ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ছোটগল্প || অঙ্গার

গাজী তানজিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৩, ৯ মার্চ ২০২০   আপডেট: ১৬:১১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
ছোটগল্প || অঙ্গার

সে যখন তোমাকে হসপিটালে দেখতে এলো, তখন গভীর রাত। সন্ধ্যা থেকে বসেছিল ওয়েটিং লাউঞ্জে তোমার অ্যাটেনডেন্টদের সবার চলে যাওয়ার অপেক্ষায়। আবায়ায় আবৃত শরীর, তাও তুমি চিনতে পারলে। এই এক উপায় এদের নিজেকে আড়াল করার। সে আড়াল করেছিল নিজেকে তোমার কাছ থেকে কোনো রকম বাড়তি আবরণ না রেখেই। সে তোমাকে আড়াল করে গেছে তার সব অভিলাসগুলো। আর এখন পৃথিবীর সবাইকে আড়াল করে তোমার কাছে এসেছে, তোমাকে শেষ বারের মতো দেখতে- তখন তুমি অঙ্গার! সেও তোমাকে তোমার ওই প্রথম কুমারীত্ব কেড়ে নেয়া প্রাণীটার মতো একটা শরীরই ভেবেছিল। এখন পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া একটা শরীরের সামনেই সে এসে দাঁড়িয়েছে। যে এই শরীরের ভেতরের মানুষটাকে বুঝতে চায় নাই কখনো। চিনতেও না।

আত্মহননের জন্য তোমার ব্লুহোয়েল গেমসের দরকার পড়ে না। এই হনন প্রক্রিয়া জন্মক্ষণ থেকে তোমার পাশে পাশে হাঁটছে। একথাই তুমি ভাবছিলে আগুনের লেলিহান শিখার কাছে নিজেকে শপে দিতে দিতে। তুমি ভেবেছিলে এই পৃথিবীতে তুমি একা। তোমার জন্য কোথাও কেউ নেই। তোমার গর্ভধারিণী মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। সুন্দর বাংলায় যাকে বলে- অপ্রকৃতিস্থ। ইংরেজিতে কখনো অ্যাবনরমাল, কখনো অটিস্টিক। এমন অনেক শব্দ শুনে শুনে তুমি বড় হয়েছ। যিনি নিজেই ইম্ব্যালান্সড তিনি তোমাকে কীভাবে পাখিমাতার মতো আগলে আগলে রাখবেন! তাইতো তুমি আগলে রাখার সময়টাতেই আগল ছাড়া হয়ে গিয়েছিলে।

তুমি সুন্দরী এবং সঙ্গত কারণেই বারমুখো। মায়ের মানসিক অসুস্থতার সুযোগে অন্যদের কাছে অরক্ষিত। আর একারণেই সেক্সুয়াল অ্যাবিউজমেন্ট বিষয়টা তোমার জন্য নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর যাবতীয় লোলুপ পুরুষের চোখগুলো তোমাকে লেহন করে গেছে। ওই বয়ঃসন্ধির কালেই পুরুষের কদর্য রূপ তুমি দেখে ফেলেছ। অতঃপর, পুরুষ ভাবনাটাই তোমার ভেতরে বিবমিষার উদ্রেক করে গেছে। কোনো পুরুষের প্রতি তোমার কখনো কোনো প্রেমানুভূতি জাগে নাই। তুমি সব সময় মনে মনে ভেবেছ, সেক্সুয়ালিটি ইজ অ্যা চয়েস।

তোমার সেক্সুয়াল চয়েস যে আলাদা এটা হয়ত তোমার খুব কাছের বান্ধুও বুঝে উঠতে পারে নাই। তুমিও কি ততটা শিওর ছিলে তখন পর্যন্ত! যখন পর্যন্ত না তোমার প্রিয় বন্ধু সারাহ তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক-আপ হয়ে গিয়েছিল! যদিও হেরেটোসেক্সুয়াল সম্পর্কগুলো তোমার কাছে মনে হতো মিথ্যার প্রলেপ।

সারাহ আর তপনের সম্পর্কের কথাটা তুমি জানতা। ওদের গভীর গোপন অনুভূতি- সব কিছু সারাহ তোমার সাথে শেয়ার করত। তুমি মাঝে মাঝে সারাহকে দেখে ভাবতা কি করে কাউকে এতোটা ভালোবাসা যায়! না কি যৌনতাও এই মোহের অন্যতম একটা কারণ ছিল! এবং এক সময় সারাহর মোহ ভাঙল, এবং তুমি নিজেকে জয়ী ভাবতে লাগলা।  আর সারাহ নিজেকে প্রতারিত।

সারাহ যখন নিজেকে প্রতারিত ভেবে কষ্ট পাচ্ছিল, তখন তুমি তাকে একদিন বললা, সারাহ তুই একটু অন্যরকম করে ভাব। সারাহ যেন একটু ধাক্কা খেল এবং তোমাকে বলল, অন্যরকম করে ভাবব মানে? তুই বুঝতে পারতেছিস না ও আমার সাথে কিী করছে! ফুর্তি করছে- জাস্ট ফুর্তি! তাইতো এতো সহজে সে বাবা-মায়ের পছন্দে অন্য একজনকে বিয়ে করতে পারল।

