ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শহীদুল জহির ও গভীরভাবে অচল মানুষের ভার

মাহবুব টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৮, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ১৫:৫৪, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
শহীদুল জহির ও গভীরভাবে অচল মানুষের ভার

‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;

আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছবার সময় আছে,

পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।

জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা

অন্য সবাই বহন করে করুক, আমি প্রয়োজনবোধ করি না।

আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ

হয়ত এই নবীন শতাব্দীতে

নক্ষত্রের নীচে।’

[উনিশশো চৌত্রিশের- জীবনানন্দ দাশ]

সম্পদ ও সাফল্যের পেছনে মানুষ আদিকাল থেকেই ছুটছে আর বর্তমানে এটা ছাড়া তার জয়যাত্রা অসম্পূর্ণ। আশা ও হতাশার কথা, ১ শতাংশ মানুষ তাদের জয়যাত্রা পূর্ণ করতে পারলেও ৯৯ ভাগেরই কপালে শিঁকে আর ছিঁড়ছে না। হালে পণ্য উৎপাদন, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, বিবিএ-এমবিএ, সিইও, প্রফিট, হাই স্যালারি, বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বাজেট- এসব খুব উচ্চারিত অভিধা। মানুষ এসব অ্যাচিভ করতে হরদম দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে ভোর থেকে রাত, পাহাড় থেকে পাতাল, প্যারিস থেকে দুবাই। সম্ভবত মানুষের এ প্রবণতা সহজাত বলে প্রফিট ও সারপ্লাস ভ্যালুর ইঁদুর দৌড়ের এ বেমক্কা চক্কর শেষ হচ্ছে না। গল্পকার শহীদুল জহির এই দৌড়কে অস্বীকার করেন নাই, বোঝার চেষ্টা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, মানুষ এই দৌড়ের মধ্যে আরামে নাই। তাঁর কয়েকটি গল্পে দেখি এর মূল চরিত্ররা এই দৌড়ে সামিল নয়, তারা যেন একটা ম্যারাথন রেসের পাশে দাঁড়িয়ে দৌড়ের উপর থাকা সারি সারি মানুষের পার হয়ে যাওয়া দেখছে। তারা নক্ষত্রের নিচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা এ পৃথিবীর একটা ভীষণ অচল, অকেজো মানুষ।

শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) খুব বেশি গল্প লেখেন নাই ‘পারাপার’ (১৯৮৫) গ্রন্থে ৫টি, ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৯৯)-তে ৮টি এবং ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৪)-এ ৬টি (মোট ৭টি গল্প, ১টি পুনঃপ্রকাশিত), ‘শহীদুল জহির সমগ্রে’ (পাঠক সমাবেশ) অপ্রকাশিত ৪টি গল্প রয়েছে। কিন্তু সামান্য কয়েকটি গল্প দিয়েই তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন, অনুসন্ধিৎসু ও মননশীল পাঠকের কাছে একজন বিস্ময়কর লেখক হিসেবে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও এর নানামাত্রিক পর্ব ও পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ ও তার প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যস্ততা, সমাজে পচাগলা রাজনীতির কর্কশ কামড়, পুরান ঢাকার কোলাহলময় ও যৌথ জনসংস্কৃতি, মৌলবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান ও তৎপরতা, হিন্দু নিপীড়ন, ভূমিহীন কৃষক ও দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন,...আর যাদুবাস্তবতা- মোটা দাগে এসবই শহীদুল জহিরের গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে ঘুরেফিরে আসে। এর বাইরেও তাঁর গল্পে নানা স্বর ও স্বাদ লেগে থাকে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।

‘পারাপার’-এর গল্পগুলো ১৯৭৪-৭৬ সালে লেখা যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বইটি ছাপা হয় তাঁর পূর্বনাম শহীদুল হক নামে। এ নামে তখন আরো দুজন লেখক জীবিত থাকায় নিজের ‘হক’টাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি দাদার কাছ থেকে জহির ধার করলেন। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, মার্ক্স-মাওয়ের লাল মোড়কের রঙিন বই ও সাদাকালো দার্শনিক চেতনা তাকে প্রভাবিত করে। আবার সংঘের যোগ্য লোক মনে না হওয়ায় তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। কিন্তু সংস্কৃতি, সমাজ ও মানুষকে দেখার ও বোঝার যে কায়দা-কৌশল তিনি রপ্ত করেছিলেন সেটা ছিল মননশীল সমাজবিজ্ঞানীর মতো এবং পরবর্তীতে তা নানা লেখায় প্রভাব রেখেছিল।

