হয়। এসব ভেবে সোলায়মান একটা সিদ্ধান্ত নেয়। কষ্ট করে প্রয়োজনে এক বেলা খেয়ে হলেও একা একটা সংসার কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে তার আক্ষেপ নেই। আরেকটা বিষয় হলো লতিফা দেখতে রূপবতী। কে বলবে তার বয়স চল্লিশ ছুইছুই করছে। এই বয়সেও পিনোন্নত বুক দেখলে যে কোন পুরুষের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। গায়ে গতরে যেমন দেখতে সুন্দর আবার কথাও বলে খুব কায়দা করে। এই সুন্দরী হওয়াটাই লতিফার সব সমস্যার কারণ। অঘটন ঘটতে কতক্ষন! অতএব স্ত্রীর উপর সোলায়মানের দৃষ্টি সবসময় বাজ পাখির মত। কিন্তু চোখ রাখলে কী হবে? সোলায়মানকে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে ম্যানহাটনের রাস্তায় কাজ করতে হয়। আর যাই হোক, ম্যানহাটনে বসে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ কথাও বেশ ভালো করে বোঝে বুদ্ধিমান সোলায়মান। তবে এখন অবস্থা খারাপের দিকে। শেষ রক্ষা আর বুঝি করা গেল না। ইদানিং সে স্ত্রীকে অন্যরকমভাবে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তার নিশ্চিত ধারণা স্ত্রীর সঙ্গে অন্য কোন পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যদিও বিষয়টা সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। তবে কিছু যে একটা হয়েছে এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। পরিষ্কার কোনো আলামত হাতে পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই সন্দেহ নিয়েই নরক যন্ত্রনায় সোলায়মানের দিন কাটে। সাধারণত যা হয় প্রতিদিন বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পরে। তখন ইচ্ছে করে এক হাড়ি ভাত সে একাই খেয়ে ফেলে। প্রথম  প্রথম লতিফা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে এটা-ওটা এগিয়ে দিয়ে বিশেষ খাতির-যত্ন করতো। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সোলায়মান খেতে বসলে লতিফা আর আগের মত খাতির যত্ন করে না।  উল্টো, স্বামী বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সে সেজেগুজে তৈরি হতে থাকে। ঠোটে লিপস্টিক ঘষে, গালে গোলাপি পাউডার মাখে। ঘরে থাকতে থাকতে নাকি তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম! তাই বাইরের খোলা হাওয়া বুকে নেয়া তখন জরুরি হয়ে ওঠে। লতিফা সেজেগুজে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সে বাইরে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সোলায়মান তাদের ৬ বছর বয়সি শিশুপুত্রকে দেখভাল করে। স্কুলের হোমওয়ার্ক করায়, খেলাধুলা করে। কিন্তু আজ সোলায়মান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘লতিফা, আমি এইমাত্র চৌদ্দ ঘণ্টা কামলা দিয়ে ঘরে এলাম। তুমি বাইরে যাচ্ছ! গত কয়েক সপ্তাহ আমি লক্ষ্য করছি, বাড়ি ফেরার পরই তুমি সেজেগুজে বেশ্যার মত ঘর থেকে বের হয়ে যাও। কোথায় যাও তুমি? জানতে পারি? কী এত জরুরি কাজ তোমার যে প্রতিদিন বাইরে হাওয়া খেতে যেতে হয়? কার জন্যে তোমার এত পিরিতি? তোমার কী ধারণা  আমি কিছুই বুঝি না?’

‘বেশ্যা’ বলায় লতিফার আত্মসম্মান ফস করে জ্বলে ওঠে। ‘নিজের বউ সম্পর্কে এমন বাজে কথা মুখে আনতে তোমার লজ্জা করে না? তুমি কি বলতে চাও? তুমি সারাদিন বাইরে থাকো। রান্না-বান্না, ঘর পরিষ্কার থেকে শুরু করে আমি কি না করি। আমি ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে বাইরে ঘুরতে গেলে মহাভারত কী অশুদ্ধ হয়ে যাবে? নিজের জন্যে আমি কি এই দুই ঘণ্টাও সময় পেতে পারি না?’

‘তা যাও। কিন্তু প্রতিদিন তোমার বাইরে যাওয়া এত জরুরি কেন? প্রতিদিন এত সেজেগুজে তুমি কোথায় যাও শুনি? কে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে?  কার কাছে যাও?’

