ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জীবনানন্দের খোঁজে

সাঈদ আহসান খালিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ১১ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবনানন্দের খোঁজে

সাঈদ আহসান খালিদ: বরিশালের আলো, হাওয়া, জল, ধুলো-মাটি, ঘাস, শঙ্খচিল, শালিক, ভোরের কাক, লক্ষ্মী পেঁচা, হিজল বন, অনন্ত নক্ষত্রবীথি আর কীর্তনখোলা ও ধানসিঁড়ির নদীর জলে-জালে নিসর্গের কবি, নির্জনতার কবি, রূপসী বাংলার আত্মাভিমানী কবি জীবনানন্দ দাশ কেমন গভীরভাবে সেঁটে আছেন, জীবনানন্দের যাদুর শহর কেমন হবে- এই কল্পনা বুকপকেটে নিয়ে দু'দিনের জন্য বরিশাল শহরে পা রাখি- প্রথমবারের মতো।

জীবনানন্দ দাশ-এর বাড়ি ‘ধানসিঁড়ি’ যেতে চাই- কত জায়গায়, কতবার পড়েছি- বরিশাল শহরের ‘জীবনানন্দ দাশ সড়ক’-এ কবির বাড়ি। কিন্তু জীবনানন্দময় বরিশালের কল্পনার ফানুসে প্রথম ধাক্কাটি খেলাম যখন কোনো ট্যাক্সিচালকই জীবনানন্দ’র বাড়ি কোথায় চিনতে পারলেন না। জীবনানন্দ দাশ সড়কের অস্তিত্ব তাদের অজানা! পথচারীদের জিজ্ঞেস করি- তাঁরাও ঠিক জানেন না, পরিচিত সাহিত্যপ্রেমী এক বরিশালবাসী শুভানুধ্যায়ীকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল- শহরের বগুড়া সড়কে ‘আম্বিয়া হাসপাতাল’র পাশে কবির পৈতৃকভূমি ‘ধানসিঁড়ি’ এখনও টিকে আছে। ‘জীবনানন্দ দাশ সড়ক’- নামটি কাগজে-কলমে আছে বটে কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে সবাই এটিকে এখনো ‘বগুড়া রোড’ নামেই চেনে এবং ‘ধানসিঁড়ি’ই যে বাংলা ভাষার অমর কবি জীবনানন্দের বাড়ি- এই কথা অধিকাংশের বে-খবর! নানা চক্কর আর ঝক্কি শেষে কবির ‘ধানসিঁড়ি’ অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেলো। শ্যাওলা পড়া পুরনো সীমানা প্রাচীরের প্রবেশ মুখের একটি থামে কালো অক্ষরের শিলালিপিতে লেখা ‘ধানসিঁড়ি’। লাল রঙের লোহার দ্বার খোলাই ছিল- একহারা সুপারি গাছের সারি পাশে রেখে ভাঙা ইটের গলিপথ এগিয়ে গেছে সামনে। ভেতরে কয়েকটি গৃহস্থঘর- সেমিপাকা টিনশেড, ব্যস্ত সংসারযাপন। কিন্তু জীবনানন্দ কোথায়? তাঁর স্মৃতি? কোথাও কিচ্ছু নেই!

মাছরাঙা চ'লে গেছে- আজ নয় কবেকার কথা;

তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জল

দিতে চেয়ে মানুষের অবহেলা উপেক্ষায় হ'য়ে গেছে ক্ষয়...

একদিন এই বাড়িটির পূর্বনাম ছিল ‘সর্বানন্দ ভবন’; কবির পিতার নামে। কবি পরিবার এই ভিটে ছেড়েছে বহু বছর। ধানসিঁড়ির মালিক পরিবর্তন হয়েছে অর্ধশত বছর আগে, কবির ভিটেয় নতুন বাড়ি তুলেছেন কেউ, কিছু অংশ সরকার হুকুমদখল করেছে, বাকি অংশ বেদখলে বেহাত; কবির কোনো স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট নেই। বাড়ির পাশে অধুনা প্রতিষ্ঠিত একটি পাঠাগার ও মিলনায়তন দৃশ্যমান হলো; কবির নামে, কিন্তু জীবনানন্দ পাঠের চেয়ে এখানে নাকি বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি চলে- এমন অভিযোগ পাওয়া গেলো। পাঠাগারের গেইটে মোটা তালা ঝুলছে।

