ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গল্পের দায়, গল্পলেখকের দায়

জাকির তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১২, ৩০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গল্পের দায়, গল্পলেখকের দায়

মানুষ লিখতে শিখেছে কথা বলতে শেখার অনেক লক্ষ বছর পরে। তাই মানুষের নির্মিত প্রথম ছোটগল্পটিও লিখিত নয়, মনে মনে বানানো, মুখে মুখে বলা ও বুকে বুকে ছড়িয়ে পড়া। সুতরাং গল্পের লেখকদের আগে অবধারিতভাবেই আসবে গল্পের মহান কথকদের কথা। এই কথকরা গল্প সৃষ্টি করেছেন, মুখ থেকে মুখে সেগুলি ছড়িয়ে পড়েছে পবিত্র অগ্নিস্তোত্রের মতো, তারপর জমা হয়েছে গোত্রের পুরোহিত বা সবচেয়ে প্রাজ্ঞ মানুষটির বুকে।

পৃথিবীর সকল গোত্র এবং সকল কৌমে এই একই প্রক্রিয়াতে গল্প জন্ম নিয়েছে নিরন্তর। আজও আফ্রিকার দক্ষিণ অংশের মরুভূমিতে ছায়ার মতো জীবনযাপন করে যে খর্বকায় মানুষ, কিংবা অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে বাস করে যে ব্ল্যাকফেলো গোত্রগুলি, তাদের  মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় মুখে মুখে বহমান উৎস-গল্পের চিরায়ত রূপ। তাদের গল্প-কথকরা এখনো গোত্রের মধ্যে মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবেই স্বীকৃত। এ যুগের তথাকথিত সভ্য মানুষ আমরা, কল্পনাও করতে পারব না গোত্রের প্রতিটি মানুষের কাছে কী অপরিসীম মূল্যবান সেই গল্পগুলি! তাদের কাছে গল্পগুলি হচ্ছে অতিপ্রাকৃতের প্রতি ভীতির বিরুদ্ধে সাহসের জোগানদার; ফলত তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণারই আরেক নাম। একটি গল্প বা উপাখ্যান পাওয়ার বিনিময়ে তারা যে কোনো জিনিস দিয়ে দিতে প্রস্তুত। এমনকি কোনো গোত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরপুরুষ হাসিমুখে তার হাতিয়ারটি দিয়ে দিতে পারে এমন একটি গল্পের বিনিময়ে। মনে রাখতে হবে, আদিম গোত্রগুলির কাছে হাতিয়ার শুধুমাত্র তার বীরত্বের স্মারকই নয়; সেইসঙ্গে তার খাদ্য জোগানের প্রধান অবলম্বন ও তার আত্মরক্ষার রক্ষাকবচ। তবু সে পুরোহিতকে একটি গল্পের বিনিময়ে দিয়ে দিতে প্রস্তুত তার হাতিয়ার। কেননা তার বিশ্বাস, গল্প বা উপাখ্যান হচ্ছে এক অলৌকিক চাবিকাঠি। সেই চাবিকাঠি হাতে পেলে সে হতে পারবে প্রকৃতির প্রভু। তার ডাকে সাড়া দিয়ে তখন মাথার ওপর ছায়া বিছিয়ে দেবে মেঘ, বৃষ্টি ঝরবে তারই ইচ্ছায়, বনের পশুপাখি হবে তারই বশীভূত, তার ইচ্ছাতেই প্রবাহিত হবে বাতাস। এই গল্প তাকে অধিকারী করবে সেই হারিয়ে যাওয়া চাবির, যা দিয়ে সে খুলে ফেলতে পারবে তার কৌম-প্রজ্ঞার বদ্ধ দুয়ার, উদ্ধার করতে পারবে তার টোটেম-চিহ্নের গুপ্তপাঠ। গল্প তাই তাদের কাছে ধর্মমন্ত্রেরই আরেক নাম।

