ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছবিকরের অনুধ্যান

কামালুদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৬, ১৬ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ছবিকরের অনুধ্যান

করোনা-১, মাধ্যম: এক্রেলিক অন ক্যানভাস

আমাদের ধারণা পৃথিবী আমাদের ওপর বিমুখ হয়েছে। মূলত তা নয়। আমরাই পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছি কঠিন পরিস্থিতির দিকে। মানুষ নামক কিছু অর্বাচীনের অবিমৃষ্যকারীতায় জর্জর পৃথিবী আজ ম্লান। আমরাই অকৃতজ্ঞের মতো পৃথিবীর গায়ের ছাল-চামড়া উঠিয়ে নিয়ে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত, রোগাক্রান্ত করেছি। পৃথিবীর শরীর আজ নিশ্চল ও নিষ্প্রভ।  পৃথিবী একটু সময় চেয়ে নিয়েছে নিজের শরীর সারিয়ে তুলবার জন্য। একটু যেন দম নিচ্ছে; আত্মশুশ্রূষায় মগ্ন হয়ে উঠেছে পৃথিবী।

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে গেলে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে হবে। ধরাকে সরা জ্ঞান করলে এরকম করোনার মতো মহামারি বা মহাদুর্যোগ হানা দেবে বারবার। করোনার মতো মহামারির এই কালে, বলা যায় তুমুল উদ্যত পরিস্থিতিতে শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের তুলির মাথায় জড়ো হয়েছে সেই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের অপরিহার্যতা। ক্যানভাসে উঠে এসেছে নানারকম পশু-পাখি। যদিও শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের জীবজগতের প্রতি অনুধ্যান শুধু এই করোনাকালেই নয়, অনেকদিন আগে থেকেই। মূলত এই বিশ্ববাস্তুতন্ত্রের যে নিয়ামক পথ, সেই পথের পরিব্রাজক এই শিল্পী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্রষ্টার সৃষ্টিকে আঘাত করলে পরিণাম কী হতে পারে। শিল্পীরা বরাবরই সত্যান্বেষী, প্রতিটি জিনিসের গুরুত্ব বোঝেন। সেই গুরুত্বের কথা প্রকাশ করেন তাঁদের শিল্পকর্মে। এই করোনাকালে হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকেই শিল্পী নিজেকে একা খুঁজে পেয়ে তুলিতে জড়ো হওয়া পশুপাখিগুলোকে আশ্রয় দিয়েছেন ক্যানভাসে।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলেছিলেন, ‘অনেকের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাবে না, তাই নিজেকে আলাদা করো।’ যেমন ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম লেখক জেফ্রি চসার তাঁর জগতখ্যাত লেখা ‘দ্য ক্যন্টারবারি টেলস্’ নিজেকে আলাদা করে বা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় লিখেছেন। কীর্তিমানরা বরাবরই হোম কোয়ারেন্টাইনের সদ্ব্যবহার করেন। এমন অজস্র নজির আছে ইতিহাসে। শিল্পী মোস্তাফিজুল হকও এই প্যান্ডামিক মুডকে কাজে লাগিয়ে তাকে চিত্রগত করেছেন। তিনি দুর্যোগকালে নিজের আস্তানা গেড়েছেন স্টুডিওতে। সেখানেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। সামাজিক দূরত্ব বা সঙ্গনিরোধ বজায় রাখলেও রঙ-তুলির সাথে সঙ্গ বা সঙ্গম নিরবচ্ছিন্ন রেখেছেন। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘বৈশ্বিক দুর্যোগের গতি প্রকৃতি’ শিরোনামে ৩৫টি ছবি!