সোলায়মানের কথা শুনে লতিফা সাপের মত ফণা তুলে এগিয়ে আসে। সোলায়মান ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। লতিফা কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘সাবধান! আমার চরিত্র নিয়ে কোন কথা বলবা না। তুমি খুব ভালো করে জানো যে আমার চরিত্র তোমার চরিত্র থেকেও অনেক উন্নত।’

সোলায়মান এবার চুপ হয়ে যায়। লাতিফা ঠিক সময়ে তুরুপের তাসটি ছেড়ে দিল। অনেকটা নেতিয়ে পরে এবার কম্পিউটার খুলে ফেসবুক নিয়ে বসল সে। কিন্তু লতিফার সন্ধ্যাকালীন বিহারের দৃশ্যপট মন থেকে ফেলতে পারলো না। বিষয়টা নিয়ে সে যত ভাবছে তত আরো ঘোলাটে হচ্ছে। কি করা যায়? এর বিহিত কী? কীভাবে স্ত্রীকে তার নাগরসহ হাতেনাতে ধরা যেতে পারে সেই ভাবনায় ডুবে রইল সে।

হঠাৎ করে ‘গোট ইট’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল সোলায়মান। বাহ! এত সুন্দর সমাধান! নিজেকে শার্লক হোমস ভাবতে শুরু করে দিল সে। আস্ফুট স্বরে লতিফাকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে শুধু বলল, ‘ঘুঘু দেখেছ সোনা কিন্তু ফাঁদ দেখ নি।’ বাংলা সিনেমার ভিলেনের ডায়লগ দিতে দিতে ঠোঁটের কোণায় কায়দা করে আরেকটা সিগারেট রাখলো সে। এবার মনে মনে পরিকল্পনাটা আঁটল। আগামীকাল কাজ থেকে আসার পর লতিফা যখন ঘরের বাইরে যাবে তখন চুপি চুপি সে তার পিছু নিবে। তবে সমস্যা একটা আছে। এই ৬ বছর বয়সের শিশুকে কার কাছে রেখে যাবে? তাকে নিশ্চয়ই কোনভাবেই একা বাসায় ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না। অতএব একমাত্র সামাধান হলো তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। ব্যাস।

সারাদিন কাজের জায়গায় সোলায়মানের সময় যেন যেতে চায় না। কখন বাড়ি ফিরবে এই নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। ফেরার পথে সাবওয়েতে বসে কল্পনায় সে নিজে নিজেই অনেক ছবি আঁকতে শুরু করে। সোলায়মান কল্পনায় দেখতে পায় লতিফা ঘর থেকে বেড় হয়ে নর্দান বুলোভার্ড- এর বড় রাস্তাটা পার হয়ে পশ্চিমের দিকে হাঁটছে। কিছুদূর যাওয়ার পর সেখানে মেপল গাছের নিচে এক শেতাঙ্গ  যুবক তার নতুন চকচকে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এমন ঘটনা সত্যি যদি ঘটে তখন সোলায়মানের করণীয় কাজ কী হতে পারে? সে কী করবে? গাড়ি আগলে সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? তারপর চুলের মুঠি ধরে গাড়ি থেকে লতিফাকে বেড় করে নিয়ে আসবে? নাকি গাড়িটাকে নীরবে অনুসরণ করবে? নাকি সেই মুহূর্তেই নিউ ইয়র্কের পুলিশের জরুরি নাম্বার ৯১১ ডায়াল করে পুলিশ কল করবে! এসব ভাবতে ভাবতেই সোলায়মান ঘরের কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় লতিফা। সোলায়মান মুখে কৃত্রিম হাসি ছুড়ে দিয়ে লতিফাকে বলল, ‘বাহ! আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে!’

লতিফা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দেয়াল ঘরিটার দিকে তাকালো। তারপর ধীরে ধীরে সোলায়মানকে বলল, ‘আমি বের হচ্ছি। বাচ্চাটার দিকে একটু খেয়াল রেখো। ফেসবুকের উপর হুমরি খেয়ে সারাক্ষণ পরে থেকো না।’

