ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (শেষ পর্ব)

অভিজিৎ মুখার্জী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২৬ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ১৪:২৪, ১৮ অক্টোবর ২০২১
অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (শেষ পর্ব)

‘‘আজ তো রোববার,” লোকটা গলা তুলে, বেশ কড়া গলায়, প্রায় চেঁচিয়েই এমনভাবে বলল, যেন পার্কিং লটে কারুকে শোনাতে চাইছে। “আজ রোববার তো আমি আপনার কাছে কিছু বেচতে পারব না। আর, ওনাকে তো কখনোই কিছু বিক্রি করতে পারব না। ওনার এমনকি এখানে আসারই কথা নয়। বুঝতে পারছেন তো?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, সেটাই তো। ঠিকই বলেছেন, আমি মেনে নিচ্ছি,” নিইল বলে।

দু’জনের মধ্যে যখন কথা হচ্ছে, তার মধ্যেই বারের পিছনের লোকটা একটা লুকোনো তাক থেকে হুইস্কির বোতল বের করে, একটা গ্লাসে খানিকটা ঢেলে, কাউন্টারের এধারে নিইলের দিকে ঠেলে দিল।

“আপনার তেষ্টা পেয়েছে?” গ্রেসকে বলল লোকটা। ততক্ষণে একটা কোক সে খুলতে শুরু করেছে। কোনও গ্লাস ছাড়াই সেটা সে গ্রেসের দিকে এগিয়ে দিল।

কাউন্টারের ওপরে একটা নোট রাখল নিইল, আর লোকটা সেখান থেকে সরিয়ে ফেলল সেটা।

বলল, “বললাম তো আপনাকে, বিক্রি করতে পারব না।”

“আর, কোকটা?” নিইল জিজ্ঞেস করল।

“বিক্রি করা যাবে না।”

লোকটা এবার বোতলটা সরিয়ে ফেলল, নিইল খুব তাড়াতাড়িতে গ্লাসে যেটুকু ছিল গলায় ঢেলে দিল। মুখে বলল, “আপনার মতো লোকই তো দরকার। আইন মানা নেশা।’’

“কোকটা সঙ্গে করে নিয়ে যান। উনি যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে যান, আমি ততই খুশি।’’

“ও কিন্তু খুব ভালো মেয়ে। আমার ভাইয়ের স্ত্রী। ভবিষ্যত ভ্রাতৃবধূ। সেইজন্য আমি জানি,” নিইল বলে।

“একথা কি সত্যি?”

ওরা আর হাইওয়ে সেভেনের দিকে ফিরে গেল না। তার পরিবর্তে উত্তরদিকের পথ ধরল, সেই রাস্তাটা বাঁধানো নয়, কিন্তু যথেষ্ট প্রশস্ত, এবং সুন্দর করে ঢাল তৈরি করা। মদ খেলে যা হওয়ার কথা, তার ঠিক উল্টোটাই যেন হল নিইলের গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে। এই রাস্তায় যেমনটি প্রয়োজন, সেইভাবে একটা সমীচীন, সতর্ক মাত্রায় নামিয়ে আনল গাড়ির গতি।

“তোমার আপত্তি নেই তো?” নিইল বলল।

“কীসে আপত্তি?” গ্রেস তাতে বলল।

“এই যে তোমাকে একটা পুরনো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি?”

“না।”

“তোমার সঙ্গটা আমার খুব প্রয়োজন। পা’টা কেমন আছে এখন?”

“ঠিকই আছে।”

“ব্যথা তো একটু করার কথা।”

“খুব একটা করছে না। ঠিকই আছে।”

গ্রেসের যে হাতে কোকের বোতলটা ধরা নেই, সেটা তুলে নেয় নিইল। হাতের তালুটা নিজের মুখে চেপে ধরে, জিভ দিয়ে অল্প চেটে দেয়, তারপর আবার নামিয়ে রাখে।

“তুমি কি ভেবেছিলে যে আমি তোমাকে কোনও হীন উদ্দেশ্যে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলাম?”

“না,” সত্যিটা বলে না গ্রেস, ভাবে, কেমন ঠিক মায়ের মতো করে ‘হীন’ কথাটা বলল নিইল।

“একটা সময় ছিল, যখন ওভাবে ভাবাটা ভুল হত না,” নিইল বলে, যেন গ্রেস বলেছে, হ্যাঁ। “কিন্তু আজ সেটা হবে না। আমার মনে হয় না সেরকম কিছু হবে। আজ তুমি একটা গীর্জার মতোই নিরাপদ।”

গলার স্বরটা বদলে গেছে, আরও ঘনিষ্ঠ এখন, অকপট, আর শান্ত, সঙ্গে ওর ত্বকে যে ঠোঁটটা চেপে ধরেছিল, জিভ বুলিয়ে দিয়েছিল, সেই স্মৃতি গ্রেসকে এতটাই আবিষ্ট করে তুলল যে ও শুধু নিইল যা বলছিল তার শব্দগুলোই শুনছিল, অর্থটা পৌঁছচ্ছিল না। ত্বকের সবটা জুড়ে যেন একশো বার, শতশত বার জিভের স্পর্শ, আকুতির নৃত্য ও অনুভব করছিল তখন। তবু ভেবে নিয়ে বলল, “গীর্জা যে সবসময়ই নিরাপদ, তা তো নয়।”

“ঠিকই। ঠিকই।”

“আর, আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রীও নই।”

“ভবিষ্যতের। বললাম না, ভবিষ্যত ভ্রাতৃবধূ?”