এসব ছবিতে তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন করোনা মহামারিতে প্রকৃতি ও জীবজগতের অবাধ স্বাধীনতা। বিশ্বে প্রকৃতি যেন বহুগুণ সাহসী হয়ে উঠেছে। নানারকম উদ্ভিদ নিজের ডানা মেলার ফুরসত পেয়েছে, জল-বায়ুর ময়লাগুলো ঝেড়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছে। সেইসাথে পশুপাখিরা অরণ্যের দিন-রাত্রি ছেড়ে লোকালয়ে চলে এসেছে ঘুরতে।

তাঁর ‘বৈশ্বিক দুর্যোগের গতি প্রকৃতি’ শিরোনামের একটি ছবিতে পাঁচটি শকুন দেখা যাচ্ছে। শিল্পী শকুনগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী। একটি শকুন উড়ে আসছে, বাকিগুলো ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে শকুনের পটভূমির সবুজ তারুণ্যদীপ্ত রং হারানো প্রকৃতির আশা জাগিয়ে তুলেছে। শিল্পী চিত্রে শকুনের উপস্থিতি বা অশুভ শক্তির উত্থান দেখিয়েছেন মানবজাতির পরাজয় হিসেবে। এমনকি আমাদের সমাজের অদৃশ্য কিছু শকুনের বিরুদ্ধাচারণও করেছেন। বিশ্বময় শকুন বিলুপ্তির পথে হলেও তাদের রেখে যাওয়া স্মৃতিঅর্ঘ পুষ্পময় করে তোলেন কিছু স্বার্থান্বেষী। তবে তাঁর নিরেট চাওয়াটা হচ্ছে মানবতার কল্যাণ সাধন এবং প্রকৃতি যেন প্রকৃতিস্থ হয়ে আবার সবকিছু যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

করোনা-২, মাধ্যম: এক্রেলিক অন ক্যানভাস

 

শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের চিত্রশৈলীতে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, সেটি হচ্ছে তেজোদীপ্ত মোরগের ডাক, মোরগ লড়াই। তিনি মোরগকে তুলিস্থ করেছেন। তাঁ চিত্রযাপনে মোরগের তর্জন আছে। তুলির অগ্রভাগে শান্ত, সৌম্যের আচড় আছে। তিনি এই ছবিতে যুদ্ধ বা লড়াই মুছে দিতে চেয়েছেন। এই প্রদর্শনীতে মোরগ লড়াইয়ে তিনি চেয়েছেন নিজেদের মধ্যে লড়াই নয়। যে কারণে আমরা দেখি আরেকটি ছবিতে মোরগের লড়াই তিনি থামিয়ে দিয়েছেন। এই ছবিটি বৈশ্বিক লড়াইয়ের চিত্ররূপ। ছবিতে লোজ ব্রাশিং, ট্যাক্সচার সেই সাথে রঙের ঘনত্বের কারণে ছবিটি ওজন নির্ণয় করলেও পালকের সেই ওজন নেই। কারণ পালকের ওজন থাকলে ওড়ার সক্ষমতা হারাবে। শিল্পী এখানে বস্তুগত চরিত্রের পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন।

কথিত আছে জন্মের এক ঘণ্টা পরেই ঘোড়া দৌড়াতে পারে। ঘোড়া শৌর্য-বীর্যের প্রতিক। এই নিরন্তর ছুটে চলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছেন খোদ শিল্পী। অনেক বছর ধরে ঘোড়াকে কিউবিজম ধারায় ভেঙে আবার নতুন শিল্পরূপ দিচ্ছিলেন। এই প্রদর্শনীতে কয়েকটি ঘোড়া ভার্চুয়ালি দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াবে। চিত্রে কিছু ঘোড়ার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তাঁর ঘোড়াগুলি পিকাসো, ফিদার ঘোড়ার আস্তাবলের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। শিল্প এমনই, ফিদাও একসময় পিকাসোর ঘোড়াগুলো অঙ্গীভূত করেছিলেন। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক ঘোড়ায় এনাটমিকাল বিষয়কে অনুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় সুচারু লাল রং চামড়ার তলা থেকে টান দিয়ে বের করেছেন। তাতে করে অন্তরের রূপকে বহিরঙ্গে প্রকাশ করবার তাগিদ অনুভব করেছেন তিনি। অজস্র লেপনিতেও ভেতরকার অবয়বকে শিল্পীর তুলিকায় রসোর্ত্তীর্ণ করেছেন।