বোধহয় সেই একই কারণেই প্রাচীন ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল গল্পের এক বিশাল ঐতিহ্য। ছোট ছোট গল্প-উপাখ্যান নির্মিত হচ্ছিল ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। এদিকে এগিয়ে রয়েছেন গৌতম বুদ্ধ। যীশুর জন্মের প্রায় ছয়শ বৎসর আগে রাজকুমার সিদ্ধার্থ এমন এক ধর্মমত প্রচার করেছিলেন, যা ছিল মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও বস্তুবাদী ধর্মমত। এই ধর্মে রাজা ও নীচুজাতির দলিত প্রজাকে নিতে হতো একই শপথের দীক্ষা ও একই সংঘের শরণ। গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের শিক্ষাদান করতেন উপমাসমৃদ্ধ ছোট ছোট গল্প ও গদ্য-আখ্যানের মাধ্যমে। এইসব আখ্যানের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকত রমণীয় মাধুর্য, এবং তীর্যক ব্যঙ্গ। বুদ্ধের মহানির্বাণের পর তাঁর শিষ্যরাও ধর্মপ্রচারের জন্য এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এঁরাই সংকলিত করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ কথিত আখ্যানগুলি, যাদের সংখ্যা পাঁচশ পঞ্চাশটি। এগুলিই ‘জাতকের গল্প’। বুদ্ধের ধর্ম অনুযায়ী মানুষ বারবার জন্ম নেয়। যদি কোনো মানুষের বর্তমানের জীবনযাপন খুব অধার্মিক ও অপরিণামদর্শী হয়, তবে তার পরের জন্ম হবে হীন সরিসৃপ কিংবা বন্য পশুর জন্ম। অথবা তাদের চেয়েও ভযঙ্কর ও হীন প্রজাতির জীবের জন্ম। বর্তমান জন্মে যদি সে যথেষ্ট পুণ্য সঞ্চয় করতে পারে, তবে তার পরবর্তী জীবন হবে উচ্চতর মানবীয় জীবন। অর্থাৎ একজনের বারংবার পুনর্জন্ম ঘটে। গৌতম বুদ্ধের মতো আলোকপ্রাপ্তরা জাতিস্মর হতে পারেন। তাঁরা তাঁদের সকল জন্মের স্মৃতি ধারণ করতে পারেন। এমনটিও দাবি করা হয় যে, যেসব পশুপাখিনির্ভর গল্প গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের উপদেশনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন, সেগুলি তাঁর বিভিন্ন জন্মের নিজ অভিজ্ঞতার গল্প। বুদ্ধ হিসেবে নির্বাণ লাভের পূর্বে তিনি মোট পাঁচশ পঞ্চাশবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশু-পাখি-মানুষের রূপ ধারণ করে। সেই কারণেই এই পাঁচশ পঞ্চাশটি গল্পের সংকলনের নাম ‘জাতকের গল্প’। এই গল্পগুলি ভারতবর্ষ থেকে পারস্য ও সিরিয়া হয়ে গ্রীসে পৌঁছায়। চতুর্দশ শতকে প্লেনিউড নামক একজন গ্রীক সন্ন্যাসী এই গল্পগুলিকে অনুবাদ করে ঈশপের নামে চালিয়ে দেন। তার ফল দাঁড়ায় এই যে, ঈশপের গল্পের মিথ্যা শিরোনামে গৌতম বুদ্ধের জাতকের গল্পই কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত অবস্থায় আজ পর্যন্ত ইউরোপে প্রচারিত হয়ে আসছে।

লিখিত গল্পের প্রথম নিদর্শনটি পাওয়া গেছে মিশরে। ইতিহাস আমাদের জানিয়েছে এই লেখ্য রূপটির বয়স ছয় হাজার আটশ বছর। গল্পটি মুখে মুখে বলেছিলেন মিশরের তৎকালীন রাজপুত্র খাফ্রি। খাফ্রির পিতা সম্রাট খুফু বা চিওপ্স ছিলেন মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিডটির নির্মাতা। তাঁর এক মজার বাতিক ছিল। তিনি প্রতি সকালে রাজকার্য শুরুর আগে সিংহাসনে বসে পাশে ডাকতেন তাঁর যে কোনো এক পুত্রকে এবং তাকে আদেশ করতেন প্রাচীন মিশরীয় জাদুকর-পুরোহিতদের গল্প শোনাতে। সেভাবেই একদিন পালা এসেছিল রাজপুত্র খাফ্রির। এবং কেন কে জানে, রাজকীয় লিপিকর প্যাপিরাসের পাতায় লিখে রেখেছিলেন এক ব্যাভিচারী রমণী ও জাদুকরের গল্পটি। দ্বিতীয় লিপিবদ্ধ গল্পটিও মিশরীয়। তবে তা আমাদের হাতে এসেছে গ্রীকদের মাধ্যমে। এই গল্পটি আহুরির গল্প নামে পরিচিত। এই গল্পটির সময়কাল ছিল মহান সম্রাট রামিসেস-এর রাজত্বকাল।