‘পারাপার’-এর সব গল্পের মূল চরিত্র নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষ। রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, কুলি, কৃষক, সুইপার এদের জীবনের নানা সংগ্রাম ও টানাপোড়েন আর চকিতে ঘটে যাওয়া দাগকাটা ঘটনাপ্রবাহ এসব গল্পের মূল সুর। জীবনের সেই চকিত ঘটনায় তারা বৈভবপ্রাপ্ত হয়, তাদের পরাজিত জীবন জয়ী হয়ে ওঠে। পরে তিনি তাঁর অবস্থান বদল করেন। জীবনকে জয়ী করার রোমান্টিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে যাপিত জীবন তুলে ধরার দিকে মনোযোগী হন।

‘চতুর্থমাত্রা’ (ডুমুরখেকো মানুষ, ১৯৯৮) গল্পের আঙ্গিক আলাদা ধাঁচের, এর ন্যারেটিভ সরলরৈখিক নয়, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো। গল্পের সকল বিবরণ তৃতীয় বন্ধনীতে আবদ্ধ, সংলাপসমূহ (খুবই অল্প) মুক্ত। পুরান ঢাকার মহল্লার বেশিরভাগ লোকজন একে অপরের পরিচিত থাকে কিন্তু এ গল্পের আব্দুল করিম সবার অপরিচিত; সে একাকী ও নিঃসঙ্গ। কিন্তু সে প্রতি মুহূর্তে নারী, শিশু ও বিত্তহীন শ্রেণির সাথে সংলাপ ও সম্পর্কে জড়াতে চায়, সেখানে সে জীবনের সন্ধান করে। সে কিছু করে না, না কোনো কাজ, না কোনো ধান্দা পেট চালানোর। দরজা ভিজিয়ে সে দিনরাত নিদ্রা ও তন্দ্রা যায়, আর বই পড়ে আর ব্যাখ্যাহীন পাগলামী করে। ঘর ও আঙিনার বাইরে তার কোনো পৃথিবী নাই। ভাংগারিওয়ালার সঙ্গে সে যেচে আলাপ করে, ৪০০/৫০০ গ্রাম কাগজ বিক্রি করে, তাকে পানি খাওয়ায়। কাগজের দাম আটআনা কম পাওয়াতে এই বলে মৃদু ক্ষোভ প্রকাশ করে- ‘আপনে জুলুম করলেন।’ আর নিজের কাগজ শেষ হয়ে গেলে উল্টো তার কাছ থেকে আবার কাগজ কেনে। ঘরের সাজানো তাকিয়া থেকে গ্লাস ভেঙে দরজার বাইরে ফেলে রাখে মহল্লার হল্লারত শিশুদের জন্য। ভাঙা কাচ দিয়ে তারা মিঠাইওয়ালার নিকট থেকে কটকটি কেনে ও ভাগে কম পড়লে মারামারি করে রক্তাক্ত হয়। তখন তাদের অভিভাবকেরা এসে তাকে ভর্ৎসনা করে কম গ্লাস রাখার জন্য। এসব ঘটনা একইভাবে বারবার ঘটতে থাকে। এর বাইরে সে তন্দ্রা ও স্বপ্নে ডুব দেয় আর ভেসে ওঠে ধলেশ্বরীর পাড়ে। নদী শুকিয়ে সেখানে শুকনো পাকা ধানক্ষেত পড়ে থাকতে দেখে সে। কিন্তু সে স্বপ্নেও কর্তৃত্বপরায়ণ ফড়িয়ার খবরদারি করে যেন তারা স্বপ্ন দেখার ঠিকাদার। এসবের বাইরে তাকে আলোড়িত করে দুজন নারী। তাদের একজন কাজের বুয়া মরিয়ম, প্রাত্যহিক জীবনধারণের আয়োজন সম্পন্ন করে তাকে ডাকে, কিন্তু সে সাড়া দেয় না।

‘আব্দুল করিমের পায়ের কাছে কচু পাতার ওপরকার পানির মত তরল নারী টলমল করবে, আমরা দেখব কিন্তু সে দেখবে না। সে পায়ের কাছে মরিয়মকে নিয়ে ঘুমোবে।’ কিন্তু আব্দুল করিম জীবনকে ভালোবাসে বলেই কখনো কখনো অহেতুক ‘বুয়া... বুয়া’ বলে ডেকে ওঠে আর তখন বাইরের ঘরের ভেজানো কপাটে খিল পড়ে।

