ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হুমায়ূন আহমেদ: মধ্যবিত্তের মনের বাতিঅলা

উৎপল দত্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ১৩ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হুমায়ূন আহমেদ: মধ্যবিত্তের মনের বাতিঅলা

আজ বাতিঅলা নেই। একদিন ছিল। প্রায় পৌরাণিক ঢাকা শহরেই ছিল। সন্ধ্যা ঝুলছে, আর বাতিঅলা চিমনিতে আলো ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। বিজলিবাতি ছিল না। পুরোনো ঢাকা শহরের রাস্তায় থামের ওপর চিমনি আর বাতিঅলার গল্প অনেকের স্মৃতিতে আছে। ওই বাতির নকশা-কাঠামো এখন ঘষেমেজে ফিরে এসেছে লাইট হাউসে। যেহেতু অ্যান্টিক তাই।

হুমায়ূন আহমেদ অ্যান্টিক নন।খুব কাছেই তাঁর স্বর আজও শোনা যায়। মনে হতেই পারে, কয়েক মুহূর্ত আগে তিনি ইহলোক ছেড়েছেন, কয়েক বছর আগে নয়! এখনও বইমেলায় তার সরব উপস্থিতি বিস্ময় জাগায়। যেন পাশের স্টলেই বসে আছেন। অটোগ্রাফ দিচ্ছেন।

বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়েছে যে ছেলেটি, একটু ডাগর যে মেয়েটি, স্টলে যায় আর বলে- হুমায়ূন আহমেদের ওই বইটা আছে? একজন মা খোঁজেন, বাবা খোঁজেন যে বইটি সেটি হুমায়ূন আহমেদের। এই দৃশ্য হুমায়ূন আহমেদ প্রয়াত হওয়ার পর আজও চলমান। সংশয় হয়, একটি বই খোঁজে তারা, নাকি একটি মানুষকে? অমন পাগলপারা হয়ে কেউ বাংলা একাডেমির বই মেলায় বই খোঁজে না। বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে লেখক থাকেন। লেখকের বার্তা ও সংবেদ থাকে। কী সেই বার্তা আর অনুভব যা হাতে বা হৃদয়ে নিতে মানুষ এখনও উন্মুখ!

বাঙালির আবেগ আছে। এই পলল ব-দ্বীপ ডেল্টা নামে পরিচিত। পলিমাটির ভূমি, মনসুন বা মৌসুমী বৃষ্টির প্রাবল্য, শ্রাবণের ঝরঝর যে আবেগের জন্ম দেয় তা ঊষড় মরুর মতো নয়। এই আবেগের চরিত্রলক্ষণ ভিন্ন। আবেগের অভিক্ষেপ বাঙালির মন ও জীবনে বেশি পড়ে। হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে বাঙালির টানাপোড়েনের জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক মুক্তি তার আজও ঘটেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। দু’টি উপনিবেশের সাথে সে যুদ্ধ করেছে, কিছুই পায়নি। মধ্যবিত্ত, নিন্মমধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেই সংস্কৃতিচর্চা দেখা যায়। তারা বই পড়ে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে, মননশীল হতে চায়। অর্থনৈতিক কাঠামোটি নড়বড়ে হলেও, সামাজিক অবকাঠামোয় নিজের উপস্থিতি ও পরিচিতি তাকে তুলে ধরতে হয়। তাও আরেক যুদ্ধ।

সংস্কৃতির প্রশ্নে মূলত এ দেশ লোকায়ত সংস্কৃতির দেশ। সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে যে রিকশাচালক অথবা কৃষক বাড়ি ফেরে সে পালাগান শুনতে ভালোবাসে। লালন, হাসন রাজা, লোকগাঁথা দিয়ে দিনের ক্লান্তি ধুয়ে নেয়। মনোজগতে মুক্তির জায়গাটি খুঁজে নেয় সে তারই লোকায়ত উপাদান থেকে। মধ্যবিত্তের ঘরে-মনে বাস করে রবীন্দ্রনাথ, লোকসম্পদও।

