ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রকাশক কম সময়ে অনেক প্রচ্ছদ আশা করেন

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রকাশক কম সময়ে অনেক প্রচ্ছদ আশা করেন

চিত্রশিল্পী, প্রচ্ছদ আঁকিয়ে, টাইপোগ্রাফার- অনেক পরিচয়ে পরিচিত তিনি। সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ‘মুজিব শতবর্ষ’র লোগো তৈরি করে প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলা ফন্ট, বইয়ের প্রচ্ছদ, এ সময়ের চিত্রকলা সম্পর্কে তার ভাবনা জানতে অনার্য মুর্শিদ মুখোমুখী হয়েছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরার।   

অনার্য মুর্শিদ: আপনার লেখা ‘রংতুলিতে ছোপছাপ’ এবং ‘চিত্রলিপি’তে ব্যবহৃত পুরনো ব্লকের ফন্ট ‌মুজিব শতবর্ষের লোগোতেও দেখতে পাচ্ছি। শতবর্ষের ব্যাপার থাকাতেই কি পুরনো ফন্টে যাওয়া, নাকি এই ফন্টের প্রতি আলাদা কোনো দুর্বলতা রয়েছে?

সব্যসাচী হাজরা: ঠিক দুর্বলতা নয়। মুজিবের গাম্ভীর্যের সঙ্গে অন্য কোনো ফন্ট যাচ্ছিল না। তাই ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালে পত্রিকায় ব্যবহৃত ব্লকের ফন্ট ব্যবহার করেছি। ওই সময়ের পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম আমরা ব্লকে দেখেই অভ্যস্ত। যেমন ধরুন: ‘মুজিব কারাগারে’ অথবা ‘মুজিবের মুক্তি’। ফলে আমিও ব্লক ব্যবহার করেছি। আর আমার বই-এ এই ব্লক ব্যবহারের কারণ হলো বিদ্যাসাগরের অক্ষর। বিদ্যাসাগরের প্রমিত অক্ষর বোল্ড ভার্সনে নিলে আমার এই ফন্ট তৈরি হয়। বইটি যখন লিখছিলাম তখন ফন্ট তৈরি করা, যে কারণে বই-এ ব্যবহার করেছি। তবে আমি মনে করি, বই-এ ফন্টটি যতটা না প্রাসঙ্গিক মুজিব শতবর্ষের লোগোতে তার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।

অনার্য মুর্শিদ: এই ফন্টের কি কোনো নাম দিয়েছেন?

সব্যসাচী হাজরা: একাত্তর ফন্ট। যদিও নামটি এখনো ফিক্সড না।

অনার্য মুর্শিদ: এই ফন্ট অথবা আপনার আরো কিছু ফন্ট কি কম্পিউটারে ব্যবহারের উপোযোগী করা যায়?

সব্যসাচী হাজরা: সেই চেষ্টা চলছে। তবে এটা শ্রমসাধ্য কাজ। একটা ফন্টের জন্য প্রায় দুইশ যুক্তবর্ণের কাজ করতে হয়। আমি তিনটি ফন্ট নিয়ে চিন্তা করছি এ মুহূর্তে। একটা ‘হরফ একাত্তর’ যেটা লেটারিং ফন্ট- মুজিব শতবর্ষে ব্যবহার করেছি। আরেকটা টাইপ মেশিনের ফন্ট ‘ছাপাই হরফ’। আরো একটা করছি আমার হাতের লেখা নিয়ে। এখনো নাম দিইনি।

অনার্য মুর্শিদ: এই সময়ে টাইপোগ্রাফির চর্চা কেমন হচ্ছে বলে মনে করেন?

সব্যসাচী হাজরা: কই হচ্ছে! টাইপোগ্রাফি হলে তো আরো কিছু ফন্ট আমরা পেতাম। আপনি দেখেন ইংরেজিতে যত ফন্ট আছে বাংলায় ব্যবহারযোগ্য তার সিকিভাগ ফন্টও নেই। টাইপোগ্রাফি এবং ফন্টের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। কাইয়ুম চৌধুরী তো অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। সেই টাইপোগ্রাফিগুলোও আমরা বাঁচিয়ে রাখছি না। এজন্য প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

অনার্য মুর্শিদ: এই সময়ের চিত্রকলা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

সব্যসাচী হাজরা: এই মন্তব্য এখনি করা মুশকিল। কারণ এটা বোঝা যাবে আরো বিশ বছর পর। কিন্তু আমি যেটা দেখছি- তরুণদের চিত্রকলায় যথেষ্ট বৈচিত্র আসছে। এর কারণ তারা এখন মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের অন্য প্রান্তের চিত্রকলা দেখতে পাচ্ছে।

অনার্য মুর্শিদ: এতে কি আমাদের চিত্রকলা বিশ্বের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে? যদি এগিয়েই যায় তাহলে চিত্রকলা নিয়ে শিল্পরসিকরা হতাশ কেন?