শিল্পীর রচিত চিত্রের মধ্যে রাজহাঁসের একটি চিত্র অন্যতম। কতিপয় হাঁসকে দেখানো হয়েছে জলসিক্ত দেহ থেকে জল অপসারণে ব্যস্ত। প্রতিটি পালকে কম্পনজাত ব্যাঞ্জনধ্বনি আছে। সাধারণত শিল্পীরা পাখির পালক আঁকতে গেলে পালকের নমনীয়তা উচ্ছেদ করে ফেলেন। সেদিক থেকে শিল্পী মোস্তাফিজুল হক পাখির পালক আঁকায় পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। এমনিতে তাঁর পাখির পালকের প্রতি আর্কষণ টের পাওয়া যাচ্ছে। এই ছবিতে শীতল রঙের আধিক্য আছে, কারণ হচ্ছে হাঁসগুলো নৌকার বৈঠা সদৃশ্য পাগুলো দিয়ে সদ্য জল ডিঙিয়ে তীরে উঠে এসেছে। শুধু ঠোঁট ও পায়ে উষ্ণ রঙের বৈভব বসিয়ে দিয়েছেন শিল্পী।

একটি ছবিতে মহিষের আবক্ষ দুটি আধা বিমূর্ত আঙ্গিকে চিত্রতল নির্মাণ করেছেন শিল্পী। আক্ষরিকার্থে আমরা মহিষকে কালো রঙের বলে নির্ণয় করলেও বিজ্ঞান তা মানতে নারাজ। বিজ্ঞান বলে সাদা-কালো কোনো রং নয়। সব রঙের সমষ্টিতে এসব বর্ণ গড়ে উঠে। সেক্ষেত্রে শিল্পী এখানে সব রঙের সার্থক প্রয়োগ করে কালোকে বোঝালেন। এই ছবিতে বর্গাকার ক্যানভাসে কম্পোজিশনে উপরে, নিচে স্পেস ছেড়ে দিয়ে মহিষের গতি সঞ্চার করেন।

তবে শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের অধ্যাত্ম শিল্পসত্তাকে খুঁড়ে বার করলে যেসব গল্পে আলোকপাত করা যায়- তাঁর ছবির অবয়ব জ্যামিতিক, আধা বিমূর্ত, বস্তুর ওজন এবং ফর্মই চিত্রের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। তাছাড়া হগিয়ার ব্রাশ চালানোর বলিষ্ঠ মনোবৃত্তি, তুলিতে রঙের পুরোত্ব চিত্রান্তর্গত সব ছবিতে প্রতীয়মান হয়েছে। লুসিয়ান ফ্রুয়েড যেমন শিল্পীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘মনে রেখো, পেইন্টিংয়ের মূল জিনিস পেইন্ট। রঙই ছবি আঁকার আসল বিষয়’। এমনকি শিল্পী মোস্তাফিজের ছবিতে ছবির প্রয়োজনে সীমান্তরেখার বিভা অনুজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়েছে। কোন প্রকার অনভিপ্রেত বা অতিকথনের অনুপ্রবেশ তাঁর ছবিতে নেই। শিল্পী এখানে ব্যাকরণগত বাস্তবানুগ চিত্র নির্মাণে সচেষ্ট নয়, স্বীয় শিল্পদর্শনের আলোতে দীপ্তিমান হতে চেয়েছেন। যেমন- অঙ্কন আর অঙ্ক এক নয়। অঙ্কনের কাজে বস্তুর হিসাব মেলাবার সুযোগ নেই, আছে শুধু বস্তুর রহস্য উদঘাটন , প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যেমন মাটি খুঁড়ে রহস্য বের করেন তেমনই।

করোনা-৩, মাধ্যম: এক্রেলিক অন ক্যানভাস

 

এই প্রদর্শনীতে আরো যেসব ছবি আছে তন্মধ্যে করোনাভাইরাসের ছবি, কাক, ছাগল, ঈগল ইত্যাদি। শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের এই প্রদর্শনীটি চলবে চিত্রকলা গ্যালারিতে, এটি বাংলাদেশের প্রথম ভার্চুয়াল থ্রি-ডি গ্যালারি। প্রদর্শনীটি চলবে ১৫-৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়