তবে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, আধুনিক ছোটগল্প নামক সাহিত্যের যে প্রকরণটি বিশ্বে প্রচলিত, তা মূলত ইউরোপ-উদ্ভূত। ইংরেজ সাহিত্যতাত্ত্বিকরা ১৮০৭ সালকে আধুনিক ছোটগল্পের জন্মসাল হিসাবে ঘোষণা দিয়ে থাকেন। কারণ ঐ বছরটি হচ্ছে নিকোলাই গোগল ও এডগার অ্যালান পো-র জন্মবছর। এই দু’জনই, ইংরেজ সাহিত্যতাত্ত্বিকদের বিচারে আধুনিক ছোটগল্পের প্রথম সার্থক স্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলাভাষায় যে আধুনিক ছোটগল্প, হিরাঙ্গিক ও অন্তর্বয়ন নিয়ে বর্তমান পর্যন্ত প্রচলিত, তা কমবেশি ইউরোপ-উদ্ভাবিত ছোটগল্পেরই বিবর্তিত রূপ। বস্তুত ইউরোপ তার আধিপত্য এখনো বিস্তার করে রয়েছে আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের মতো ছোটগল্পের ওপরেও।

১৯৪৭ সালে অর্জিত পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য পরিমণ্ডলকে পাশ কাটিয়ে আমাদের নিজস্ব পরিমণ্ডল গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। সমাজজীবনের মতো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও এই সময় সাময়িক একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তান নামক স্বপ্নালোকে আচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমান-মানস তখন কেমন বিশৃঙ্খল ও উদ্ভ্রান্ত ছিল তা বোঝা যায় বদরুদ্দীন উমরের একটি উক্তি থেকে। তিনি লিখেছেন: ‘পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলমানদের তাহজীব, তমুদ্দুন ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত ধারণার অবর্তমানে কেউ এ-সবের দ্বারা মনে করল কোরমা, পোলাও, কোফতা ও গরু খাওয়ার স্বাধীনতা। কেউবা আবার মনে করল ভাষার মধ্যে যথেচ্ছভাবে আরবি-ফারসি শব্দের আমদানির স্বাধীনতা।... কারো কাছে এর অর্থ হলো বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে তার স্থলে আলাওল, গরীবুল্লা এবং কায়কোবাদকে অভিষিক্ত করা।’

এমন বিভ্রান্ত পরিস্থিতিতেও বাংলা ছোটগল্প যে তার মধ্যে আধুনিকতার ধারাটি প্রবহমান রাখতে পেরেছিল তার কারণ আর কিছুই নয়, আমাদের তৎকালীন মুখ্য কথাশিল্পীদের ইউরোপীয় চিন্তাধারার সাথে পরিচয় ও তাঁদের ওপর সেই চিন্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। এমনকি এঁদের মধ্যে যারা ইসলাম ও পাকিস্তানপন্থী ছিলেন, তাদেরও কেউ কেউ ইসলামকেও দেখতে চেয়েছেন পাশ্চাত্যের আয়নাতে প্রতিফলনের মাধ্যমে। এই পর্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র কথা বাদ দিলেও আমরা বর্তমান ছোটগল্পের প্রবহমান ধারাপ্রাপ্তির জন্য ঋণী ইবরাহীম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মহীউদ্দীন চৌধুরী, মাহবুব-উল-আলম, আবুল মনসুর আহমদ, আবু রুশদ, শওকত ওসমানদের কাছে। কিন্তু তারপরের ইতিহাস, আমাদের ছোটগল্পের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। একথা সত্য যে বিশ্বমানের বেশ কিছু ছোটগল্প উপহার দিয়েছেন আমাদের গল্পকাররা। কিন্তু সব মিলিয়ে যে ধারাটি সৃষ্টি হয়েছে, তাকে একান্তভাবে বাংলাদেশের গল্পের ধারা বলে চিহ্নিত করা সত্যিই কঠিন। কেননা সেখানে আত্মপরিচয় সন্ধানের কোনো তৎপরতা সেভাবে পরিলক্ষিত হয় নি। তৃতীয় বিশ্বের কালো লড়াকু তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফানোঁর মতো কেউ সেই প্রশ্নটি তীব্রভাবে বাংলাদেশের গল্পে তুলে আনেন নি- ‘আমি আসলে কে?’