সব্যসাচী হাজরা: এগিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাও এখন বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা বলা যাচ্ছে বাইরের দেশকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের সমকালীন চিত্রকলা ঐতিহ্য হারাচ্ছে। শিল্পরসিকদের হতাশ হবার কারণ হলো, চারুকলায় হাতের কাজের চেয়ে মাথার কাজটা কম হচ্ছে। কিন্তু আমি দেখেছি, দেশের যে কোনো সংকটে চারুকলার শিক্ষার্থীরা দূরে সরে যায় না। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এরচেয়ে আর কি আশা করতে পারি আমরা?

অনার্য মুর্শিদ: প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে আপনার পূর্বপ্রস্তুতি ছিল কিনা?

সব্যসাচী হাজরা: আমি আমার পেশা এবং শখ দুটো জিনিস আলাদা করতে চেয়েছিলাম। যে কারণে আমার চিত্রশিল্পগুলো আমি শখের স্থানেই রেখেছি। আবার গ্রাফিকাল আর্টস ওয়ার্ককে পেশা হিসেবে নিয়েছি। তারই একটি মাধ্যম বুক কাভার। সাহিত্যে আমার আগ্রহ ছিল অর্থাৎ সাহিত্য পড়া। সেই আগ্রহের জায়গাটিও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

অনার্য মুর্শিদ: প্রচ্ছদ আঁকার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য দেন?

সব্যসাচী হাজরা: বইয়ের বিষয় অনুযায়ী কাজটি কতটা বাস্তবসম্মত হলো এটা আমার কাছে প্রাধান্য পায়। পাণ্ডুলিপি না পড়ে আমি কখনও প্রচ্ছদ আঁকি না। এবং সেখানে আমার পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পায়। পাণ্ডুলিপি পড়তে হয় কারণ লেখকের ভাবনাকে বুঝতে পারার চেষ্টা। এবং সেই ভাবনার সঙ্গে নিজের ভাবনার প্রকাশই হলো কভার ডিজাইন।

অনার্য মুর্শিদ: প্রযুক্তির কল্যাণে প্রচ্ছদ শিল্পে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। ফটোগ্রাফি দিয়েই এখন নান্দনিক প্রচ্ছদ হয়ে যাচ্ছে...

সব্যসাচী হাজরা: প্রযুক্তি আসবে। থামানো যাবে না। আমাদের অগ্রজ কাইয়ুম চৌধুরী প্রচ্ছদ এঁকেছেন। তিনিও হাতে এঁকেছেন, আবার কম্পিউটারের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু বাংলাবাজারে যা হচ্ছে- প্রকাশক কম সময়ে অনেক প্রচ্ছদ আশা করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’তে কেউ যদি ইন্টারনেট থেকে একটা চোখ নামিয়ে তার উপর একটু বালি ছিটিয়ে দেয় তাহলেই কি প্রচ্ছদ হয়ে যাবে? কিন্তু এখন তাই হচ্ছে!

অনার্য মুর্শিদ: প্রযুক্তিনির্ভর কাজে সাময়িক ফল হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু বেশিদূর তো যাওয়া যায় না!  
সব্যসাচী হাজরা: ঠিক বলেছেন! সবচেয়ে বড় যে দিক, তা হলো- আমরা আমাদের প্রচ্ছদের ঐতিহ্য হারাচ্ছি। আপনি আগের বইগুলো দেখুন। তারও আগের বইগুলোর প্রচ্ছদ দেখুন- প্রচ্ছদশিল্পের যে ধারাবাহিক ঐতিহ্য, সেটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। বাংলা বর্ণমালা না-জানা মানুষটিও পৃথিবীর যেকেনো প্রান্ত থেকে দেখে বুঝত- এটা বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ। এখন অধিকসংখ্যক ডেলিভারি দিতে গিয়ে প্রথমেই আমরা গুগলে যাই, ফ্রি ইমেজ খুঁজি। টেক্সটের সঙ্গে কোনো রকম ম্যাচ হলেই হলো।  এতে শুধু ঐতিহ্যই হারায় না, প্রচ্ছদের মানও পড়ে যায়।

অনার্য মুর্শিদ: এবার মেলায় কতোগুলো প্রচ্ছদ করেছেন?
সব্যসাচী হাজরা: ৫০টার মতো হবে। 