তুমি বললা, তুই কেন এরকম ভাবতেছিস? কেন তুই তোর ধারণাটাকে একটা অ্যাভারেজ ছকে ফেলে দিয়ে কষ্ট পাচ্ছিস! কেন তুই প্রেমের ক্ষেত্রে ওর ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছিস? এখানে ইচ্ছেটা তোরও। যখন প্রেম ছিল তখন সেটা দুজনেরই তো ছিল। আর এনজয়মেন্টের ব্যাপারটাও দুজনেরই ছিল। তবে তুই কেন ভাবতে পারতেছিস না যে, তুই তাকে ভোগ করেছিস! এখন সে চলে গেছে, দ্যাটস ওভার। তুইও নতুন কাউকে খুঁজে নে। জীবন অনেক বড়, এটা কারো জন্যে বসে থাকে না। মেয়ে বলে যে সে-ই ভোগ্যা হবে, সে-ই প্রতারিত হবে, এই টিপিক্যাল ধারণা থেকে বের হয়ে আয়।

তোমার এই লেকচার শুনে সারাহ কতটা তার ধারণা থেকে বের হয়ে এসেছিল বোঝা মুশকিল। তবে সে এটা ভেবে তোমাকে আরো আপন ভাবতে শুরু করেছিল যে, তোমরা দুজনেই কোনো না কোনোভাবে অ্যাবিউজড। যে কারণে সে তোমাকে আরো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেছিল।

তবে তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বরাবর পরিষ্কার ছিলে। তারুণ্যে এসেও তুমি বেশ কয়েকবার ভেবেছ, কিন্তু কখনো কোনো পুরুষের প্রতি তুমি আকর্ষণ বোধ করো নাই। তুমি বইয়ে পড়েছিলে এমন একটা সম্পর্কের বুনন সম্পর্কে। ব্যাপারটা হয়ত মস্তিস্ক নিঃসরিত কোনো বিষয় অথবা শরীরবৃত্তীয়। অনেক দিন থেকে তোমার ভেতরে এমন এক ধরনের আকর্ষণ কাজ করে যাচ্ছিল। যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মেয়ে। কৈশোরকাল থেকেই তাদের সদ্য গজিয়ে ওঠা বুক, শরীরের আদলের পরিবর্তন তোমাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলত। তুমি তখন নিজেও বিবর্তিত হচ্ছিলে কিন্তু তোমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল ওরা।

তবে সারাহ মনে করত তার সাথে তোমার সম্পর্কটা শুধু শারীরিক নয়। যতটা শারীরিক তার চেয়ে বেশি আত্মিক। তোমাদের দুজনার মানসিক মিল এই সম্পর্ককে তরান্বিত করেছিল। তাতে তোমরা পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলে। সেই নির্ভরশীলতা এক সময় ফিকে হয়ে আসে।

একটা মেয়েদের মেসে তোমরা দুজন যখন থাকতে শুরু করলে, তখনই শুরু হলো সম্পর্কের টানাপোড়েন। আর সারাহ তখন একটা হেলদি লাইফের জন্য বেচ্যান হয়ে ওঠে। সে সোজা জানিয়ে দেয়, সে জীবনটাকে সাদা-কালোয় বোঝে। এর বাইরে যে জগৎ সে জগৎ তার কাছে ঝাপসা ভবিষ্যৎহীন লাগে। এই ভবিষ্যৎ শব্দটাতে তোমার বড় সংশয়! কার ভবিষ্যৎ কতটা নিশ্চিত হবে এটা কে বলতে পারে! কেউ কি পারে?

সারাহ যেদিন চলে যায়, সেদিন থেকে তুমিও আর তোমাদের মেসে ফিরে যাও নাই। তুমি তোমাদের দুজনার এই যাবতীয় সম্পর্কটাকে, যাকে তোমার সুখ বলে মনে হতো, তাকে একটা আলাদা বাক্সে রেখে মুখটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছ। কিন্তু মন এক আশ্চর্য জগৎ। যা তুমি এর ভেতরে ঠাঁই দিতে চাও না, এড়িয়ে যেতে চাও, সেসব বিষয়গুলোই তোমার ভেতরে উস্কে দেবে বারবার।

এপর বেশ কয়েকদিন তুমি ভেবেছ। সারাহর সাথে তোমার সম্পর্কটা আদৌ শুধুমাত্র শরীরে সীমাবদ্ধ ছিল কি না? আর প্রতিবারই উত্তর এসেছে ‘না’। 

আর তাইতো এই শরীরের খাঁচায় বন্দি যে মানুষ তাকে তুমি আর কষ্ট দিতে চাও নাই। তুমি তাকে মুক্তি দিতে চেয়েছ। কিন্তু তোমার কি মুক্তি মিলেছে? এভাবে কি মুক্তি মেলে! যখন কতগুলো অতি আপন উদ্বিগ্ন করুণ মুখ তোমার উপর ঝুকে পড়ে, হারানো তোমাকে খুঁজে পেতে চায় প্রাণপণে। তখন তোমার ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কেন তুমি এমন করলে? কেন তুমি সেদিন অঙ্গার হলে? তুমি জানো, কারো কিছু হবে না, কিছু থেমে থাকবে না কোথাও। শুধু একটা দুর্দান্ত জীবনকে তুমি মেরে ফেললে!


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়