দোদুল্যমানতা মধ্যবিত্তের অন্যতম চরিত্রলক্ষণ। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তাকে সংস্কৃতি ও শ্রেয়োবোধ লালন করতে হয়। অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাকে নিজের সামাজিক অবস্থান তৈরি করতে হয়। কখনও হতে পারে তা লোক-দেখানো। এই ‘লোক-দেখানো’ বিষয়টিও তার ইচ্ছাকৃত নয়। ব্যক্তিমানুষ সমাজে তার অবস্থান ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে চায় তার অস্তিত্ব সুরক্ষার প্রয়োজনে। সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়। প্রতিদিন নিজের ঘরে, নিজের অন্তরে ক্লান্তি ও অবসাদের অভিঘাত সে অনুভব করে। অথচ তা থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। বিষণ্নতায় বিকৃত হয়ে গেলেও সে তা চেপে রাখে, গোপন করে। না হলে অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে। প্রতিদিনের অবসন্ন অন্ধকারে সে আলোর অপেক্ষা করে তবু সে আলো জ্বালতে পারে না। মনোজগতে একটি প্রদীপ, যদি কেউ জ্বেলে যায়!

সমাজকাঠামোয় বিরাজিত মধ্যবিত্তের এই মনোজাগতিক অন্ধকারটি হুমাযূন আহমেদ দেখেছিলেন। বারবার তিনি প্রায় প্রতিটি গল্পে, উপন্যাসে জাদুর মোমবাতি হাতে নিয়ে এসেছেন।

পাঠক অনেককাল পর এমন একজন লেখক পান যার হাতে ওই শিখাটি আছে যা অপরিমেয় অবসাদ, শ্রান্তি ও ক্লান্তির মধ্যে আলো ছড়ায়। আপাত সরল ভাষার আড়ালে জীবনমুখীনতা ও ক্লান্তি ধুয়ে ফেলার ‘মেসেজ’ বা সংবাদটি থাকে। মধ্যবিত্ত পাঠক এর জন্যই অপেক্ষা করছিল এদেশে, এতোকাল।

হুমায়ূন আহমেদ আগল খোলা মাত্র পাঠক লুফে নেয় তাকে। তার লেখায় সে নিজেকে দেখে, পরিপার্শ্ব দেখে, পরিজন দেখে। দুঃখ বিষাদ দেখে, অতঃপর দেখে মুক্তির আলোর তীব্রতা। তীব্র অথচ প্রচ্ছন্ন সে আলো। পাঠকের অবচেতন মন তাকে উসকে দেয় হুমায়ূন আহমেদ পাঠ করতে। এ কারণেই তিনি এতোটা পাঠকপ্রিয়।

হুমায়ূন আহমেদ যতোটা পপুলার ততোটা সিরিয়াস লেখক নন। এ রকম কেচ্ছা-কাহিনি সাহিত্যের মূল প্রবাহে যারা, তাদের মুখে কখনও সরবে কখনও ইঙ্গিত-ইশারায় এসেছে। হুমায়ূন আহমেদ ‘বেস্ট সেলার’ এবং ‘পপুলার’ ছিলেন, তা সবাই জানেন। ‘বেস্ট সেলার’ ও ‘পপুলার রাইটার’ শব্দটি সাম্প্রতিক কালে আমাদের সাহিত্যে ও পাঠকের মনে এসেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এসেছে। যেহেতু তথ্য অবাধ, তার প্রবাহ অনিয়ন্ত্রিত। পশ্চিমে অথবা বিশ্বের অন্য অঞ্চলে কথাগুলি আগেই প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত। মূলধারার সাহিত্যের সাথে তারা বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেনি। বেস্টসেলার বা পপুলার রাইটার হলেই তা মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তা নয়। বিষয়টি মনোভঙ্গীর। এই মনোভঙ্গী রচিত হতে সময় লাগে। নতুন উপাদান শিল্প-সাহিত্য এবং জীবনে যুক্ত হলেই তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সুনির্দিষ্ট পরিচয় দেয়া যায় না। অভ্যস্ত হতে হয়। সময় লাগে। না হলে দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তির সুযোগ থেকে যায়।