‘‘চতুর্থমাত্রা’য় জয়ী না দেখানো হলেও এই গল্পে জীবনের চেহারা তুলে ধরার একটা ব্যাপার আছে, অনেক মশকারি আছে এবং এই জীবনের সঙ্গে আব্দুল করিমের মতো লোকের সম্পৃক্ত থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছে। গল্পের একটা কাজের মেয়ের চরিত্র আছে। এটা অধঃপতন না, এইটা তাদের জীবন। এই জীবনে আমরা তাদের ঢুকায়া দিছি।’’

[কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শহীদুল জহির]

অন্য এক নারী ভূতের গলিতে আগন্তুক হয়ে আসে মোহাম্মদ সেলিমকে খুঁজতে। মরিয়মের জন্য তার সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হলেও শুধু আগন্তুক ওই তরুণীর জন্য সে দরজা খুলে বাইরের উঠানে বের হয়। এরপর টবের লাল ফুল মাথার পাশে রেখে বেঞ্চিতে শুয়ে থেকে সে ওই নারীর প্রতীক্ষা করে। এর বাইরে জগতের কিছু সে পরোয়া করে না। আব্দুল করিমের জীবনের মতো এই গল্পও ঘটনার ঘনঘটাহীন। আর অল্প যে ঘটনা পাই তা পুনর্বার ঘটতে থাকে। তবু আব্দুল করিম ও ভূতের গলির জনাকয়েক মানুষকে নিয়ে রচিত কয়েকটি চলচ্চিত্রিক সিক্যুয়েন্স আমাদের মাথায় আটকে থাকে, ভুলতে পারি না।

‘কোথায় পাব তারে’ (ডলু নদীর হাওয়া, ১৯৯৯) নামটিতে মনের মানুষকে খোঁজার মরমী হাহাকারের বেদনা ও আকুতি আছে। যদিও গল্পের ন্যারেটিভে খুবই সামান্য ঘটনা বা কাহিনি হাজির থাকে। এর পটভূমিও পুরান ঢাকার দক্ষিণ মৈশুন্দি ও ভূতের গলি। ‘চতুর্থমাত্রা’র সিক্যুয়াল হিসেবেও একে ভাবা যেতে পারে যেখানে আব্দুল করিমের তরুণ বয়সের প্রসঙ্গ আমরা জানতে পারি।

আব্দুল করিম ভূতের গলির বাসিন্দাদের কাছে ভোদাই, ভোন্দা ও গাধা হিসেবে পরিচিত। সে বাবার নাটবল্টুর ব্যবসার হাল ধরতে চায় না, উপরন্তু সে বলে বাবার সাথে তার ‘মিল খায় না’। মহল্লাবাসীর অভিযোগ, সে খালি ‘নিজেরে লয়া’ থাকে। তাই তারা এ ঘোর নিদান থেকে তাকে রক্ষা করতে আয়োজন করে ডাইলপুরি কিনে তার জন্য অপেক্ষা করে। পাকা সেয়ানার মত ডাইলপুরি খেয়ে সে আহাজারি করে, ‘ডাইলপুরির মইদ্দে ডাইল নাইকা, হুদা আলু!... এই হালারা আলু দিয়া কেমুন ডাইলপুরি বানায়!’ আর সে সবাইকে অবাক করে গলাবাজি করে বেড়ায়, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলে, আর বলে সে মৈমনসিং থেকে আলু, ডাইল ও আখের গুড় এনে মহল্লাবাসীকে সাপ্লাই দিতে পারে। কারণ শীঘ্রই সে ফুলবাড়িয়ায় তার বন্ধু শেফালির কাছে বেড়াতে যাবে। এভাবে বাখোয়াজির খেল জারি রেখে সে নিজেকে জীবনের নানা প্যাঁচ ও পাঁক থেকে দূরে রাখে। বলতে গেলে এর বাইরে সে আর কিছুই করে না। কিন্তু মহল্লাবাসীর কাছে মনে হয়, সে তাদের সাথে যা করে, সেটা বদমায়েশি, ইয়ার্কি, মশকরা ও রসিকতা। এতসব তৎপরতায় তাদের মনে হয়- ‘খোরশেদ আলমের এই পোলাটা হালায় দেখছনি কেমুন সেয়ানা হয়া উঠছে।’ অথচ ইতিপূর্বে আব্দুল করিমের জীবনে কিছু না করার ব্যাপারে প্রায় সন্দিহান ও শঙ্কিত ছিল তারা। ‘খোরশেদ আলমের এই বেকার ছেলেটার মানুষ হতে পারার আর সম্ভাবনা নাই।’