“সেটাও তো আমি নই।”

“ওহ্, আচ্ছা। আমি কি খুব একটা আশ্চর্য হলাম? না তো। আশ্চর্য হলাম না।”

এবার আবার ওর কণ্ঠস্বরটা পালটে গেল, যেন কোনও বৈষয়িক প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে।

“আমি একটা জায়গা খুঁজছি, এখানেই কোথাও, যেখানে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে, একটা চলে গেছে ডানদিকে। রাস্তাটা আমার চিনতে পারার কথা। এই অঞ্চলটা তুমি কি আদৌ চেনো?”

“এদিকটা চিনি না, নাহ্।”

“ফ্লাওয়ার স্টেশন চেন না? উমপাহ্, পোল্যা-? স্নো রোড?”

গ্রেস এসব নাম শোনেনি।

“একজনের সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি।”

গাড়িটা একবার ডানদিকে বাঁক নিল, নিইল বিড়বিড় করে কী যেন বলল। কোথাও রাস্তার নাম লেখা নেই। রাস্তা এখানে সরু, এবড়ো-খেবড়ো, একটা গাড়ি যাওয়ার মত চওড়া কাঠের একটা ব্রিজ ছিল। মাথার ওপরে দু’ধারে পর্ণমোচি বৃক্ষের বনের ডালপালা। আশ্চর্যরকম গরম রয়ে গেছে আবহাওয়াটা এবছর, তাই গাছের পাতায় রঙ ধরেনি এখনো, ডালপালাগুলো তাই এখনও সবুজ, কেবল এখানে ওখানে এক আধটা ব্যতিক্রম, ব্যানারের মত ঝলকানি দিয়ে উঠছে। কেমন যেন অভয়ারণ্য বলে মনে হচ্ছিল। মাইলের পর মাইল নিইল আর গ্রেস কোনও কথা বলছিল না, কিন্তু গাছের কোনও বিরাম ছিল না তা’বলে, বন ফুরোচ্ছিল না। তারপরে একসময় নিইল সেই নৈশঃব্দ ভাঙল।

বলল, “তুমি গাড়ি চালাতে পার?” তারপর যখন গ্রেস বলল যে পারে না, তখন বলল, “আমার মনে হয় তোমার শিখে নেওয়া উচিত।”

বলতে চেয়েছিল যে সেটা তক্ষুণি করতে হবে। গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে, গ্রেসের দিকটায় চলে গেল, গ্রেসকে গিয়ে বসতে হল স্টিয়ারিং-এর পিছনে।

“এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা।”

“কিছু একটা এসে পড়ে যদি?”

“কিচ্ছু আসবে না। এলেও সামলে নেওয়া যাবে। সেইজন্যই তো রাস্তার এক্কেবারে সোজা একটা অংশ বেছে নিলাম। চিন্তার কিছু নেই, সবকিছু ডানপায়ে করলেই হবে।”

গাছেদের নিচে একটা লম্বা সুরঙ্গের মুখটায় ওরা তখন, মাটিকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে সূর্যের রোদ এসে। গাড়ি কী করে চলে, সেসব কিচ্ছু ব্যাখ্যার দিকেই গেল না নিইল— স্রেফ ওকে দেখিয়ে দিল কোথায় পা রাখতে হবে, গিয়ার সরানোটা ক’বার একটু অভ্যাস করিয়ে নিল, তারপর বলল, “নাও এবার চালাও, আমি যেমন যেমন বলি, করতে থাক।”

গাড়িটা চলতে শুরু করার প্রথম ঝটকাটাতে ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। গিয়ারে ঘষটানির আওয়াজ তুলে ফেলল, ভাবল এবারে বোধহয় নিইল আর দেরি না করে ব্যাপারটাতে ইতি টানবে। কিন্তু নিইল হেসে উঠেছিল, “ওহোহ্, শান্ত হয়ে, শান্ত হয়ে। চালাতে থাক,” গ্রেসও চালাতে থাকল। স্টিয়ারিং-এর ব্যাপারে, কিংবা যেভাবে স্টিয়ারিং-এর কারণে গ্রেস অ্যাকসিলারেটারের কথা ভুলে যাচ্ছিল সেই নিয়ে নিইল কোনও মন্তব্য করল না, কেবল বলছিল, “চালাতে থাক, চালাতে থাক, রাস্তার ওপরে রাখ, ইঞ্জিনটা যেন বন্ধ না হয়ে যায়।”

“থামানো যাবে কখন?” গ্রেস বলে।

“যতক্ষণ না বলে দিই কীভাবে থামাতে হয়।”

যতক্ষণ না ওরা সেই সুরঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলো, নিইল ওকে বাধ্য করল গাড়িটা চালিয়ে যেতে, তারপর বলে দিল ব্রেকের ব্যাপারটা। গাড়িটা থামিয়েই গ্রেস দরজাটা খুলে ফেলেছিল যাতে ওরা সীট বদলে নিতে পারে, কিন্তু নিইল বলল, “না না, এ তো কেবল একটু বিরতি নিয়ে নিচ্ছি। শিগগিরই তোমার ভালো লাগতে শুরু করবে।” তারপর যখন ওরা আবার শুরু করল, গ্রেসের মনে হল ও বোধহয় ঠিকই বলেছিল। মুহূর্তের জন্য আত্মবিশ্বাসে একটা জোয়ার এসে যাওয়ায় ওরা আরেকটু হলে একটা খানায় গিয়ে পড়ছিল। তবু স্টিয়ারিংটা ধরে ফেলার সময় নিইল হেসে উঠেছিল, প্রশিক্ষণপর্বও চালু থেকে গিয়েছিল।