সোলায়মান বাধ্য ছেলের মত কাঁধ ঝাকাল। এবং লতিফা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ছেলেকে বলল, ‘আজ তোমার হোমওয়ার্ক করতে হবে না। চলো আমরা গাড়িতে করে ঘুরতে যাই, যাবে?’ একথা শুনে অয়ন মহা খুশি। পরিকল্পনামত গাড়িটা আগে থেকেই বাসার ঠিক সামনেই পার্ক করা ছিল। ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে খুব সাবধানে অয়নকে পেছনের সিটে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল সোলায়মান। তারপর ঈগল চোখে লতিফাকে খোঁজার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর সামান্য দূরেই  লতিফাকে দেখা গেল। লতিফা তখন ৩১ এভিনিউ ধরে পশ্চিমমুখি হাঁটছে। সোলায়মান তার গাড়িটা ধীরে ধীরে পাকা ডিটেকটিভ-এর মত চালাতে লাগলো। না, কল্পনায় সে যেমন ভেবেছিল ঠিক তেমন ঘটনা ঘটছে না। তবে সোলায়মান লক্ষ্য করলো লতিফা ৩১ এভিনিউ বরাবর হেঁটে ৬২ স্ট্রিটের কোণায় নর্দান বুলোভার্ডের একটা প্রাইভেট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সোলায়মান এবার অতিরিক্ত স্নায়বিক উত্তেজনায় ঘেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিকার হাতেনাতে ধরা পরতে যাচ্ছে। এই বিষাদমাখা আনন্দে সোলায়মান যেন দিশাহারা। হঠাৎ করে অয়ন বলে উঠলো, ‘বাবা, হাইড এন্ড সিক খেলা কখন শুরু হবে?’ সোলায়মান ছেলেটার গাল টিপে দিয়ে শুধু বলল, ‘এইতো বাবা খেলা শুরু হয়ে গেছে।’

দূর থেকে দেখা গেল লতিফা বাড়ির নিচে একটি কলিংবেলে চাপ দিতেই এক শেতাঙ্গ যুবক হাসিমুখে দরজা খুলে দিল। তারপর দুজন ঘরে ঢুকে গেল। সোলায়মান শুধু অস্পষ্টভাবে বলল, ‘এত নিচে নেমে গেল লতিফা?’

এই মুহূর্তে তার কি করণীয় সেটা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। কী করা যায়? পুলিশ ডাকবে? কিন্তু এই দেশে তো স্বাক্ষী প্রমাণ ছাড়া কিছু করা যাবে না। তাহলে? তাহলে আর কী? বাড়ির ভেতর স্বশরীরে প্রবেশ করে সব রহস্য ফাঁস করে দেয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তারপর যা হবার তাই হবে। ছেলেসহ গাড়ি থেকে নেমে সোলায়মান কলিং বেলে চাপ দিলো। কিছুক্ষণ পর সেই একই যুবক দরজা খুলল।

‘কাকে চাই?’

‘আমার নাম সোলায়মান। এই যে কিছুক্ষণ আগে যে নারীকে নিয়ে আপনি ঘরে প্রবেশ করলেন আমি তারই হতভাগ্য স্বামী। তা, আপনি কে? আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার কীসের সম্পর্ক?’ সোলায়মান রাগে কাঁপতে লাগল।

যুবকটি সোলায়মানের কথার কিনারা খুঁজে পেল না। শুধু বলল, ‘দেখুন আপনি হয়তো আমাকে ভুল বুঝছেন। ভেতরে আসুন।’

বাড়িতে ঢুকে কিছুক্ষন ঘাড় বাঁকা করে চারপাশ দেখল সোলায়মান। সুন্দর পুরাতন এন্টিক টাইপের বাড়ি। লাল রঙের ইট দিয়ে তৈরি। দেয়ালের দক্ষিণ অংশ আবার কিছু অর্কিড আর সবুজ উদ্ভিদ দিয়ে আচ্ছাদিত। বেশ বোঝা যায় মালিক সৌখিন মানুষ। ভাবতে ভাবতেই সোলায়মান ছেলেকে নিয়ে একটি ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে পুরনো আমলের এন্টিক খাট। ধবধবে সাদা বিছানার চাদরের উপর শুয়ে আছেন কঙ্কালসার এক বৃদ্ধা। বোঝা যায় মৃত্যু তার আসন্ন। বৃদ্ধার একটি হাত সাদা তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার করছে লতিফা। সোলায়মান আর ছেলেকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এখানে? আমাকেও  বিশ্বাস করতে পারলে না!’