পুরান ঢাকার বাসিন্দারা খুব লাউড হয়, সবসময় গল্প-আড্ডায় মশগুল থাকে। সকালে বিবাদ হলেও বিকেলে আবার একসঙ্গেই পান, চা-পুরি খায়। অন্যের ভালো-মন্দে তাদের নজর ও খেয়ালের কমতি থাকে না। তাই আব্দুল করিমের শেফালিদের বাড়ি বেড়াতে যাবার খবরে তাদের দিন ভীষণ উত্তেজনায় কাটে, তারা কানাকানি করে, বলে, ‘হালায় প্রেম করে নিহি!’ আর আব্দুল করিম সংক্রান্ত এই জটিলতায় পড়ে তাদের বাকি সবকিছু অর্থহীন ও বিস্বাদ হয়ে পড়ে। ‘আমাদের মনে হয় যে, আইএ পাশ বেকার এবং অলসের রাজা আব্দুল করিম আসলে মহল্লার লোকের সঙ্গে খেলা করে। সে তার পিতার ক্রমাগত অভিযোগ এবং গালমন্দের মুখে দিশাহারা হয়ে এই কায়দা বের করে; তার এইসব কথার কোন মানে নাই, সে জীবনে কোথাও যায় নাই এবং যাবে না।’

কিন্তু সত্যি সত্যি আব্দুল করিম ফুলবাড়িয়া যাবার জন্য তৈরি হতে থাকলে এবং শেফালির ব্যাপারটা সত্যি প্রমাণিত হলে তারা নতুন পরিস্থিতির মুখে পড়ে। ‘ভূতের গলির লোকদের কাছে তখন আব্দুল করিম এবং তার ময়মনসিংহ যাওয়ার প্রসঙ্গের চাইতে শেফালি প্রসঙ্গ বড় হয়ে ওঠে, দক্ষিণ মৈশুন্দি এবং ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে, তাদের মনে হয় যে, আব্দুল করিম বেকার বলেই তার পক্ষে এইসব করা সম্ভব; তখন মহল্লার লোকেরা বেকার থেকে প্রেম করাকে ঘৃণা করতে শেখে; তারা ভুলতে পারে না যে, শেফালি একটা মেয়ে এবং আব্দুল করিম বলে যে, সে তার বন্ধু! ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘ্নিত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে তারা বিছানায় জেগে থাকে, জীবনের ব্যর্থতা এবং অপচয়বোধ তাদের গ্রাস করতে উদ্যত হয় এবং তারা কেমন বিষণ্ন হয়ে পড়ে, তাদের মনে হয় যে, বেকার থাকাই তো ভালো আব্দুল করিমের মত।’

অলস প্রেমিক আব্দুল করিম তার প্রেমের তত্ত্বতালাশে অবশেষে ফুলবাড়িয়ায় রওনা দেয় মহল্লার পাড়াতুতো ভাই দুলালের সাথে। তার মনে হয় সেখানে গেলে তার মনের মানুষকে পেলে পেতেও পারে। এতে সে ‘কোথায় পাব তারে’ জীবনের এ হাহাকার থেকে নিষ্কৃতি পাবে। কিন্তু জীবনের জটিলতার মত তার জুতার ফিতায় জট লেগে গেলে সে ফিরে আসে, সম্ভাব্য মনের মানুষের কাছে তার আর যাওয়া হয় না।

‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ ( প্রথম প্রকাশ ‘আবহমান’- ২০০৪) গল্পের মূল চরিত্র সুহাসিনী গ্রামের ভূমিহীন হতদরিদ্র কৃষক ফৈজুদ্দিন ফজু। সে অতিদরিদ্র তাই রোগা, টিংটিঙা ও দুর্বল। লোকজ গল্পের ‘পিপুফিশু’ (পিঠ পুড়ছে, ফিরে শুই) সে অর্থাৎ অলসের বাদশা। গ্রামে তার বাঁশ-শন-খড়ের তৈরি ভাঙা কুঁড়েঘর, সেখানে সে অলস দিন ও রাত পার করে, একসময় সংসার শুরু করে নতুন বউ গুলনেহারকে বলে, ‘এত কাম হইরা কি আমি জমিদার হমানে।’ কর্ম না করে শুয়ে-বসে সময় পার করার জন্য গল্পের কথক তাকে ‘দার্শনিক’ বলে ঠাট্টা করে, গ্রামের অন্যদের মতো। ফজুর জমি নাই, ঘরে চাল নাই, প্যাটে ভাত নাই, স্ত্রী কচু-ঘেচু, শাক-লতাপাতা কুড়িয়ে যা খেতে দেয়, তাই খেয়েই থাকে। সে তার স্ত্রী ও গ্রামবাসীকে বোঝায়- ‘সে তার ভিটার সামনের দিকে বিচিকলা গাছের ঝোপের পাশে খোলা আকাশের তলায় একটা বাঁশের মাচান বানায় এবং তখন গ্রামের যারা দ্যাখে, তারা যদি তাকে প্রশ্ন করে, যদি বলে, কী করবু মাচান বানায়া, সে উত্তর দেয়, শুয়া থাকমু বাপু।’

গল্পের তিনটি চরিত্রের অন্যজন সুহাসিনী গ্রামের তালুকের মালিক থুড়থুড়া বৃদ্ধ আব্দুল কাদের মিঞা। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার প্রধান কাজ বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে নিজের দিগন্ত বিস্তৃত শতশত বিঘা জমির লকলকে ধানের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলা। ফজুকে ভেতরে ভেতরে তার কিঞ্চিত ঈর্ষা হয়, বলে, ‘বুড়া আব্দুল কাদেরের খুব রাগ হয়, হতেই পারে, সে ফজুকে বলে, তার এইসব নবাবি ভালো না একদম, সে কাজকাম না করে বাঁশের মাচান বানায়া শুয়া থাকে, ঠ্যাঙের উপরে ঠ্যাং তুলে দিয়া নাচায় এগুলো খুব খারাপ।’

গুলনেহার কিন্তু ফজুর আঁটোসাটো ও টাইট সংসারের খাপে টিকে যায় কোনো আক্ষেপ ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়াই। গ্রামবাসী এই টিকে যাওয়ায় খুব অবাক হয়, তাকে যখন প্রশ্ন করে, ছন-খড়ের ভাঙা ঘরে লতাপাতা খায়া কীভাবে থাকে? সে নির্লিপ্তভাবে জানায় ‘থাইকলে থাকা যায়।’ গুলনেহার জানে ফজু সংবেদনশীল মানুষ যার ভেতরে রয়েছে তার জন্য নিঃশর্ত প্রেম।

‘চতুর্থমাত্রা’ ও ‘কোথায় পাব তারে’ গল্পের তুলনায় এর গল্প খানিকটা বেশি বলা চলে। এখানেও ঘটনা পৌনঃপুনিক ঘটতে থাকে, উপরোক্ত দুটি গল্পের মতো। কাদেরকে নিয়ে ফজুর ধানক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটা, কাদের জুতা চেঙা মারলে দুই টাকার বিনিময়ে তা কুড়িয়ে আনা, ধাড়ি ইঁদুর মারার জন্য ফজুর খেটেখেটে ‘হয়রান’ হওয়া এবং পাঁচ টাকা পাওয়া, টাকার এ জটিল হিসাব মিলাতে না পেরে স্কুলের মাস্টারের শরণ নেয়া, পরে টাকা পেয়ে মাছগোস কিনে টেলটেলা তরকারি দিয়ে বউকে নিয়ে হাপুসহুপুস খাওয়া- এ ঘটনাসমূহ পুনর্বার ঘটতে থাকে। কাদের তাকে বান্দা কামলা হবার লোভ দেখায়, উন্নত জীবনের সম্ভাবনার কথা বলে কিন্তু কুঁড়ের বাদশা ফজু তা প্রত্যাখ্যান করে। আত্মাভিমানের কারণে প্রথমে সে জুতা কুড়িয়ে আনতে অস্বীকার করে, বলে, আপনার কামলা দিয়ে আনায়েন। ফজুর বাবার পালানের জমি, যেটা এখন কাদেরের জবরদখলে, ২/৩ বছর কামলার বদৌলতে সেটা ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাবও ফজু ফিরিয়ে দেয়। বরং সে উল্টো তার বউ গুলনেহারকে বান্দি রাখার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু গুলনেহারের সাথে ব্যাখ্যাহীন রহস্যময় মনোদৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া কাদের চায়না বারান্দায় তার সাথে ব্যস্ত থাকা গুলনেহার ভিতর বাড়ির দাসিবান্দি হোক। বাড়ির ভিতর কামলা-চাকরসহ বারো রকমের মানুষ, মেয়েটাকে তার হারাবার ভয় হয়। কাদেরকে গুলনেহার যে সেবা প্রদান করে- তামুকের নিভে যাওয়া আগুন জ্বালিয়ে দেয়া, মাথায় বকের গু পানিতে ধুয়ে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয়া, এর প্রতি কাদের লোভাতুর থাকে। আর থেকে থেকে তার ভেতর আফসোসের বুদবুদ তৈরি হয়।