নিইল যখন ওকে গাড়ি থামাতে দিল, ততক্ষণে ওরা যেন মাইলের পর মাইল চালিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছিল, সঙ্গে এমনকি— গতি কমিয়ে নিয়ে বেশ ক’টা বাঁকও নিয়ে ফেলেছে। নিইল তখন বলল যে এবার সীট বদলে নেওয়াই ভাল, কেননা নিজে চালাতে না থাকলে দিকের হদিস রাখতে ওর অসুবিধা হয়।

 গ্রেসের কেমন লাগল জিজ্ঞেস করল নিইল, সর্বাঙ্গ তখনও কাঁপছে, তবু ও বলল, “খারাপ না।”

 ওর কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত হাতটা ডলে দিতে দিতে নিইল বলেছিল, “কীরকম মিথ্যুক!” কিন্তু এর চেয়ে বেশি আর স্পর্শ করেনি গ্রেসকে, শরীরের কোনও অংশকে আর ওর মুখের স্পর্শ পেতে হয়নি।

দিকের হদিস ফিরে পেয়েছিল নির্ঘাত, কয়েক মাইল গিয়েই। একটা জায়গায় দুটো পরস্পর আড়াকাড়ি রাস্তা আসতেই ও বাঁদিকে ঘুরল, গাছেরা আর অত ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে নেই সেখানে, এবড়োথেবড়ো একটা লম্বা পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠতে লাগল ওরা, কয়েক মাইল যাওয়ার পরে এসে পৌঁছোল একটা গ্রামে, নিদেনপক্ষে রাস্তার পাশে কতকগুলো বাড়ির সমাহার সেখানে। একটা গীর্জা আর একটা দোকান, কোনোটাই তার মূল উদ্দেশ্য আর সাধন করছে না, কিন্তু সম্ভবত লোক থাকে সেখানে, আশেপাশের গাড়িগুলো, আর জানালায় জানালায় কেমন হতশ্রী পর্দা দেখে সেরকমই মনে হয়। কয়েকটা বাড়ি, সবগুলোর একই অবস্থা, তার মধ্যে একটার পিছনে একটা শস্যের গোলা, ভেঙেচুরে ভেতরেই পড়েছে, অনেকদিনের ঘাস, কালচে রঙের, চিড় খেয়ে যাওয়া থামের ভিতর থেকে ফুলেফেঁপে বেরিয়ে এসেছে, যেন ফুলে ওঠা কলকব্জা কোনও যন্ত্রের।

জায়গাটা চোখে পড়তেই নিইল একেবারে আত্মহারা হয়ে পড়ল, কিন্তু তাতেই ক্ষান্তি দিল না।

বলে উঠল, “ওফ্, কী যে বাঁচোয়া, সত্যিই! এবারে বুঝতে পারছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

“আমাকে?”

“এই যে গাড়ি চালানো শেখাতে দিলে। এটাতেই আমি বেশ খানিকটা শান্ত হলাম।”

“শান্ত হলেন? সত্যি?” গ্রেস বলেছিল।

“এরচেয়ে সত্যি আর হয় না,” হাসছিল নিইল, কিন্তু গ্রেসের দিকে না তাকিয়ে। গ্রামটা ছাড়িয়ে আসার পর রাস্তার দুপাশে পড়ে থাকা ক্ষেত দেখছিল, একবার এদিকে, আবার ওদিকে। কথা বলছিল, যেন নিজের সঙ্গেই।

“এটাই। হতেই হবে। এবারে আমরা চিনতে পেরেছি।”

 এইসব বলতে বলতে শেষে গাড়ি ঘুরিয়ে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ল, রাস্তাটা সোজা না গিয়ে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে এগোচ্ছিল, কখনো পাথরের চাঁইয়ের পাশ দিয়ে, কখনো জুনিপারের ঝোপকে পাশ কাটিয়ে। সেই রাস্তার শেষে একটা বাড়ি, সেটার দশা গ্রামের সেই বাড়িগুলোর চেয়ে একটুও ভাল নয়।

 “এই জায়গাটায়,” নিইল বলল, “এই জায়গাটায় আমি আর তোমাকে ভেতরে নেব না। পাঁচ মিনিটও লাগবে না, একটু আসছি।”

 

অনেকটা বেশিই সময় লেগেছিল ওর।

বাড়িটার ছাউনির নিচে, গাড়ির ভিতরে বসে ছিল গ্রেস। বাড়ির দরজা খোলাই ছিল, কেবল জালের দরজাটা দেওয়া ছিল। জালের জায়গায় জায়গায় মেরামতি করা হয়েছে, পুরনো তারের সঙ্গে নতুন তারের বুনোট সেখানে। ওকে দেখতে আসেনি কেউ, এমনকি একটা কুকুরও না। গাড়িটা থেমে যেতে, দিনটা একটা অস্বাভাবিক নৈঃশব্দে ভরে উঠেছে। অস্বাভাবিকই, কেননা এরকম গরম একটা বিকেল, ঘাসের মধ্যে থেকে, জুনিপারের ঝোপ থেকে নানা পোকামাকড়ের ডাকে, ভোঁ ভোঁ আওয়াজে, গুঞ্জনে ভরে থাকবে বলেই আপনি প্রত্যাশা করবেন। এদের যদি দেখতে না-ও পাওয়া যায়, এদের আওয়াজ কিন্তু মাটির ওপরে আদিগন্ত যেখানে যা কিছু বেড়ে উঠছে, সেই সবকিছু থেকে উঠে আসবে। কিন্তু বছরের সেই সময়টা বেশ কিছুদিন হল পেরিয়ে গেছে, এমনকি রাজহাঁসেরা যে দক্ষিণের দিকে উড়ে যায়, সেই সময়টাও সম্ভবত অনেকদিন হল পেরিয়ে গেছে। সে যাই হোক, গ্রেসের কিছুই কানে এল না।

