ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বইমেলা নিয়ে

জাকির তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বইমেলা নিয়ে

আমাদের দেশই বোধহয় একমাত্র, যেখানে বইমেলার আয়োজন করে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান। পরোক্ষভাবে সরকার। পৃথিবীর অন্যত্র, যতদূর জেনেছি, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল বইমেলা প্রকাশকদের সমিতিগুলোর মাধ্যমে আয়োজিত এবং পরিচালিত হয়। আমাদের দেশে বাংলা একাডেমির কাঁধে বন্দুক রেখে দিব্যি বইমেলা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকাশকরা। অন্য সব ক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণের দাবি করলেও এই মেলাটি পুরোপুরি রাষ্ট্রের হাতে। এভাবে বছরের পর বছর চলতে চলতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের দেশের মানুষ অন্যরকম কিছু ভাবতেই ভুলে গেছেন। অথচ বাংলাদেশে বইমেলা শুরু হয়েছিল একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারার একক উদ্যোগে।

বাংলা একাডেমি যে বইমেলার আয়োজকের দায়িত্ব পালন করছে, এতে আপাতদৃষ্টিতে আপত্তি জানানোর কোনো কারণ খুঁজে পাই না আমরা কেউ-ই। কিন্তু শেষ বিচারে এতে বরাবরই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা একাডেমি এবং দেশের লেখকরা। বিশেষ করে সেইসব লেখক, যারা তথাকথিত মূলস্রোতের বাইরে কিছুটা হলেও বিকল্প চিন্তা ধারণ করেন।

ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা একাডেমি। কারণ বাংলা একাডেমিকে এই মেলার জন্য ফেব্রুয়ারি তো বটেই, আগের এবং পরের দুটি মাসও পুরো শ্রমশক্তি, চিন্তা, সময়ের পুরোটাই ব্যয় করতে হয় বইমেলার পেছনে। এতে মূল কাজ অনেকটাই ব্যাহত হয়।

আর ক্ষতিগ্রস্ত হন বিকল্প চিন্তার লেখকরা। বিকল্প চিন্তার লেখক মানে, যারা সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানান বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। তারা রাষ্ট্রের কাছে অস্বস্তিকর। ফলে স্বায়ত্তশাসিত হলেও রাষ্ট্রনির্ভর প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি তাদের এড়িয়ে চলতে বাধ্য। সেই লেখকরা ডাক পান না মেলার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সেশনে। ইউরোপে বা মার্কিন দেশে বইমেলার আয়োজক কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান হলে সেখানে কি ডাক পেতেন পল রবসন, আন্তোনিও গ্রামসি কিংবা এখনকার নোয়াম চমস্কি। বাংলাদেশে তাদের তুলনীয় বুদ্ধিজীবী নাই বলে আমরা কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাই। কিন্তু আমরা কি ভুলে গেছি আহমদ ছফার কথা? রাষ্ট্রের কাছে অস্বস্তিকর, বাঙালির চিন্তার ধারণ ক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি ধারালো হওয়ায় আহমদ ছফাকে বইমেলার পুরোটা মাস মেলা থেকে বাইরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্র। একাজে তারা পুরোপুরি সফল। আহমদ ছফার সাহিত্যকর্ম নিয়ে একটি আলোচনা সভারও আয়োজন হয়নি গত ১০ বছরে কোনো বইমেলায়।

আমাদের দেশের মিডিয়া তো মিডিওকার ছাড়া অন্যদের ধারণ করতে পারে না। কারণ মিডিয়া চলে মিডিওকারদের দ্বারা। রাষ্ট্রের চিন্তাধারাকে, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে মাৎসান্যায়কে, বিশ্বায়নের নামে নয়া ঔপনিবেশিক শাসন ও করপোরেটোক্রাসিকে সনাক্ত করার ক্ষমতা তথাকিথত মিডিয়া-ব্যক্তিত্বদের নাই। তারা অরুন্ধতী রায়ের লেখার অনুবাদ ছাপলেও বাংলাদেশের কোনো লেখকের এমন তীব্র রচনা তাদের পৃষ্ঠায় বা স্ক্রিনে জায়গা দেবে না। সত্যিকারের স্বাধীন মুক্তচিন্তার বইমেলার স্বপ্ন দেখি আমি। তবে নিকট ভবিষ্যৎ তো দূরস্থান, মাঝারিপাল্লার দূরত্বের ভবিষ্যতে তার কোনো সম্ভাবনা চোখে পড়ছে না।

০২.