‘তখন আব্দুল কাদেরের মনে হয় এমন কথা সে কোনদিন শোনে নাই এবং সে বিহ্বল হয়ে পড়ে, এই বিহ্বলতার ভিতর থেকে একসময় জেগে উঠে সে বলে, দ্যাখ্ ক্যাবা বুড়া হয়া গেছি, এইসব জমিন, সব ধান আমার, দ্যাখ্ আমি ক্যাবা বুড়া ঝুজঝুরা হয়া গেলাম।’

শহীদুল জহিরের অচল মানুষদের মধ্যে ফৈজুদ্দিনই শেষপর্যন্ত আর টিকতে পারে না। কার্তিকের হিমে ধানক্ষেতে শুয়ে অলসতায় ঘুমিয়ে গেলে তার আর জেগে ওঠার সাধ হয় না, কুয়াশা ও ঠান্ডায় হাইপেথেলমিয়া হয়ে সে মারা যায়। গুলনেহারের মায়াভরা পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়।

ফজু বা আব্দুল করিমরা শহীদুল জহিরের বাকি গল্পের চরিত্রের মতোই সমাজ-রাষ্ট্রের চাপে পিষ্ট খুব সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষ। তারা বিত্তহীন, ক্ষমতাহীন তো বটেই। জগতের অন্যতম প্রধান প্রবণতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘কিছু না করার’ এক বিপজ্জনক খেলায় তারা নিজেদের জারি রাখে। নবীন শতাব্দীর এ কেজো দুনিয়ায়, জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনায় ভোগা মানুষের ভিড়ে এ অকেজো, অচল মানুষকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল হয়। তাদের বোঝার আগে ঐ দৌড়াতে থাকা মানুষদের আরো বোঝা দরকার।

মানুষের দৌড় বা ছোটাছুটির পেছনে কাজ করে ভেতরের তাড়া ও পেছনের নাড়া। মহামতি সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেন, মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে বাসনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ভেতর থেকে নাড়া দেয় তার ডিজায়ার। অর্থাৎ তার নিজের লাগাম বাসনার কাছে জমা রেখে সে দৌড়ায়, তার নিয়ন্ত্রণ তার নিজের হাতে থাকে না। আর পেছন থেকে অদৃশ্য চাবুক দিয়ে নাড়া দেয় কর্পরেটতন্ত্র। চাবুকটা আবার থাকে ক্যাপিটালিজম নামক এক সুদর্শন দানবের হাতে। গোলমেলে এ বিষয় নিয়ে আরেক মহামতি কার্ল মার্ক্স ‘দাস ক্যাপিটাল’ নামক মহাগ্রন্থ লিখেছিলেন, তবু হয়ত তিনি এ প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

ফৈজুদ্দিন বা আব্দুল করিমদের বুঝতে আমাদের প্রাচ্য সংস্কৃতি ও দর্শনের দিকে ফিরতে হয়। পুরাকালে সন্তু, সাধুসন্যাসী, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বৈষ্ণব বাউল বা সুফিরা নিজেদের বাসনা ত্যাগ করার দীক্ষা নিতেন। শারীরিক ও মানসিক চাওয়া বিসর্জন দিয়ে তারা পৌঁছাতে চাইতেন নির্বাণের এক মায়াময় দুনিয়ায়। ফজু বা আব্দুল করিমরা হয়ত ঐ ভাবনগরের বাসিন্দা।

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়