 মনে হচ্ছিল, ওরা যেন এখানে জগতের একেবারে শীর্ষবিন্দুতে এসে পৌঁছেছে, কিংবা শীর্ষবিন্দুগুলোর কোনও একটায়। সবদিকের ক্ষেতগুলো যেন নিচে চলে গেছে, চারপাশের গাছপালাও নেহাতই আংশিক নজরে আসছে কেননা ওরা গজিয়েছে নিচের দিকের জমিতে।

এই বাড়িতে কে ওর পরিচিত, কে থাকে এই বাড়িটায়? কোনও নারী? কিন্তু যেধরনের নারী নিইলের পছন্দ, তারা কেউ এরকম জায়গায় থাকবে বলে মনে হল না ওর, তবে কিনা, আজ যতরকম আশ্চর্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে গ্রেসকে তার যেন সীমা পরিসীমা নেই। সীমা পরিসীমা নেই।

এককালে এটা ইঁটের বাড়ি ছিল, কিন্তু কেউ একজন ইঁটের দেওয়ালগুলো ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। শুধুই কাঠ দিয়ে তৈরি দেওয়াল নিচ থেকে বেরিয়ে পড়েছে, যে ইঁটগুলো ওর ওপরে ছিল, উঠোনে সেগুলো কোনওভাবে জড়ো করে রাখা আছে, হয়তো বিক্রির অপেক্ষায়। দেওয়ালে এখনো যেটুকু ইঁট রয়ে গেছে তাতে সিঁড়ির ধাপের মতো করে একটা কোণাকুনি রেখার সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কিছু করার নেই, গ্রেস সীটটাকে পিছনে ঠেলে নিয়ে হেলান দিয়ে বসল ধাপগুলো গুনবে বলে। বোকার মত নিষ্ঠাভরে গুনে যাচ্ছিল, যেভাবে ফুলের থেকে একটা একটা করে পাঁপড়ি টেনে বের করে নেওয়া হয়, তবে ‘ও আমাকে ভালবাসে, ও আমাকে ভালবাসে না’ ধরনের স্থূল কিছু বলতে বলতে নয়।

‘‘ভাগ্য ভালো। ভালো না। ভাগ্য ভালো। ভালো না’’ এই অবধিই ওর সাহসে কুলোল।

 দেখা গেল, ওরকম আঁকাবাঁকা করে সাজানো ইঁটের খেয়াল রাখা বেশ কঠিন, আরও যেহেতু দরজার উচ্চতায় পৌঁছনোর পরে রেখাটা টানা আনুভূমিক হয়ে গেছে।

ও বুঝতেই পারল। কী আর হবে এই জায়গাটা? কোনও বেআইনি শুঁড়িখানা। ওদের নিজেদের ওখানকার এরকম এক মদবিক্রেতার কথা ওর মনে পড়ল— ক্ষয়াটে বুড়ো একটা, কঙ্কালসার চেহারা, অপ্রসন্ন এবং সন্দিগ্ধস্বভাবের। হ্যালুয়িনের রাতে বাড়ির সামনের সিঁড়িতে শটগান নিয়ে বসে থাকত। দরজার পাশে জড়ো করে রাখা জ্বালানি কাঠগুলোর প্রত্যেকটায় নম্বর দেগে রাখত, যাতে চুরি গেলে বুঝতে পারে। লোকটার কথা ভাবল গ্রেস— কিংবা এখানকার লোকটার কথা— ঘরের মধ্যে এই গরমে ঝিমোচ্ছে, ঘরটা নোংরা কিন্তু গোছানো (জালের দরজায় মেরামতি দেখে ও বুঝে গেছে যে এরকমই হবে)। এই সে উঠে দাঁড়াচ্ছে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তোলা খাট কিংবা কৌচের থেকে, সেগুলোর ওপরে ময়লা দাগওলা কাঁথা পেতে রাখা আছে, কোনও মহিলা আত্মীয়, অনেকদিন আগে যিনি প্রয়াত হয়েছেন, কাঁথাটা বানিয়ে দিয়েছিল।

 এমন নয় যে ও কোনওদিন মদবেচা লোকের বাড়ি ভিতরে গিয়ে দেখেছে, কিন্তু ওরা যেখানে থাকত, খুব পাতলা বিভাজক দেওয়ালের দুপাশে থাকত কায়ক্লেশে, অভাবের মধ্যে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকা, আর সম্মানজনক নয় এমনভাবে দিন গুজরান করা। এসবের হাল-হকিকত সম্বন্ধে ও ওয়াকিবহাল ছিল।

ভাবতেই আশ্চর্য লাগছিল যে ও কখনো ম’রিকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিল। একপ্রকার প্রতারণাই করা হত। নিজের সঙ্গেও প্রতারণা করা হত। কিন্তু নিইলের সঙ্গে গাড়িতে চড়ে চলে আসার মধ্যে কোনও প্রতারণা নেই, যা ওর জানা, সেগুলোই কিছুকিছু নিইলও জানে। আর ও নিজে আরো বেশি বেশি করে জানতে পাচ্ছিল নিইল সম্বন্ধে, প্রতিনিয়ত।

এবার ও যেন দেখতে পেল ওর কাকা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়, কেমন কুঁজো হয়েছেন, বিহ্বল, ওর দিকে তাকাচ্ছেন, যেন বছরের পর বছর ও দূরে কোথাও কাটাচ্ছিল। যেন বাড়ি আসবে বলে কথা দিয়েও একসময় ও ভুলেই গিয়েছিল সেকথা, আর এই সময়ের মধ্যে ওঁর মারা যাওয়ারই কথা ছিল, কিন্তু মারা যাননি।