সাহিত্যপত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন বলে যা স্বীকৃত তা মূলধারার সাহিত্যকর্মের সাথে যায় না। তা নিয়ে বিরোধ হয়নি। কারণ লিটল ম্যগাজিনের ভাষাটি বাঙালির পরিচিতি ও চর্চার মধ্যে রয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন থেকেই উঠে এসেছে শক্তিশালী লেখক যারা মূলধারার গতিপথ বদলে দিয়েছেন। মূলধারা বিষয়টিও আপেক্ষিক। সময়ের পরিবর্তনে তা বদলে যায়। ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার সাহিত্যচর্চায় কী বৈশিষ্ট্য রেখেছেন, তা আগামী দিন নির্ধারণ করবে, একথাও অনেক স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের মুখে শোনা যায়।

এরকম কথা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও শোনা গেছে। অথচ স্বাদ ও ব্যঞ্জনায় তার বহুবিস্তারি গদ্য বিশ শতকের মধ্যবিত্তদের মন উজিয়ে রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথের সময়ে স্থিত থেকেও তার সাহিত্য ভিন্ন ধারায় প্রবহমান, ভিন্নতর তার ভাষাভঙ্গী। সমসাময়িক পারিবারিক জীবনের মিঠেকড়া বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-অভিঘাত আর সমাজের সাথে ব্যক্তির আচরণের বহুমুখী প্রকাশ তার লেখাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল, যা অনন্য। বলা হতো, বাঙালি যদি একটি উপন্যাসের নাম মনে রাখে তবে তা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, আর বাঙালি যদি একটি উপন্যাসও পড়ে থাকে তবে তা শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’। ‘পপুলার’ কথাটি তখনও আসেনি। আর আবেগের বাহুল্য আছে বলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুকাল ‘দেবাদাস’ এর পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রেখেছিলেন, প্রকাশকের হাতে দেননি।

কোনো এক বৈঠকি আড্ডায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হুমায়ূন আহমেদকে বলেছিলেন, তুমি তো জনপ্রিয়তা আর লেখার প্রাচুর্য্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও ছাড়িয়ে গেছ। এই কথায় ভালোবাসা আর স্বীকৃতি খুঁজে পাওয়া যায়, অভিযোগ বা বিরোধ নয়।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিশাল আয়তনের উপন্যাস ও ছোটগল্প পাশে সরিয়ে যদি ‘মহেষ’ গল্পকেই বেছে নেয়া যায়, তাহলে তার সাহিত্যমূল্য, সমাজবীক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, এমন সাহিত্যসমালোচক হয়তো নেই। ‘নন্দিত নরকে’ বা ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর ক্ষেত্রেও তাই।

পাঠকপ্রিয়তা সাহিত্যের শিল্পগুণ বিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়। একথা প্রচলিত। দ্বিমত করার অবকাশও নেই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের অবর্তমানে সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে তা এখনও সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। একই সাথে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন ও সাহ্যিত্যের মৌলিক ভিত্তিকে সংরক্ষণ করার কাজটি সহজসাধ্য নয়। দুরুহ কাজটি হুমায়ূন আহমেদ করেছেন। লেখা যদি পাঠক হাতে তুলে না নেয়, তবে লেখা এক অর্থে যৌক্তিকতা হারায়। একটি গল্প বা উপন্যাস কেউ কোনদিন ছুঁয়েও দেখল না, এরকম হলে লেখক তার গতিপথ পরিবর্তনের কথাই চিন্তা করবেন। সম্পূর্ণ পাঠকপ্রিয়তা না পেলেও তার নিজস্ব একটি পাঠক শ্রেণী তৈরি করে নিতে অগ্রসর হবেন। সৃজনশীলতার  মূল মানদণ্ডে থেকেই হয়তো তিনি তা করবেন। হুমায়ূন আহমেদের যাত্রাপথকে চিহ্নিত করতে গেলে এইসব প্রসঙ্গ অনিবার্য ভাবেই উঠে আসে।

পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেননি, তার চেষ্টাও করেননি, এমন লেখকও আছেন। সবারই তা জানা কথা। কমলকুমার মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী বা জগদীশ গুপ্ত। কমলকুমার মজুমদারকে বলা হয় লেখকদের লেখক। আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ উঠে আসে। কমলকুমার মজুদারকে নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তাকে পড়ছি, পড়ে যাচ্ছি, যতোদিন বেঁচে আছি হয়তো পড়েই যাব। কমলকুমার মজুমদারের অনেক লেখার সিন্ট্যাক্স বা বাক্যগঠনই অন্যরকম। প্রচলিত রীতির বাইরে। সাধুভাষা যখন সাহিত্য থেকে উঠে গেছে, তখন সাধুভাষাকেই তিনি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করলেন। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ বা ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’ স্বাদগন্ধহীন মনে হতে পারে, কিন্তু জীবন ও সমাজবাস্তবতার প্রশ্নে তা তুলনারহিত। সোমেন চন্দের প্রসঙ্গটি আরও গুরুত্বপূর্ণ অন্তত হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে। সোমেন চন্দের ‘ইঁদুর’ গল্প পাঠের অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছেন। লেখালেখিতে প্রণোদিত এবং উৎসাহী হওয়ার কথা প্রসঙ্গে তিনি সোমেন চন্দের প্রসঙ্গ এনেছেন। গল্পটি তাঁকে লিখতে তাড়িত করে। কথাটি হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একটি গ্রন্থ সোমেন চন্দকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন। অথচ সোমেন চন্দ, সতীনাথ ভাদুড়ীর মতো করে তিনি লেখেননি। কেন লেখেননি, তার ব্যাখ্যা একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি দিতে পারতেন। ব্যাপক অর্থে মধ্যবিত্ত পাঠকের কাছে সাহিত্যকর্মকে নিয়ে যাওয়া তাঁর লক্ষ্য হতেই পারে। হয়েছিল তা। আশির দশকে প্রায় পাঠ-বিমুখ মধ্যবিত্তকে বইয়ের মুখে টানতে পেরেছিলেন তিনি। গল্প, কাহিনিসূত্র ও ভাষার বিচারে তা লঘু না গুরু, এই সমাজবাস্তবতায় তার হিসেব কষা গৌণ। তার গল্প-সাহিত্য-উপন্যাসে জীবন আছে। জীবনমুখীনতার কথা আছে তা সে যে আঙ্গিকেই হোক। প্রাণস্পন্দন না পেলে পাঠক তাঁর গ্রন্থ হাতে তুলে নিতো না। এখানে পাঠকপ্রিয়তা, পপুলার রাইটার, লঘু-গুরু, মূলধারা একসাথে জমায়েত হয়। অথচ কোন মনস্তত্ত্ব চাঁদের জোয়ারের মতো একটি বড় পাঠকসমাজকে হুমায়ূন আহমেদের দিকে টেনে নিয়ে গেছে তা অধরা থেকে যায়।