অথচ এগুলি সবই বাংলাভাষাতেই লেখা গল্প, পাত্রপাত্রীর নাম দেখে তাদের বাঙালি বলেই মনে হয়, তাদের পরনের কাপড়-চোপড়ও বাঙালিসুলভ, তারা কথাও বলে বাংলাভাষায়, এমনকি কখনো কখনো আঞ্চলিক বাংলাভাষায়। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু যখন অভিনিবেশে লক্ষ্য করা হয় তারা কী কথা বলছে, কীভাবে বলছে, তাদের বলার ব্যঞ্জনা এবং বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ ঠিক কোন তাৎপর্যকে বহন করছে- তখন আর তাকে বাংলার ছোটগল্প বলে শনাক্ত করা মুশকিল। তার উচ্চারিত বাক্যের মর্মার্থ উদ্ধার করা ইউরো-জ্ঞানহীনদের কাছে প্রায় অসম্ভব। এভাবেই বাংলাভাষায় এমন অজস্র সব গল্প লেখা হয়েছে যেগুলি বাংলায় লেখা হলেও মূলত ইউরোপীয় গল্প, নাহলে আরব-ইরান-তুরান-তুরস্কের গল্প, তা নইলে পশ্চিমবঙ্গের ক্যালকেশিয়ান গল্প। মোটকথা বাংলাভাষায় বাংলাদেশে বসে লেখা গল্পে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ অনুপস্থিত। শুধু প্রকরণকে এজন্য দায়ী করা ঠিক নয়। ইউরোপীয় স্যুট-কোটে ঢাকা থাকলেও বাঙালিকে চেনা যায়। সেই রকম পাশ্চাত্য প্রকরণেও নিজস্ব মর্মানুকূল শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব। তা সম্ভব হয়েছে আফ্রিকাতে, লাতিন আমেরিকাতে, এশিয়ারও কোনো কোনো অংশে। কিন্তু আমাদের দেশে হয়নি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো দু’একজন ব্যতিক্রমকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে একথা অক্লেশেই উচ্চারণ করে ফেলা যায় যে আমাদের পূর্বসূরি গল্পকাররা ইউরোপ-আরব-কলকাতার মর্ম-মানসকে অনুধাবন করতে যতটা পরিশ্রম করেছেন, তার শতাংশের একাংশ শ্রম কিংবা মেধা ব্যয় করেন নি আমাদের নিজেদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে বা ছোটগল্পে নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরার কাজে।

এই ঘাটতি পূরণ করে যে গল্প রচিত হবে, তাকে আঙ্গিক দান করাই আমাদের গল্প লেখার প্রধান প্রণোদনা। অথবা বলা যেতে পারে এই আত্মপরিচয়ের গ্লানি মোচন করে যে শুদ্ধ গল্প রচিত হবে, সেটাই হবে ভবিষ্যতের বাংলা গল্পের বীজ। তার অবয়বটি কল্পনা করা যেতে পারে এইভাবে।

আঙ্গিক বা বহিরঙ্গে পরিবর্তন আসবেই। সেই পরিবর্তন সময়ের দাবি। এখনই তার কিছুটা আভাস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রথাগত ইউরো-আঙ্গিক যে বাংলার প্রাণবস্তুকে ধারণে পর্যাপ্ত নয়, তা প্রমাণিত। বাংলার চিরায়ত কথক-আঙ্গিকসমূহ, যেমন পালা-পাঁচালি-উপকথা-রূপকথা-আখ্যান এগুলি আধুনিক আঙ্গিকের সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করবে আমার ভবিষ্যতের বাংলা গল্পের যথার্থ আঙ্গিক। আঙ্গিক তো শুধুমাত্র বাহ্যিক বেশবাসমাত্র নয়; আত্মার ধারক দেহের মতো আঙ্গিকও হচ্ছে গল্পের অন্তর্বস্তুর আধার। সেই উপযুক্ত আধার না পেলে আত্মা নিজের জন্য যেমন কোনো অবয়ব পায় না, তেমনই পায় না কোনো আশ্রয়। সেলিম আল দীনের মতো অদ্বৈতদ্বৈতবাদীদের দেখানো পথে সেই আঙ্গিকের সন্ধানে ইতোমধ্যেই ব্যাপৃত আমাদের বর্তমান প্রজন্মের গল্পকারদের কেউ কেউ। শত বছরের অভ্যস্ততা থেকে সরে আসা, আঙ্গিকের নতুন নির্মাণে আত্মনিয়োগ করার আরেক নাম অবশ্যই চৈতন্যের বিউপনিবেশিকরণ। সেইসঙ্গে তা শিল্পের বিউপনিবেশিকরণও বটে।