ও কথা বলার চেষ্টা করছিল প্রাণপণ, কিন্তু উনি খেয়ালই করছিলেন না। জেগে উঠেছিল ও, নড়ছিল চড়ছিল। নিইলের সঙ্গে গাড়িতে ওরা তখন আবার রাস্তায়। মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছিল বলে জলতেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল খুব। একবার গ্রেসের দিকে ফিরল নিইল, বাতাসে যে প্রবাহ তৈরি করেছিল ওদের গাড়ির গতি, ওদের ঘিরেই বইছিল সেটা, তাতেই ও টের পেল, নতুন করে হুইস্কির গন্ধ।

ওর ভুল হয়নি।

“জেগে গেলে? আমি যখন ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম, তুমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিছু মনে কোরো না— কিছুক্ষণের জন্য একটু মিশুকভাব করতে হচ্ছিল। তলপেটে চাপ পড়ছে না?” নিইল বলেছিল।

এই সমস্যাটা নিয়ে গ্রেস ভাবছিল, সত্যি বলতে কী, যখন বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখনই। ওখানেই বাড়িটার পিছনে একটা টয়লেট চোখে পড়েছিল ওর, কিন্তু বেরিয়ে এসে হেঁটে ঐ অবধি যেতে ওর লজ্জা করছিল।

“এই জায়গাটায় মনে হচ্ছে সম্ভব,” বলে নিইল গাড়িটা থামিয়েছিল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ফুটে থাকা গোল্ডেন রড, কুইন অ্যান’স লেস, বুনো অ্যাস্টারিয়ার মাঝখানে হেঁটে ঢুকে গিয়ে একজায়গায় উবু হয়ে বসে পড়েছিল গ্রেস। রাস্তার ওপারে, ওরকমই সব ফুলের মধ্যে নিইল গিয়ে দাঁড়াল, গ্রেসের দিকে পিছন ফিরে। গাড়িতে ফিরে এসে ওর পায়ের কাছে মেঝেতে বোতলটা দেখতে পেল গ্রেস। ভিতরের দ্রব্যের এক তৃতীয়াংশের বেশিই উধাও।

নিইল দেখল যে গ্রেস তাকিয়ে আছে।

বলল, “আরে, ও কিছু নয়, এখানে কেবল খানিকটা ঢেলেছি,” বলে একটা ফ্লাস্ক উঁচু করে তুলে দেখাল। “গাড়ি চালানোর সময় সুবিধে হয়।”

মেঝেতে আরেকটা কোকাকোলার বোতলও ছিল। নিইল ওকে বলল গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে বটল ওপেনারটা বের করে আনতে।

আশ্চর্য হয়ে গ্রেস বলেছিল, “এটা তো ঠান্ডা দেখছি!”

“আইস-বক্স। শীতে লেক থেকে বরফ কেটে নিয়ে এসে কাঠের গুঁড়োর মধ্যে রেখে দেয়। ইনি অবশ্য বাড়ির নিচে রেখে দেন।”

“আমার মনে হল আমার কাকাকে যেন দেখলাম দোরগোড়ায়। কিন্তু স্বপ্ন দেখছিলাম,” গ্রেস বলেছিল।

“আমাকে তোমার কাকার কথা বলতে পার তো। তোমাদের বাড়ির কথা বল। তোমার কাজ নিয়ে বল। তোমার কথা শুনতে বেশ লাগে আমার।”

কণ্ঠস্বরে একটা নতুন দৃঢ়তা, মুখশ্রীতেও একটা পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সেটা মাতালের অপ্রকৃতিস্থতার জৌলুস নয়। ঠিক যেন, একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল— ভয়ানক অসুস্থ নয়, একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল এই আবহাওয়ায়— আর এখন আশ্বস্ত করে বলতে চাইছে যে অনেকটা ভালো বোধ করছে। ফ্লাস্কের ঢাকনাটা বন্ধ করে ওটাকে মেঝেতে শুইয়ে রেখে গ্রেসের হাতের দিকে হাত বাড়াল ও। শক্ত করে ধরল হাতটাকে, একজন কমরেডের মুঠি।

“বয়েসে হয়েছে অনেক। আসলে তো আমার বাবার কাকা উনি। বেতের কাজ করেন—চেয়ারে বেতের কাজ। ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না, তবে সারানোর মত একটা চেয়ার থাকলে দেখাতে পারতাম,” গ্রেস বলে।

“কিন্তু সে তো নেই।”

গ্রেস হেসে ফেলে বলে, “একঘেঁয়ে ধরনের কাজ। বেশ একঘেঁয়ে।”

“তাহলে কী করতে ভালো লাগে তোমার, সেটা বল। কীসে আগ্রহ পাও?”

“আপনার ব্যাপারেই তো আগ্রহ আছে,” গ্রেস বলেছিল।

“ওহ্। আমার মধ্যে কোন জিনিসটায় তোমার আগ্রহ?” হাতটা শিথিল হয়ে সরে যায়।

“এই এখন যেসব করছেন। কেন করছেন,” গ্রেস মনে জোর এনে বলে।

“মদ খাওয়ার কথা বলছ? কেন খাচ্ছি?” ফ্লাস্কের ঢাকনাটা আবার খোলা হয়। “আমায় সেটা জিজ্ঞেস করছ না কেন?”

“কেননা আপনি কী বলবেন, আমি জানি।”

“কী সেটা? আমি কী বলব?”