রূপকথা পড়ার সময় বাস্তবতা ও তার আনুষাঙ্গিক উপাদান উপেক্ষা করা হয়। লেজেন্ড-আশ্রিত সাহিত্য, পূরাণ পাঠের সময়ও পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা থাকে। প্রচলিত সাহিত্য পড়ার সময় চলমান বাস্তবতা, ও প্রথাগত চরিত্র মাথায় রেখে পড়লে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। অথচ ‘হিমু’ চরিত্র হোঁচট বা দ্বন্দ্ব এড়িয়ে পাঠকের মনে শেকড় ছড়ায়। কেন ছড়ায় তার কারণ খুঁজে বের করাই জরুরি। হিমুর বোহেমিয়ান জীবন, কটকটে হলুদ শার্ট, ঔদাসীন্য ও জটিলতা মুক্ত চরিত্রটি পাঠক তুমুল আদরে-সোহাগে গ্রহণ করে। হিমু কতোটা বোহেমিয়ান, কতোটা লেখকের মনের প্রক্ষেপ তা বিবেচনায় নেয়া গুরত্বপূর্ণ। বাস্তব জীবনে পাঠকের আচরণের ক্ষেত্রেও হিমুর আচরণের প্রতিফলন দেখা যায়। অনেকেই নিজেকে একজন হিমু মনে করতে শুরু করে। কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে দুপুরের রোদে বাইরে বের হয়। আসলে হিমু চরিত্রকে তারা এই সময়ের বাস্তবতায় রূপকথার চরিত্রের মতো গ্রহণ করে। অনাকাঙ্খিত মানসিক তরঙ্গ থেকে মুক্ত হতে চায়। শুধু তাই নয়, হিমু সিরিজের একটি গ্রন্থের উৎসর্গে লেখক নিজেই যখন তার আত্মজকে হিমু বলে চিহ্নিত করেন, তখন তার মানসলোক নিয়ে ভাবনায় পড়তে হয়। ‘হিমু রিমান্ডে’- উৎসর্গের ভাষাটি এরকম:

জগতের সর্বকনিষ্ঠ হিমু
নিষাদ হুমায়ূন-কে

হাঁটি হাঁটি পা পা
(হিমুর মতো)
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা।

আর গ্রন্থের কন্টেন্ট বা কাহিনি বিস্তারের আগে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার উদ্ধৃতি চমক সৃষ্টি করে।

I have looked down the saddest city lane
I have passed by the watchman on his beat
And dropped my eyes, Unwilling to explain.

Proclaimed the time was nither wrong nor right
I have been one acquainted with the night.
- Robert Frost

উদ্ধৃত লাইনগুলি তিনি নির্বাচন করেছেন রবার্ট ফ্রস্টের ‘Acquainted with the Night’ কবিতা থেকে। হিমুকে ব্যাখ্যা করার জন্য তা মোক্ষম।

‘নগরের অবসন্ন গলি দেখিনা তো
চলমান প্রহরিকে পিছে ফেলে যাই 
নমিত চোখে আমি না বলেই যাই

মনে রাখা অর্থহীন রাতের প্রহর
জেনেছি আমি এই রাতের সহচর।’

বাঙালি মধ্যবিত্তের মনোজগত পড়তে পেরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। মধ্যবিত্ত বাঙালি অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি। বিত্তহীন মধ্যবিত্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকেছে। পরবর্তী প্রজন্ম অসচ্ছলতা আর আদর্শকে একই সাথে বহন করেছে। এই দ্বৈরথ তার মনে জন্ম দিয়েছে গ্লানি, ক্লান্তি, অবসাদ। মানুষের মুক্তি নিয়ে অনেক সারগর্ভ সাহিত্য তারা পড়েছে। পরিবর্তনের আকাঙ্খা ও শ্রেয়োবোধ লালন করেছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ সাহিত্যও তারা পড়েছে। তারপরও তাদের মনের গভীরের ক্লান্তি ধুয়ে যায়নি। ব্যক্তিগত আবেগ ও শূন্যতার জায়গা অপূরণীয় রেখেই সমাজের বৃহত্তর কাঠামোয় এসে যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরেছে তারা। দিনান্তে অবসাদ নিয়েই ঘুমাতে গেছে।

হুমায়ূন আহমেদ এক ভোরবেলা সপাটে দরোজা খোলেন। ব্যক্তিমনের অনড় পাথরের চাঁই সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। বহুবছরের বিষাদ দূর করার ভাষা, করণকৌশল, মনস্তত্ত্ব মাথায় রেখে তিনি তার কাহিনি বিস্তার করেন। চরিত্রকে সেই আদলেই নির্মাণ করেন যা আহত, পরাজিত ব্যক্তিমনকে আলোর উদ্ভাস দেয়। সরল ভাষায় তিনি লিখেছেন যাতে সব স্তরের পাঠকের কাছে তা সহজেই দৃশ্যমান ও বোধগম্য হয়। গলদঘর্ম হতে হয় না।