আর অন্তর্বস্তু? তার পরিবর্তন তো অপরিহার্য। এবং অবশ্যম্ভাবীও। প্রত্যক্ষ উপনিবেশের যুগ হয়তো শেষ হয়েছে। কিন্তু তার কোনো সদর্থক স্থায়ী ফলাফল পরিদৃশ্যমান নয় আমাদের জাতীয় জীবনে। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে করপোরেট সাম্রাজ্যবাদ যত প্রত্যক্ষ শোষণের শৃঙ্খলে জড়িয়েছে আমাদের দেশের মানুষের জীবনকে, এতটা শৃঙ্খলিত জীবন বোধহয় ঔপনিবেশিক যুগেও অকল্পনীয় ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ শুধু আমাদের রাষ্ট্রের পলিসি নির্ধারণেই হস্তক্ষেপ করছে না, বরং একই সাথে আমাদের শোবার ঘরে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমাদের সক্ষম দম্পতিরা কয়টি সন্তান নিতে পারবে, আমাদের নারীগণ কোন দেশের তৈরি, কোন ফ্যাশনের পোশাক পরবে, আমাদের ফসলের ভূমিতে কোন দেশের বীজ এসে কৃষি-আগ্রাসন চালাবে, আমাদের মিডিয়াগুলিতে কি কি প্রচারিত হবে আর কি কি প্রচারিত হবে না, আমাদের জাতীয় সকল সম্পদ- খনিজ, জীববৈচিত্র্য, পানি, বাতাস- আমাদের মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হবে, না চলে যাবে প্রতিবেশী ও সাগরপাড়ের আধিপত্যকামী দেশের করপোরেট পুঁজির ভোগে। এসবই তারা করতে পারছে বিনা বাধায় কারণ আমাদের রাষ্ট্রের যারা বর্তমান পরিচালক, এবং যারা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিচালক, তাদের সবাইকে ইউরো-আমেরিকা অক্ষশক্তি কিনে নিয়েছে ইহকাল-পরকালসমেত।

এই অপশক্তিগুলির বিরুদ্ধে অন্য সব ফ্রন্টের মতো নিশ্চিতভাবেই শরিক হতে হবে বাংলা ছোটগল্পকে। তাই আমাদের ছোটগল্প নখদন্তহীন হবে না নিশ্চয়ই। শিল্পের নামে ও কলাকৈবল্যের নামে তাকে পথভ্রষ্ট করার সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। হেগেল ও তাঁর মতো হাজার হাজার ইউরোপীয় জ্ঞানতাত্ত্বিক বলেছেন, বিশ্ব মানেই হলো ইউরোপ, ইতিহাসের কেন্দ্রে অবস্থান করছে ইউরোপ, আর ইতিহাস পরিবর্তনের একমাত্র দাবিদার হচ্ছে ইউরোপের সাদা মানুষ। বাংলাগল্প অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের এই চিন্তাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করবে। এদেশের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গৌরবময় উন্মোচনের কাজকে সমানে তুলে আনবে, আর করপোরেট বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার আন্তর্জাতিকীকরণে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হবে।

সব মিলিয়ে বলা যায় আমাদের গল্প হবে একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শোষণমূলক টেক্সটসমূহের বিরুদ্ধে সোচ্চার, একইসঙ্গে হবে জাতীয়তাবোধসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিক, মানুষের সংগ্রামের সহযাত্রী এবং একইসঙ্গে তার শিল্পক্ষুধার নিবৃত্তিকারক, ঋজু কিন্তু মরমীয়া মমত্বসজল, নাগরিক কিন্তু গ্রামীণ সামাজিক আধ্যাত্মিকতার ধারক, বাঙালি সংস্কৃতির রক্ষক কিন্তু আবার বাঙালি সংস্কৃতি যদি আদিবাসী জাতিসত্তার ওপর আগ্রাসী হয়ে ওঠে তবে তার নির্মম সমালোচক, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী কিন্তু সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের ইতিবাচক মূল্যবোধের তর্কহীন ধারক। সকল ভাষার সকল দেশের সব মহৎ লেখকই এই কাজটি করেছেন। এটাই তাদের মহত্বের অন্যতম প্রধান সূত্র।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়