“আপনি বলবেন, এছাড়া আর করবটাই বা কী? কিংবা ওরকমই একটা কিছু।”

“ঠিকই। আমি সেকথাই বলব। আর তখন তুমি বলতে থাকবে কোথায় আমার ভুল হচ্ছে,” ও বলেছিল।

“না। আমি তা বলব না,” গ্রেস বলে।

বলতে বলতেই কেমন দমে গেল ও। শুরুতে ভেবেছিল এটাই বোধহয় ওর নিজের মনের কথা, কিন্তু এখন দেখছে যে ও আসলে এইসব বলে নিইলকে একটু মুগ্ধ করে দিতে চাইছে, দেখাতে চাইছে যে নিইল যতটা ও নিজেও ততটাই বস্তুজগতের মানুষ, বলতে গিয়ে মাঝপথে এসে ও এহেন শোচনীয় সত্যের মুখোমুখি হলো। এই সর্বাত্মক আশাহীনতার— নির্ভেজাল, যুক্তিযুক্ত, এবং চিরস্থায়ী।

নিইল বলেছিল, “বলবে না তো? না, তুমি বলবে না। সেটাই স্বস্তির। তুমি নিজেই মূর্তিমতী স্বস্তি গ্রেস।”

একটু পরে বলল, “আমার না, ঘুম পেয়েছে। একটা ঠিকঠাক জায়গা আমরা খুঁজে পেলেই আর দেরি করব না, গায়ের ওপর চাদরটা টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। বেশিক্ষণের জন্যে না। তুমি কিছু মনে করবে না তো?”

“না। আপনার এখন ঘুমোনো দরকার।”

“তুমি পাহারায় থাকবে তো?”

“হ্যাঁ”

“বাহ্”

সেরকম জায়গা একটা পাওয়া গেল ফরচুন বলে একটা ছোট শহরে গিয়ে। শহরের প্রান্তে একটা পার্ক, নদীর ধারে, সেখানে গাড়ি রাখার জন্য নুড়ি বিছানো খানিকটা জায়গা। সিটটা একটু পিছনে ঠেলে নিল নিইল, তারপর সেই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক এখন যেমন হয়ে এসেছে, সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল ততক্ষণে, রাতে খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল, প্রমাণ হচ্ছিল যে গ্রীষ্মকাল তখন আর নেই। একটু আগে সেখানে লোকেরা এসেছিল থ্যাংকস-গিভিং উপলক্ষ্যে পিকনিকে— বাড়ির বাইরের একটা ফায়ারপ্লেস থেকে তখনও একটু ধোঁয়া বেরোচ্ছে, বাতাসে হ্যামবার্গারের ঘ্রাণ। গন্ধটায় গ্রেসের যে খিদের অনুভূতি হল, তা ঠিক নয়— অন্যান্য সময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যখন খিদে পেয়ে গিয়েছিল, সেসব কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

 নিইল তক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ল, আর গ্রেস বেরিয়ে এল গাড়ির ভিতর থেকে। গাড়ি চালানো শেখার সময় বারবার থামাতে আর চালু করতে গিয়ে খানিকটা ধুলো এসে জমেছে ওর সারা দেহে। খোলা জায়গায় একটা কলের জলে যথাসম্ভব ভাল করে হাত, পা আর মুখ ধুয়ে নিল। তারপর কেটে যাওয়া পা সাবধানে বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে নদীর তীর অবধি হেঁটে গেল, চোখে পড়ল নদী কত অগভীর, উলুখাগড়া জলের ওপরের তল ভেদ করে মাথা তুলে রয়েছে। বোর্ডে একটা বিজ্ঞপ্তিতে সাবধান করা হচ্ছে যে গালাগাল দেওয়া, কোনোরকম অশ্লীলতা, কুৎসিত ভাষার ব্যবহার ওখানে নিষিদ্ধ, নিষেধ না মানলে শাস্তি পেতে হবে।

ও গিয়ে পশ্চিমদিকে মুখ করা দোলনাটায় চড়ার চেষ্টা করল। নিজের শরীরটাকে অনেকটা উচ্চতায় পাঠিয়ে দিয়ে পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকাল— আবছা সবুজ, বিলীয়মান স্বর্ণাভা, আর একটা দুর্দান্ত গোলাপি রঙ চারধারে দিগন্ত ঘিরে। তাপমাত্রা কমতে শুরু করে দিয়েছে।

ও ভেবেছিল, স্পর্শের মাধ্যমেই বুঝিবা। মুখ, জিভ, ত্বক, শরীর, হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি। ফুলে উঠে প্রদাহ। লিপ্সা। কিন্তু সেসব আদৌ ওদের জন্য নয়। যেভাবে ও নিইলকে চিনল, এই এখন ওর ভেতরে যতদূর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছে গ্রেস, তার তুলনায় ওসব তো ছেলেখেলা।

ও যা দেখতে পেয়েছে, তার পরে আর কিছু হয় না। যেন ও ধারে দাঁড়িয়ে আছে, আর সামনে ওঠাপড়াহীন কালো জল, অনন্তবিস্তৃত। ঠান্ডা জল, জলের উপরিতলে কোথাও উঁচুনিচু নেই। ও যেন তাকিয়ে আছে সেই অন্ধকার, ঠান্ডা জলের সমতলপৃষ্ঠের দিকে, ও জানে যে আর কোথাও কিচ্ছু নেই।