অনার্য মুর্শিদ: যতটুকু জানি, আপনি এত প্রচ্ছদ করেন না!
সব্যসাচী হাজরা: এত প্রচ্ছদ করার পথটা আসলে প্রকাশকরাই তৈরি করেছেন। আমাদের প্রকাশকরা অতীতের চেয়ে যথেষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে এসেছেন। আগে প্রচ্ছদের তোড়জোড় শুরু হতো অক্টোবর-নভেম্বর থেকে। এখন মার্চ-এপ্রিল থেকেই কাজ শুরু হয়ে যায়। শেষ দিকে হলেও কাজ যে করি না তা নয়। যদি কাজটা সেরকম সিগনেফিকেন্ট হয়। যেমন কদিন আগে ইউপিএল-এর একটা কাজ করেছি। ‘ব্লাকটেলিগ্রাম’ নামে একটি বই। বইটি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ তাই হাতছাড়া করিনি। এরকম বইয়ে একটা স্বাক্ষর থাকাও সৌভাগ্যের। 
 

অনার্য মুর্শিদ: ফিল্মমেকারদের ভাষ্য- চলচ্চিত্রে চারুকলার শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত। চারুকলার শিক্ষার্থীদের ভাষ্য- সে পরিমাণ কাজ নেই। সংকটটা আসলে কোথায়?

সব্যসাচী হাজরা: আসলে ইন্ডাস্ট্রি এখনো ভালোমতো তৈরি হয়নি। আমার মনে হচ্ছে চলচ্চিত্রে আর্ট ডিরেকশন বুঝতে আমাদের আরো দু’এক প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে।

অনার্য মুর্শিদ: একজন শিল্পীর নির্দিষ্ট কোনো রঙের প্রতি দুর্বলতা থাকা উচিত কিনা? আপনার কি মনে হয়?

সব্যসাচী হাজরা: আমি মনে করি, রঙের দর্শন এবং প্রয়োজনীয়তার প্রতি শিল্পীকে মনোযোগী হতে হবে। আমার প্রিয় রং লাল এবং কালো। কিন্তু ব্যবহারের আগে অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা বিচার করি।

অনার্য মুর্শিদ: আপনি শিশুদের আঁকার জন্য বই লিখেছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্ন- আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে আঁকা শেখানো হয়, সেটা আপনার কাছে কেমন মনে হয়?

সব্যসাচী হাজরা: আমি একদমই শিশুদের শেখানোর পক্ষে না। আমি মনে করি শিশুদের কাছ থেকে শেখা উচিত। তার আবিষ্কার আমাদের দেখা উচিত। শেখালে তো আরেকটা সব্যসাচী তৈরি হবে। আমি তো আমার মেয়েকে সব্যসাচী বানাতে চাই না।

অনার্য মুর্শিদ: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাক্ষর’ থাকার পরও আপনি কেনো ‘চিত্রলিপি’ করেছেন?

সব্যসাচী হাজরা: সময় বদলেছে। সমসাময়িক বিষয় যোগ করার জন্যই ‘চিত্রলিপি’। ছোটবেলা আমি কিছু অক্ষর মনে রাখতে পারতাম না। এর কারণ সব অক্ষরের ছবি আমার পরিপার্শ্বে ছিল না। আমার এই বইতে আপনি শিঙ মাছ পাবেন, বিভিন্ন ধরনের মুখ পাবেন, সমকালীন অনেক বস্তুর ছবি পাবেন, যেগুলো অবনঠাকুরের যুগে ছিল না। তাই সেগুলো ‘চিত্রাক্ষর’-এ আসেনি। আমার যুগের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে, তাই আমি নতুন করে ‘চিত্রলিপি’ করেছি।

অনার্য মুর্শিদ: আপনার বইগুলো বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার মতো। কিন্তু অনেকেরই অভিযোগ- বইগুলোর দাম অনেক বেশি। 

সব্যসাচী হাজরা: আমার বাবা-কাকারা কম যত্নে প্রকাশ করা বইগুলো পড়েছেন। আমরাও তাই পড়েছি। তাই শেখার সময়ে এত যত্ন পাইনি। কিন্তু আমার সন্তানের হাতে তো আমি ম্যাড়ম্যাড়ে কাগজে ছাপা বর্ণমালার বই তুলে দিতে পারি না। কারণ এটা তার প্রথম বই। আমি মনে করি, শিশুদের বইয়ের প্রকাশনার মান আরো ভালো করা দরকার। মেলায় শিশু কর্নারের বইগুলো দেখে মনে হয়- এখন প্রকাশকরা শিশুতোষ বইয়ে খরচ করতে চান। তারা গুরুত্বটা বুঝতে পারছেন। এখন দরকার ভালো লেখা, ভালো আঁকা।

অনার্য মুর্শিদ:  শিশুসাহিত্যে ভূত, অলীক, অবাস্তব ফ্যান্টাসি এগুলো কি থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন।  
সব্যসাচী হাজরা:  থাকতে পারে। রূপকথা শিশুদের মধ্যে কল্পনা তৈরি করে। আমি মনে করি, অলীক কল্পনাও থাকতে পারে, যদি সেখানে ক্ষতিকর কিছু না থাকে। তবে শিশুদের জন্য সতর্ক হয়ে লেখা উচিত।




ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়