শুধু তাঁর বই নয়, অবচেতন মনে পাঠক হুমায়ূন আহমেদকেই খোঁজে। তারা মনের বিরোধ ও দ্বন্দ্ব মোচনের বাতিঅলাকে খোঁজে। হুমায়ূন আহমেদ সেই বাতিঅলা।

‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;

[আট বছর আগের এক দিন, জীবনানন্দ দাশ]

 

জীবন-সন্নিহিত কবিতায় জীবনানন্দ দাশ এই ক্লান্তির কথা অনেক আগেই বলেছেন। অন্তর্গত আক্ষেপ মধ্যবিত্ত বাঙালির মনোজগতে উপনিবেশ রচনা করে আছে বহুযুগ ধরেই। রাজনৈতিক চরিত্র পাল্টায়, শাসক শ্রেণীর রূপ বদলায়। সমাজ বদলায়। অথচ সমাজ আঁকড়ে থাকা মানুষ, সমাজে বিরাজিত উপাদানের সাথে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। তাতে অসহায়ত্ব বেড়ে যায়। মুখে উচ্চারণও করতে পারে না। সমাজ-আশ্রিত হয়েই তাকে থাকতে হয়। মনোজগতে শূন্যতা ব্যক্তিমনে আরও ঘনিয়ে ওঠে।

সব আছে, অথচ কী নেই, এই অনুভূতি ছোবলের মতো। বিষ রক্তে মিশে যায়। কাহিনিতে ওই পরিপ্রেক্ষিত হুমায়ূন আহমেদ আগে রচনা করেন। অন্তর্গত অন্ধকার প্রথমে চিহ্নিত করেন। তারপর আলো ফেলেন। একটি শুভবোধ জেগে ওঠে। সেখানে করুণার জল ঢেলে দেন লেখক- ‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়’।

মানুষ মুক্তির স্বাদ-গন্ধ পায়। রাষ্ট্র-সমাজ বিশ্লেষণে যে স্খলিত, দগ্ধ মন ধরা পড়ে না সেই স্খলন ও হৃদয়ের তাপন মধ্যবিত্ত মন খুঁজে পায় তার সাহিত্যকর্মে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর রচনায় এ রকম অনেক কবিতার পঙ্‌ক্তি ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহার করেছেন। ‘আজ জ্যোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’, রবীন্দ্রনাথের পরিচিত গীতিকবিতার লাইন বারবার ফিরে এসেছে তাঁর গদ্যে। গল্প, উপন্যাস এমনকি চিত্রনাট্যেও এসেছে।

সোনার কাঠি পাশে রেখেই তিনি লিখেছেন। জীবন জাগিয়ে রাখার আকাঙ্খা ঝড়ের মতোই তাঁর মনে দাপাদাপি করতো। নিজের মনের দাপাদাপি নিরূদ্ধ করে মানুষের মনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মুক্তি সেখানেই। একই সঙ্গে লেখকের নিজের মুক্তি, মধ্যবিত্তের মনের মুক্তি। পাঠককে মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি আর্তি ও নিজস্ব অনুভবে তাড়িত লেখক নিজেও মুক্ত হন। তার কল্পজগতের অনেক বিষয়ই বাস্তবে আচরিত হতে দেখা যায়। নুহাশপল্লী তাঁর কল্পনার বাস্থব অভিক্ষেপ। আর সেখানেই তিনি সমাহিত।

ভাষা, কাহিনিসূত্র, কনভেনশনাল (চিরাচরিত অর্থে) সাহিত্যমূল্য তখন আক্ষরিক অর্থেই পেছনে পড়ে যায়। মানুষের অন্তর্গত এবং অনাবিষ্কৃত অন্তর্দহন বিলোপের প্রশ্নে একজন বাতিঅলাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তার সাহিত্যকর্ম ও নির্মিত চরিত্র অতিক্রম করে তিনি নিজেই একক ও প্রধান চরিত্র হয়ে যান।

হুমায়ূন আহমেদ সেই বাতিঅলা।

 

হুমায়ূন আহমেদকে নয়ে পড়ুন আরো কয়েকটি রচনা:


 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়