এতে মদ খাওয়ার কোনও ভূমিকা ছিল না। যেটাই হত, সেটাই একমাত্র হওয়ার ছিল, যেকোনো সময়ই। মদ খাওয়া, মদ খাওয়ার প্রয়োজন— অন্য সবকিছুর মতোই নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে ও নিইলকে জাগানোর চেষ্টা করল। নড়লচড়ল একটু, কিন্তু ঘুম ভাঙলো না। ফলে শরীরটা গরম রাখতে এধারে ওধারে একটু হাঁটাহাঁটি করল গ্রেস, পা কীভাবে যুতমত ফেলা যায়, সেটারও প্র্যাকটিস হল খানিকটা— বুঝতেই পারল এবার যে সকালে ও আবার কাজকর্ম সবই করতে পারবে, ব্রেকফাস্ট এনে দিতে পারবে।

আরেকবার চেষ্টা করল কথা বলার, যেন খুব জরুরি কিছু, এক্ষুণি বলতে হবে। উত্তরে নিইল ভরসা দিয়ে অস্ফুটে কীসব বলল, তারপরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। চারপাশ যখন সত্যি অন্ধকারে ঢেকে গেল, তখন হাল ছেড়ে দিল গ্রেস। রাতের শৈত্য যখন এসে থিতু হয়ে বসতে শুরু করেছে, কিছু অন্য বাস্তবিকতাও ওর কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল। ওদের পক্ষে যে ওখানেই থেকে যাওয়া সম্ভব নয়, যত যাই হোক, পৃথিবীতেই আছে তখনও ওরা। আর, ওকে যে বেইলিজ ফলসে ফিরে যেতে হবে।

নিইলকে প্যাসেঞ্জারের সীটে টেনে আনতে বেশ বেগ পেতে হল। এতেও যদি না জাগে, তাহলে কিছুই ওকে জাগাতে পারবে না— এ একেবারে পরিষ্কার। কীভাবে হেডলাইট জ্বালাতে হয় সেটা বের করতে কিছুটা সময় লাগল ওর, তারপর গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল ও, ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে, ধীরে, ফের রাস্তার দিকে।

দিকের হদিস ছিল না একেবারেই, রাস্তায় জনমানবটি নেই যে জিজ্ঞেস করে নেবে। ও কেবল শহর যেদিকে তার বিপরীত দিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, আর ঈশ্বরের আশীর্বাদে, ঐ রাস্তার ওপরেই দেখল একটা বোর্ড, নানা জায়গার দিকনির্দেশ করছে, তার মধ্যে বেইলি’জ ফলসও আছে। মাত্র ন’মাইল।

পাশাপাশি দুটো গাড়ি যেতে পারে এরকম হাইওয়ে ধরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, গতিবেগ কখনো ঘণ্টায় তিরিশ মাইলের ওপরে না তুলে। গাড়িঘোড়া বিশেষ ছিল না রাস্তায়। একটা কি দুটো গাড়ি পিছন থেকে এসে ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় হর্ন দিয়ে গেল। অল্প যে কয়েকটা উলটোদিক থেকে এসেছিল, তারাও হর্ন দিয়ে গেল। একটার ক্ষেত্রে সম্ভবত ও বড্ড ধীরে চালাচ্ছিল বলে, আর অন্যটার বেলায়, গাড়ির আলো কী করে কমাতে হয় ও জানত না বলে। ও তাতে আমল দিল না। গাড়ি থামিয়ে আবার রাস্তার মাঝখানে সাহস সঞ্চয় করে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওর আয়ত্তে ছিল শুধু কোনওভাবে চালিয়ে যাওয়া, নিইল যেটা বলেছিল। চালাতে থাকো।

অপরিচিত পথে এসে হাজির হওয়াতে, ও প্রথমটায় বেইলি’জ ফলস বলে চিনতে পারেনি। কিন্তু যখন পারল, এই ন মাইলে যেটুকু ভয়ভয় করছিল তার চেয়েও বেশি ভয় এসে ভর করল ওর ওপর। অজানা জায়গার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া এক জিনিস, আর হোটেলের গেট দিয়ে গিয়ে ঢোকা একেবারেই অন্য জিনিস।

গাড়িটা যখন গিয়ে পার্কিং লটে থামলো, নিইল তখন জাগা। ওরা তখন কোথায়, বা গ্রেস যা সব করেছে, সেই নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখাল না নিইল। আসলে, অনেক মাইল আগেই গাড়ির হর্নের আওয়াজে ও জেগে গিয়েছিল, কিন্তু ঘুমের ভাণ করে পড়ে ছিল, কেননা গ্রেস যাতে ঘাবড়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি ছিল। তবে কোনওরকম উৎকন্ঠাই ওর হয়নি। ও জানত যে গ্রেস পারবে।

গ্রেস ওকে জিজ্ঞেস করলো গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার মত যথেষ্ট জেগেছে কিনা।

“জেগে চোখ বড় বড় করে মেলে রয়েছি ভাই। ডলারের মত ঝলমলে।”

গ্রেসকে চটি থেকে পা বের করে আনতে বলে, ধরে দেখল, এখানে ওখানে একটু চাপ দিল, তারপর বলল, “বাহ্, গরম হয়ে নেই, ফোলে টোলেনি। হাতে ব্যথা আছে? নেই সম্ভবত।’’ দরজা পর্যন্ত গ্রেসকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল নিইল, তারপর সঙ্গ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানালো। নিরাপদে ফিরতে পেরে তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি গ্রেসের। খেয়ালই করেনি যে তখন ওকে গুড নাইট বলার কথা।