‘জীবনানন্দের বাড়ি’ থেকে দু'কদম এগোলেই অক্সফোর্ড মিশনের ‘লাল গির্জা’র দেখা মেলে। এই গির্জার সাথে কবির নিবিড় সম্পর্ক আছে। কথিত আছে- কবির সঙ্গে তাঁর প্রথম প্রেমিকা মনিয়ার সাক্ষাৎ হয়েছিল এই অক্সফোর্ড মিশনের গির্জায়। মনিয়ার মা এই গির্জায় সেবিকার কাজ করতেন। শুধু তাই নয়, কবি ছাত্রাবস্থায় এই গির্জার ছাত্রাবাসে থাকতেন। জীবনানন্দ-এর ‘কুড়ি বছর পরে’ কবিতায় মনিয়ার  উল্লেখ আছে:

‘মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার―

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!’

কুড়ি বছর পরে কবি মনিয়ার দেখা পেয়েছিলেন কিনা আমাদের জানা হয় না। আমরা কবির ভিটেয় এসে কবির স্মৃতির সাক্ষাৎ না পেয়ে হতাশ হই, কবির প্রতি এমন ‘অবহেলা, উপেক্ষা আর ক্ষয়’ দেখে কর্তৃপক্ষের প্রতি রাগ হয়, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবি জীবনানন্দ নিজ শহরেই এমন ব্রাত্য, এমন ধূসর! আমরা বিষণ্ন হৃদয়ে ফেরার পথ খুঁজি...।

 

এবার পা বাড়ালাম ঝালকাঠির পথে, এখানে বামনকাঠিতে জীবনানন্দের মাতুলালয়। ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এখানেই জন্মেছিলেন কবি। বাড়িটির কোনো স্মৃতিচিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই, চারদিক জঙ্গলাকীর্ণ- সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি কেউ। দেখতে ছুটে গেলাম ঝালকাঠিতে কবির স্মৃতিধন্য ‘ধানসিঁড়ি নদী’- যে নদীকে কবিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে পরিচয় করিয়েছেন, বারংবার আওড়েছেন এই নাম; গভীর প্রেমে:

‘হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!’

এক সময়ের খরস্রোতা সেই ধানসিঁড়ি নদী এখন স্রোতহীন শ্রীহীন মরা খাল- কবির স্মৃতিচিহ্নের মতোই! ধানসিঁড়ি নদীর কাছে দেখলাম সুন্দর একটি সেতু; নাম ‘গাবখান সেতু’। এটির নাম ‘জীবনানন্দ দাশ সেতু’ হলে কতো সুন্দর হতো- এই ভেবে বিষণ্নতা আরো গাঢ় হলো। বরিশালের কোথাও কবিকে খুঁজে পেলাম না! গভীর এক বিপন্নতা, দুঃখবোধ গ্রাস করে। ‘নির্জনতার কবি’ লিখেছিলেন:

‘একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর...’

তবু কবি ও কবিতা ভালোবেসে যারা বরিশাল আসেন তাঁরা তো জীবনানন্দের খোঁজ করবেনই। এই বরিশাল শহরের আলো-জল-হাওয়া গায়ে মেখেই যে কবি বড় হয়েছেন, শৈশব-তারুণ্য এমনকি কর্মজীবনের শুরু যে বরিশালে, যেখানে কবি ‘ভিজে মেঘের দুপুর’ কাটিয়েছেন, ‘কলমীর গন্ধভরা জল’ ছুঁয়েছেন, দেখেছেন কারো ‘বেত ফলের মতো ম্লান চোখ’, গভীর মুগ্ধতায় ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন’ নেমে আসা সন্ধ্যার প্রতীক্ষা করেছেন, ঈর্ষাকাতর হয়ে কোন এক সুরঞ্জনাকে বলেছেন: ‘বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে’। জীবনানন্দ’র খোঁজ এই বরিশাল ছাড়া আর কোথায় পাবো? এই প্রশ্নের উত্তর কবিই দিয়ে গেছেন। নিসর্গের এই কবিকে নগরের কংক্রিট আর স্মৃতিচিহ্নে নয়; খুঁজতে হবে প্রকৃতিতেই- কবির উপমা আর রূপকের মাঝে। লোকালয় আর নাগরিক ঊর্ধ্বশ্বাসের জীবন থেকে পালাতে চাওয়া এই কবি যেমন বলেছেন: ‘আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে…।’

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়