অয়ন মাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। ঘরে গুমোট নিস্তব্ধতা নেমে এল। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙল শেতাঙ্গ যুবকটি। সে বলল, বৃদ্ধা ক্যানসারের রোগী এবং একেবারেই লাস্ট স্টেজে চলে গেছে।  লতিফা প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্যে এই বৃদ্ধার দেখভাল করে। মাসে ১০০০ ডলার। শেতাঙ্গ যুবকটি এরই মধ্যে লতিফার কাজের প্রশংসা করতে করতে সোলায়মানের জন্যে কফি আর অয়নের জন্যে চকলেট নিয়ে এলো । হঠাৎ ক্যানসারে আক্রান্ত বৃদ্ধার সঙ্গে চোখাচোখী হলো সোলায়মানের। বৃদ্ধা ইশারায় ডাকল। সোলায়মান খানিকটা ভয়ে, খানিকটা লজ্জায় বৃদ্ধার সামনে এসে দাঁড়াল। কী বলতে চায় এই মৃত্যুপথযাত্রী? সোলায়মানের বুক প্রচণ্ডরকম ভারি হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধা খুব স্নেহপূর্ণ চোখে সোলায়মানের দিকে তাকাল। তারপর মৃদ হেসে বলল, ‘আমার স্বামীও ঠিক তোমার মত সন্দেহবাতিক লোক ছিল। সে যে কী ভয়াবহ নরক যন্ত্রণা! এই সন্দেহের কারণে বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় আমাদের সুখের সংসার ভেঙ্গে গেল। তারপর শুরু হলো আমার এক অন্যরকম জীবন। সেই থেকে আমি আর বব এক সঙ্গে আছি। আমেরিকার বিশাল অট্টালিকার আড়ালে আমাদের ক্ষদ্র মানুষের জীবনের গল্পগুলো কত কঠিনভাবেই না ঢাকা পরে যায়। তারপরও আমরা বেঁচে থাকি। মানুষ বাঁচতে চায়। এই পৃথিবীতে বাঁচার জন্যে মানুষকে সৃষ্টিকর্তাই অনেক সাহস দিয়েছেন। এই যে দ্যাখো, বব আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। সে আমার ছেলে, আমার বন্ধু, আমার সব। বেশিদিন হয়তো বাঁচবো না। একটা কথা বলি- বাঁচার শখ আমার এখনো যায়নি। খুব ইচ্ছে করে বাঁচতে। ববটা যদি বিয়ে করতো। তার যদি ছেলেপুলে হতো। তাদের সঙ্গে যদি আমি খেলতে পারতাম! আমাকে গ্রান্ড মা বলে ডাকত- কত যে স্বপ্ন! যাক, যে কথা বলছিলাম। সন্দেহ একটা ভয়াবহ রোগ। অথচ জীবন কত সুন্দর! অথচ এই সুন্দরকে আমরা ক’জন আবিষ্কার করতে পারি? সুন্দরকে আমরা ক’জন ছুঁয়ে দেখতে পারি! যখন সময় চলে যায় তখন হায় হায় করি। জীবনে আমার কত আনন্দ, উচ্ছ্বাস, কত ভালোবাসা, কত স্মৃতি। এখন মনে হয় আহা! জীবনটাকে যদি আরেকবার পেতাম! কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। তাই বলছি- সন্দেহ করো না।  এজন্যে তুমি এবং তোমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কেউ সুখী হতে পারবে না। তোমার বউটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার ভেঁজা। সে নিশ্চয়ই অনেক কাঁদছে! তাকে দেখে  মনে হচ্ছে সে যেন কত বড় এক অপরাধ করে ফেলেছে! অথচ সে কিন্তু অপরাধ করেনি। তুমি বরং অপরাধ করেছ।তুমিই মেয়েটাকে মিথ্যে সন্দেহ করেছ। আমি বাঁচব না। কিন্তু তুমি আর তোমার বউ সন্তান আরো অনেক দিন বাঁচবে। আমি এই প্রার্থনা করি। তাই মৃত্যুপথযাত্রীর একটা কথা সবসময় মনে রাখবে- জীবন একটাই। এক জীবনেই তোমাকে সব পেতে হবে। জীবনের সুন্দরকে আবিষ্কার করো। সুন্দরকে দেখার মত চোখ বানাতে হবে। কী মনে থাকবে বুড়ির কথাগুলো!’

সোলায়মান লজ্জায় যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিল। মাথা উঁচু করে বৃদ্ধার দিকে তাকানোর মত সাহস সে খুঁজে পাচ্ছিল না। সে তখন ভাবছিল তার বঞ্চিত জীবনের কথা। কত অবহেলা আর অনাদরে নিজেকে, স্ত্রী-সন্তানকে কতভাবেই না সে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করেছে। হঠাৎ সে দেখতো পেলো এক ঝাক সোনামাখা রোদ জানালার গ্রীল ভেদ করে ঘরের মেঝের উপর আছড়ে পরছে। সেই রোদের দিকে তাকিয়ে সোলায়মান সেখানে জীবনকেই যেন দেখতে পেল। এইতো জীবন! এইতো সেই আলো! যে আলো আমি কতদিন খুঁজে পাইনি! নিজেকে সামলে নিয়ে লতিফার দিকে এগিয়ে গেল সোলায়মান।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়