সত্যি বলতে কী, আজ পর্যন্ত ও জানে না ঐ কথাগুলো বলা হয়েছিল কিনা, নাকি নিইল শুধু গ্রেসকে ধরে, হাত দিয়ে ওকে বেষ্টন করে, শক্ত করে চেপে ধরে ছিল, ক্রমাগত হাতের চাপ এমনভাবে বাড়ছিল কমছিল যে মনে হচ্ছিল দু’টোর বেশি হাতের যেন প্রয়োজন, গ্রেসকে পুরোটা ঘিরে তখন নিইল, শরীরটা হালকা কিন্তু শক্তিশালী, একইসঙ্গে যেন দাবিও করছে আবার ছেড়েও দিচ্ছে, নিইল যেন বলতে চাইছিল ওকে ছেড়ে দিয়ে গ্রেস ভুল করছে, কোনও কিছুই অসম্ভব নয়, তারপরেই আবার যেন জানাতে চাইছে যে ভুল হচ্ছে না, ও আসলে চাইছিল গ্রেসের ওপরে একটা ছাপ রেখে চলে যেতে।

খুব সকালে, ডর্মিটরির দরজায় টোকা দিয়ে ম্যানেজার গ্রেসকে ডেকেছিল।

বলেছিল, “কেউ একটা ফোন করেছে। কিছুই না, ওরা জানতে চাইছে তুমি এখানে আছো কিনা। আমি বলেছি যে আমি গিয়ে দেখে এসে বলছি। এইটুকুই।”

ম’রিই হবে বলে গ্রেসের মনে হয়েছিল। ওদের মধ্যেই কেউ একজন। তবে সম্ভবত ম’রিই। এবার ম’রির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হবে।

 ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করতে নিচে নেমে— পায়ে ক্যানভাসের জুতো— দুর্ঘটনাটার কথা শুনেছিল গ্রেস। লিটল সাবোট লেকে যাওয়ার রাস্তায় মাঝামাঝি দূরত্বে একটা ব্রিজের মোড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে ওখানেই নিচে পড়ে যায় গাড়িটা, পুরোপুরি দুমড়ে মুচড়ে, পুড়ে গিয়েছিল। অন্য কোনও গাড়ি এতে জড়িত ছিল না, মনে হচ্ছে কোনও প্যাসেঞ্জারও ছিল না গাড়িতে। দাঁতের যে বিবরণ নথিবদ্ধ থাকে, সেটার মাধ্যমে গাড়ির চালককে সনাক্ত করতে হবে। হয়তো ততক্ষণে করা হয়েও গিয়েছে।

“কী বিচ্ছিরিভাবে মৃত্যুবরণ,” ম্যানেজার বলেছিল। “এরচেয়ে গিয়ে নিজের গলাটা কেটে ফেলা ভাল।”

 রাঁধুনির স্বভাবটা আশাবাদী ধরনের, সে বলেছিল, “দুর্ঘটনাও তো হতে পারে, নেহাতই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল।”

“তা অবশ্য হতেই পারে।”

এবারে গ্রেসের হাতটা ব্যথা করে উঠল, যেন জঘন্য একটা আঘাত পেয়েছে। ট্রেটা সোজা করে ধরে রাখতে পারছিল না, দুহাতে ধরে শরীরের সামনে এনে কোনওরকমে বয়ে নিয়ে যেতে হল।

ম’রির সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের মধ্যে আর ওকে যেতে হয়নি। ম’রি ওকে একটা চিঠি দিয়েছিল।

‘‘শুধু বল যে ও তোমাকে বাধ্য করেছিল। শুধু বল যে তুমি যেতে চাওনি।’’

 তিনটি শব্দে ও উত্তর লিখে পাঠিয়েছিল। ‘আমি যেতেই চেয়েছিলাম।’ সঙ্গে যোগ করতে যাচ্ছিল, ‘আমি দুঃখিত’, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করেছিল সেটা লেখা থেকে।

মিস্টার ট্র্যাভার্স একদিন হোটেলে এসেছিলেন ওকে দেখতে। ভদ্র ব্যবহার করছিলেন, কাজের কথা ছাড়া বলছিলেন না, দৃঢ়, শান্ত, এতটুকু কঠোর নন। এবার ওকে দেখা গেল এমন একটা পরিস্থিতিতে, যেখানে উনি স্বনির্ভর। একজন লোক যিনি দায়িত্ব নিতে পারেন, এলোমেলো জিনিসকে সুবিন্যস্ত করে তুলতে পারেন। বললেন যে খুবই দুঃখবহ ঘটনা, ওরা সকলেই খুব দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু মদের প্রতি এই আকর্ষণ এক ভয়ানক জিনিস। মিসেস ট্র্যাভার্স একটু সেরে উঠলে ওকে কোথাও একটা বেড়াতে নিয়ে যাবেন, একটা অবকাশ, শীত যেখানে একটু কম।

তারপর উনি বললেন যে ওকে যেতে হবে, অনেক কাজ রয়েছে। বিদায় নিতে গিয়ে করমর্দন করার সময় হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

 বলেছিলেন, “আ্মাদের দুজনেরই বিশ্বাস, তুমি এটা ঠিকমত কাজে লাগাবে।’’

একহাজার ডলারের একটা চেক। তক্ষুণি ওর মনে হয়েছিল যে ওটা ফেরত পাঠিয়ে দেবে কিংবা ছিঁড়ে ফেলবে, এমনকি এখনও মাঝেমাঝে ওর মনে হয় যে সেটা করলেই খুব ভালো হত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, অবশ্যই ও সেটা করতে পারেনি। তখনকার দিনে ঐ পরিমাণ টাকা জীবনটা ভালো করে শুরু করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

** অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (২য় পর্ব)
** অ্যালিস মানরোর গল্প || আসক্তি (সূচনা পর্ব)

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়