সারা বছর ধরে যারা লেখালেখি করেন, বাংলাদেশের সাহিত্যকে যারা বাঁচিয়ে রাখেন এবং পুষ্টি জোগান, সেই লেখকরা বইমেলা এলে হারিয়ে যান। তারা হারিয়ে যান বিজ্ঞাপনের ভিড়ে। যে লেখককে দেখা যাচ্ছে সারা বছর লিখছেন দৈনিকের পাতায়, সাপ্তাহিকের পাতায়, সাহিত্য পত্রিকার পাতায়, ছোট কাগজের পাতায়, তার বইয়ের খবরটি পাঠক পান না ঠিকমতো। কারণ তার গ্রন্থের বিজ্ঞাপন হয় না। রঙচঙে বিজ্ঞাপন না দেখলে পাঠক জানবেন কীভাবে- মেলায় কোন কবি-সাহিত্যিকের কোন বইটি এসেছে? আমাদের দেশের খুব কম প্রকাশকই বিজ্ঞাপন ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুভব করতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে লেখকের টাকায়।  সেই ক্ষেত্রে নগদ পাত্তি ও  পুঁজিহীন লেখক কীভাবে টিকবেন? পুঁজির কাছে হেরে যায় সৃজনশীলতা। বিজ্ঞাপনের জোরে পাঠকের সামনে মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়ে যান জনপ্রিয় এবং মৌসুমী-সৌখিন লেখকরা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এইসব মৌসুমী জনপ্রিয় লেখকরা নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রে খুবই সফল। কেউ সফল ব্যবসায়ী, কেউ সফল বহুজাতিক কোম্পানির চাকুরে, কেউ সফল আমলা, কেউ সফল এনজিও-অধিপতি, কেউ সফল নারীনেত্রী, কেউ সফল ডাক্তার-আইনবিদ-সাংবাদিক, কেউ রাজনীতিক-এমপি-মন্ত্রী। তারা বাজারের ওঁত-ঘাঁত চেনেন। বাজারকে কাজে লাগাতে শিখেছেন। পাবলিককে চরিয়ে খেতে হয় কীভাবে তা তারা জানেন। জানেন যে বিজ্ঞাপনের জোরে ‘হয় কে নয়’ বানানো যায়।

এসব ঘটে। ঘটতে পারে। তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের পাঠকসমাজও সার্বিকভাবে অদীক্ষিত একটি পাঠকসমাজ। আমাদের সিংহভাগ পাঠকই আবার মৌসুমী পাঠক। এঁরা সারাবছর সাহিত্যের ছায়া মাড়ান না। বইমেলা এলে কেউ কেউ নিয়মরক্ষার মতো কিছু বই কেনেন। এই রকম পাঠকের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনই একমাত্র ভরসা। তিনি বিজ্ঞাপন দেখে বই কেনেন। আর পড়ার পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের অধঃপতনের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠেন।

এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে যে, যিনি সারাবছর লেখালেখিতে নিমজ্জিত থাকেন, যার লেখা বছরজুড়েই প্রকাশিত হতে থাকে, তিনি কেন বইমেলা এলে নিজের টাকায় নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপতে যাবেন? তাকে তো বছরজুড়ে বা দশকজুড়ে পাঠক-সমালোচক-সম্পাদকরা পরিমাপ করেই আসছেন! এই প্রশ্নের উত্তরও একটাই। বছরজুড়ে আমাদের বৃহত্তর পাঠকসমাজ যেখানে সাহিত্যবিমুখ, সেখানে বিজ্ঞাপন বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য।

ফেইসবুক? নিজের বইয়ের খবর কতবারই বা প্রচার করা যায় ফেইসবুকে? রুচি এবং আত্মসম্মান বলে তো একটা ব্যাপার থাকে সিরিয়াস লেখকদের।

তাহলে প্রকৃত লেখকরা কীভাবে পৌঁছাবেন পাঠকের কাছে?

একটি পথ খোলা থাকার কথা। কোন সে পথ? বইমেলা উপলক্ষে সকল পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বইমেলার লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের জন্য জায়গা বরাদ্দ করে থাকে। সেখানে লেখকদের যথাযথভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে থাকেন সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার কর্তৃপক্ষ। এটি যথেষ্ট হতে পারত। কিন্তু হয় না। তার কারণ পত্রিকা এবং চ্যানেলগুলি তাদের যে কর্মীকে বইমেলা কভার করার দায়িত্ব দিয়ে থাকেন, তাদের অধিকাংশেরই সাহিত্যবোধ যথাযথ মানসম্মত নয়। তারা যেসব লেখকদের বই কভার করেন, তা দেখেই বোঝা যায় তাদের সাহিত্যবোধ কতটা অগভীর। তারা কিছু বয়ঃজ্যেষ্ঠ লেখকের বইয়ের খবর দিয়ে থাকেন বটে। তবে তাদেরও মাতামাতি প্রধানত সেইসব লেখকদের নিয়েই, যাদের রয়েছে গ্ল্যামার। আর বাদবাকি থাকে অনুরোধের আসর।

তাহলে বইমেলায় প্রকৃত লেখকদের নেপথ্যে না থেকে উপায় কী! 



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়